গাজায় হামাসের ৩০০ মাইলের সুড়ঙ্গ ফাঁদ আতঙ্কে স্থল হামলা চালাতে সাহস পায়নি ইসরাইল

অনুসন্ধানী আন্তর্জাতিক ওকে নিউজ স্পেশাল জনদুর্ভোগ জনপ্রতিনিধি তথ্য-প্রযুক্তি প্রচ্ছদ মুক্তমত রাজনীতি হ্যালোআড্ডা

পুরো গাজা উপত্যকায় হামাসের ৩০০ মাইলের সুড়ঙ্গ ফাঁদ! মুখে যাই বলুক ভেতর ভেতর ইসরাইলের বড় ভয় এই সড়ঙ্গ (টানেল পথ)। সমরবিশারদদের ধারণা, এই টানেল আতঙ্কেই ৭ দিনেও গাজায় স্থল হামলা চালাতে সাহস পায়নি ইসরাইলের সেনাবাহিনী।

দুর্ধর্ষ ইসরাইল বাহিনীর বিরুদ্ধে লড়তেই বছরের পর বছর ধরে হামাস গাজায় সুড়ঙ্গ নেটওয়ার্ক তৈরি ও সম্প্রসারণ করেছে। প্রায় একটি ভ‚গর্ভস্থ শহরের মতো গাজার এই টানেলগুলোর গল্প এতটাই মুখরোচক যে প্রতিবেশী দেশগুলোতে সুড়ঙ্গ পথের বদলে ‘শহরের নিচে আরেক শহর’ নামেই বেশি পরিচিত।

বিচক্ষণ হামাস যোদ্ধারা শুরু থেকেই বুঝেছিলেন, অবরুদ্ধ গাজায় পশ্চিমা মদদপুষ্ট ইসরাইলের সঙ্গে লড়তে হলে মাটির ওপরের পাশাপাশি মাটির নিচেও যোগাযোগ নেটওয়ার্র্ক তৈরি করতে হবে। আর এখন এটিই হয়ে উঠেছে তাদের বড় রণশক্তি। বেড়েছে কৌশলগত সুবিধাও।

তবে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো, হামাস এই মডেল উদ্ভাবন করেনি। এটি লেবাননের শিয়া ইসলামি রাজনৈতিক দল হিজবুল­াহ থেকে আমদানি করা হয়েছিল। যারা ১৯৯০-এর দশকে ইসরাইলের আকাশসীমার আধিপত্য মোকাবিলার প্রয়াসে দক্ষিণ লেবাননে অনুরূপ নেটওয়ার্ক তৈরি করেছিল।

এএফপির এক প্রতিবেদনে বলা হয়, এর মধ্যে কিছু টানেল গাজা থেকে সরাসরি সীমান্তের কাছে ইসরাইলি সম্প্রদায়ের দিকে নিয়ে যাওয়া হয়। যার মাধ্যমে হামাস ইসরাইলি অভিযানে সক্ষম হয়। সুড়ঙ্গগুলোর বেশিরভাগই এক মিটার চওড়া ও আড়াই মিটার উঁচু। ফলে একজন মানুষ সহজে প্রবেশ করতে পারে। অনেক ক্ষেত্রে সুড়ঙ্গগুলো ভ‚পৃষ্ঠের গভীর পর্যন্ত যায়। ভূপৃষ্ঠের ৩০ মিটার নিচে পৌঁছায়। হামাস এটি তৈরিতে বিশাল অর্থ ব্যয় করেছে।

ওয়াশিংটন পোস্টের একটি প্রতিবেদনে বলা হয়, হামাস ২০০৭ সাল থেকে ১.২৫ বিলিয়ন ডলার ব্যয়ে ১ হাজার ৩০০টিরও বেশি টানেল তৈরি করেছে।

প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, হামাস গাজার নিচে তিনটি ভিন্ন ধরনের টানেল তৈরি করছে। ইসরাইলি প্রতিরক্ষা বিশ্লেষক এডো হেচট ব্যাখ্যা করেছেন, গাজা এবং মিসরের মধ্যে পণ্য সরবরাহের জন্য একটি সুড়ঙ্গ রয়েছে। গাজার অভ্যন্তরে প্রতিরক্ষামূলক টানেল রয়েছে, যা কমান্ড সেন্টার এবং অস্ত্র সংরক্ষণের জন্য ব্যবহৃত হয়।

সবশেষ ইসরাইলে আন্তঃসীমান্ত আক্রমণের জন্য আক্রমণাত্মক টানেল রয়েছে। সুড়ঙ্গগুলোকে ‘দ্য মেট্রো’ বলে অভিহিত করা হয়। স্থল হামলায় নামার আগে সে কারণেই গাজার টানেলগুলো লক্ষ্য করে বিমান ও ক্ষেপণাস্ত্র হামলা চালিয়েছে ইসরাইল সেনারা।

বৃহস্পতিবার এক বিবৃতিতে এ কথা বলেন ইসরাইল সেনাবাহিনীর এক মুখপাত্র। গাজা উপত্যকার টানেল গুঁড়িয়ে দেওয়ার টার্গেট এটিই প্রথম নয় ইসরাইলের। ২০২১ সালে ইসরাইল গাজায় ৬২ মাইলেরও বেশি সুড়ঙ্গ ধ্বংস করেছিল। ৫৪টি বিমান এ অপারেশনে অংশ নিয়েছিল। কিন্তু হামাস বারবার টানেল সিস্টেমে বিনিয়োগ করেছে।

২০০৬ সালে প্রথম তাদের অস্তিত্ব পাওয়া গিয়েছিল। যখন হামাস ক্ষমতায় আসার সময় ইসরাইলি অবরোধ ঘোষণা করা হয়েছিল। সুড়ঙ্গগুলো দিয়ে ভূখণ্ডে বসবাসকারী ২ মিলিয়ন ফিলিস্তিনির জন্য খাদ্য ও প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র নিয়ে আসা হয়েছিল। হামাস পরবর্তীতে তার নিজস্ব সামরিক উদ্দেশ্যে টানেলের নিয়ন্ত্রণ নিয়ে নেয়।

অনেকগুলো ধ্বংস হয়ে গেলেও ২০১৪ সাল থেকে হামাস আবারও ভূগর্ভস্থ পথ খনন করে। কিছু সুড়ঙ্গ মাটির নিচে ৩০ অথবা ৪০ মিটার (১০০ বা ১৩০ ফুট) পর্যন্ত গভীর।

হামাসের টানেল যুদ্ধ সম্পর্কে সতর্ক করে যুক্তরাষ্ট্রের নিরাপত্তাবিষয়ক সোফান সেন্টার থিঙ্ক ট্যাঙ্কের গবেষণা পরিচালক কলিন পি. ক্লার্ক বলেছেন, ‘গাজার তলদেশে একটি দীর্ঘ সুড়ঙ্গ নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে হামাস ইসরাইলি প্রতিরক্ষা বাহিনীর (আইডিএফ) সঙ্গে আক্রমণের প্রস্তুতি নিচ্ছে। এটি যুদ্ধকে জটিল করে তুলতে পারে। সুড়ঙ্গের নেটওয়ার্ক কেমন সে সম্পর্কে ব্যাপক বুদ্ধিমত্তার প্রয়োজন। ইসরাইলিদের এ সম্পর্কে যথেষ্ট জ্ঞান না থাকলে ফাঁদে পড়ার সম্ভাবনা রয়েছে।’ আই নিউজ।

নীতি গবেষণাবিষয়ক জেরুজালেমের থিঙ্ক ট্যাঙ্ক জেরুজালেম ইনস্টিটিউট ফর স্ট্র্যাটেজি অ্যান্ড সিকিউরিটির (জেআইএসএস) বিশেষজ্ঞ আলেকজান্ডার গ্রিনবার্গ বলেন, হামাসের টানেলের সুবিধা একটি ফাঁদ হতে পারে।

ফরাসি সংবাদ টেলিভিশন নেটওয়ার্ক ফ্রান্স২৪-কে আরও বলেছেন, ‘সুড়ঙ্গের প্রবেশপথ বেসামরিক ভবনগুলোতে অবস্থিত হতে পারে, যা ইসরাইল বাহিনীর পরিকল্পিত আক্রমণকে জটিল করে তুলতে পারে।’

বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, শনিবারের (৭ অক্টোবর) হামলায় হামাস যোদ্ধারা এই ভূগর্ভস্থ পথ দিয়েই ইসরাইলে প্রবেশ করেছিল। এএফপি, রয়টার্স, আলজাজিরা।

হামাস যোদ্ধারা হঠাৎ কখন কোথা থেকে আক্রমণ করতে পারে সে বিষয়ে কিছুটা আতঙ্কিত ইসরাইল। এদিকে হামাসে ইসরাইলি জিম্মিরা ইসরাইলের জন্য আরেকটি জটিলতা তৈরি করেছে।

যুক্তরাষ্ট্রের কাউন্সিল অন ফরেন রিলেশনের বিশেষজ্ঞ ব্রুস হফম্যান বিপজ্জনক সুড়ঙ্গের কথা উল্লেখ করে বলেন, সুড়ঙ্গগুলোতে ইসরাইলি জিম্মিদের সম্ভাব্য অবস্থান হতে পারে। এজন্য সুড়ঙ্গপথ ধ্বংস করাও বিপজ্জনক হয়ে উঠেছে।

সোমবার এক বিবৃতিতে এ মন্তব্য করেন হফম্যান। আরও বলেন, ভূগর্ভস্থ যুদ্ধ হামাসের রক্ষক এবং তাদের নেতৃত্বকে একটি বড় কৌশলগত সুবিধা দেবে।

ফ্রান্সের ন্যাশনাল সেন্টার ফর সায়েন্টিফিক রিসার্চের (সিএনআরএস) সমাজবিজ্ঞানী সিলভাইন বুলে বলেছেন, জিম্মিদের জীবনকে অগ্রাধিকার না দিলে ইসরাইলি সমাজ এটাকে ক্ষমা করবে না। নাগরিক জীবনের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে ব্যর্থ হলে রাজনীতিবিদ এবং সামরিক বাহিনীর মধ্যে সংঘর্ষ শুরু হতে পারে।

ইসরাইলের শহর তেল আবিবের আইএনএসএস থিঙ্ক ট্যাঙ্কের গবেষক কোবি মাইকেল বলেছেন, সরকার আপাতত এ বিষয়ে আলোচনা করতে পারছে না।

তবে ইসরাইলি প্রধানমন্ত্রী বেঞ্জামিন নেতানিয়াহু আগে এ বিষয়ে সতর্ক করেছিলেন। বলেছিলেন, সুড়ঙ্গগুলো জিম্মি করা ইসরাইলি বেসামরিক নাগরিকদের থাকার জন্য ব্যবহার করা হবে। আগের ভয় এখন বাস্তবে রূপ নিয়েছে।

ইসরাইলের পক্ষে সুড়ঙ্গগুলো শনাক্ত করা খুব কঠিন। তবে আলজাজিরার প্রতিবেদনে জানা যায়, ইতোমধ্যে চলমান যুদ্ধে আইডিএফ তাদের আন্দোলনকে শ্বাসরোধ করতে হামাসের সুড়ঙ্গে আঘাত করছে।

বৃহস্পতিবার আইডিএফ মুখপাত্র জোনাথন কনরিকাস গণমাধ্যম এক্স-এর একটি পোস্টে বলেছেন, ‘সর্বশেষ বিমান হামলার লক্ষ্য ছিল গাজা উপত্যকার সুড়ঙ্গের একটি নেটওয়ার্ক ধ্বংস করা, যা হামাস কয়েক দশক ধরে একটি অপারেশন সেন্টার হিসাবে ব্যবহার করে আসছে।’

আলজাজিরা আরও জানায়, সুড়ঙ্গগুলো ধ্বংস করার প্রয়াসে ইসরাইল একটি শক্তিশালী বোমা বাঙ্কার বাস্টারও ব্যবহার করছে। এই বাঙ্কার বাস্টারগুলো বিস্ফোরণের আগে মাটির গভীরে গর্ত করে। এরপর শক্ত লক্ষ্যবস্তুগুলোকে ধ্বংস করতে সক্ষম হয়।

লন্ডনের থিঙ্ক ট্যাঙ্ক চ্যাথাম হাউজের ইসরাইলের বিশেষজ্ঞ ইয়োসি মেকেলবার্গ এগুলোকে শক্তিশালী কিন্তু ভয়ংকর গোলাবারুদ বলে অভিহিত করেছেন।

কিন্তু সাবেক ঊর্ধ্বতন সামরিক ব্যক্তিত্বরা ব্যাখ্যা করেছেন, প্রতিটি সুড়ঙ্গ ধ্বংসের জন্য এক নির্মাণ করা হয়। ফলে প্রত্যেকটি খুঁজে বের করে ধ্বংস করা কঠিন হতে পারে। ধারণা করা হচ্ছে, সুড়ঙ্গগুলো গাজা উপত্যাকার খান ইউনিস থেকে রাফাহ শহর পর্যন্ত চলে গেছে।
গাজায় ইসরাইলের ক্রমাগত বিমান হামলা সত্ত্বেও হামাস ইসরাইলি শহরগুলোতে রকেট ছুড়তে সক্ষম হয়েছে।

প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, অনেক ক্ষেত্রে এই রকেটগুলোকে ট্র্যাকের ওপর ভূগর্ভে লুকিয়ে রাখা হয়েছে। যাতে সেগুলোকে সুড়ঙ্গের নেটওয়ার্কের মধ্যে সরানো যায়। এটি ইসরাইলের বিমানবাহিনীকে আরও হতাশ করে।

বৃহস্পতিবার ইসরাইলি সেনাবাহিনীর একজন মুখপাত্র ব্রিটিশ সংবাদমাধ্যম রয়টার্সকে বলেছেন, সেনাবাহিনী একটি স্থল হামলার প্রস্তুতি নিচ্ছে। তবে দেশটি কখন শুরু করবে তা এখনো সিদ্ধান্ত নেননি। ইসরাইলের বাঙ্কার বাস্টার বোমা এবং হাইটেক মেরকাভা ট্যাঙ্কগুলো সুড়ঙ্গ ধ্বংসে ব্যবহার করা হবে বলে জানান। সেনারা ভূগর্ভস্থ নেটওয়ার্ক ব্যবহার করে আঘাত করবে এবং হামাসকে নিশ্চিহ্ন করবে। কিন্তু ঘনবসতিপূর্ণ এলাকায় বাঙ্কার বাস্টার বোমা ব্যবহার করা নিষিদ্ধ। এজন্য ইসরাইলি কর্মকর্তারা মনে করেছেন, এটি দ্রুত বা সহজ অভিযান হবে না।

আরো পড়ুন : কৌশলগত দিত দিয়ে হামাস ইসরাইলের কল্পনার চেয়েও বেশি এগিয়ে

Share The News

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *