গুম হওয়া ব্যক্তিদের স্বজনদের কান্নায় ভারী হয়ে উঠে পরিবেশ

এনজিও ওকে নিউজ স্পেশাল ক্রাইম নিউজ নারী পুরুষ পুরুষ অধিকার প্রচ্ছদ মনোকথা মুক্তমত রাজনীতি লাইফ স্টাইল হ্যালোআড্ডা

স্টাফ রিপোর্টার : আর কতোকাল আমরা অপেক্ষায় থাকবো। তারা বেঁচে আছে কি বেঁচে নেই তাও জানি না। আমরা গুম দিবস পালন করতে চাই না, আমরা বাবা দিবস পালন করতে চাই। আজও রাস্তায় রাস্তায় আমাদের নিখোঁজ স্বজনদের ছবি নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকি। এই মনে হয় আমাদের স্বজনরা ফিরে আসবে। এভাবে বুকভরা কষ্ট নিয়ে কথাগুলো বলছিলেন দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে ছুটে আসা বিভিন্ন সময়ে নিখোঁজ ব্যক্তিদের পরিবারের সদস্যরা। আন্তর্জাতিক গুম প্রতিরোধ দিবস উপলক্ষে গতকাল গুম হওয়া ব্যক্তিদের স্বজনদের সংগঠন মায়ের ডাক আয়োজিত অনুষ্ঠানে গুম হওয়া ব্যক্তিদের স্বজনদের কান্নায় ভারী হয়ে উঠে পরিবেশ।

নিখোঁজ ব্যক্তিদের কারও মা, কারও স্ত্রী-সন্তান, কারও বোন, কারও ভাই এসেছিলেন অনুষ্ঠানে। রাজধানীর ইঞ্জিনিয়ারিং ইনস্টিটিউট অব ডিপ্লোমার মুক্তিযুদ্ধ স্মৃতি মিলনায়তনে আয়োজিত অনুষ্ঠানে বিশিষ্ট ব্যক্তি ও মানবাধিকারকর্মীরা সংহতি প্রকাশ করে বক্তব্য রাখেন।

২০১৩ সালে গুম হওয়া বংশাল থানা ছাত্রদল সহসভাপতি মোহাম্মদ সোহেলের মেয়ে সাফা বলেন, আমার কষ্ট হয়। জন্মের পর বাবাকে দেখিনি। স্কুলের বন্ধুরা তাদের বাবাদের হাত ধরে আসে।

আমি কার হাত ধরে স্কুলে যাবো? আমি কখনো বাবার আদর পাইনি। আমি সরকারকে অনেকবার বলেছি, আজকেও বলছি আমার বাবাকে ফিরিয়ে দেন। আমার বাবাতো কোনো অপরাধ করেনি। আমার বাবাকে ফিরিয়ে দিন। বাবা ছাড়া আমার আর ভালো লাগে না।

কাঁদতে কাঁদতে গুমের শিকার সাজেদুল ইসলাম সুমনের মা হাজেরা খাতুন বলেন, আমি গুম হওয়া সুমনের মা। আজকে এত বছর হয়ে গেছে দুই নাতনি নিয়ে আছি। ছেলের কোনো খোঁজ পাইনি। আপনারা দোয়া কইরেন, মরার আগে যেন আমার ছেলেকে দেখতে পারি।

২০১৩ সালের ৪ঠা ডিসেম্বর নিখোঁজ হওয়া সাজেদুল ইসলাম সুমনের মেয়ে আলেয়া বলে, আমার বাবা এখনো আসেনি। আমার বাবাকে আমি খুঁজছি। আমার বাবাকে খুঁজে আমার কাছে এনে দিন।

১০ বছর আগে ঢাকার সূত্রাপুরের ছাত্রদল নেতা খালিদ হাসান সোহেল নিখোঁজ হন। তখন তার ছেলের তাকে চেনার বয়স হয়নি। তাই বাবাকে নিয়ে ছেলের কোনো স্মৃতিও নেই। এখন খানিকটা বড় হয়ে সবকিছুতেই বাবার সঙ্গে মিল খুঁজে বেড়ায় সে। মায়ের কাছে নানা প্রশ্ন করে বাবার সঙ্গে তার মিল-অমিলের বিষয়গুলো। শিশুটির মা শাম্মী সুলতানা বলেন, সে সবসময় জিজ্ঞেস করে- আমি কি দেখতে বাবার মতো হয়েছি? আমি কি এখন বাবার সমান হয়ে গেছি। আমার হাতগুলো কি দেখতে বাবার মতো? আমি তার কোনো প্রশ্নের জবাব দিতে পারি না।

চার বছর আগে নিখোঁজ হন ব্যবসায়ী ইসমাইল হোসেন। তার মেয়ে আনিশা ইসলাম বাবার ছবি হাতে কাঁদছে। আনিশা বলেন, আজও রাস্তায় রাস্তায় আমার বাবার ছবি হাতে দাঁড়িয়ে থাকি। আমার জীবনের প্রতিটি মুহূর্ত আমার বাবার প্রতীক্ষায় কাটে। প্রতিটি মুহূর্তে মনে হয় আজই আমার বাবা ফিরে আসবে। রাতের পর রাত অপেক্ষা করেছি। আজও মনে হয় আমার বাবাকে আমি ফিরে পাবো। মনে হয় আমার বাবা আমার কাছে ফিরে আসবে। প্রধানমন্ত্রী আপনার কাছে এভাবে চার বছর ধরে আবেদন করছি। অনেক অনুনয় অনেক বিনীতভাবে প্রার্থনা করেছি আমার বাবাকে আমার কাছে ফিরিয়ে দেন। এভাবে একটি স্বাধীন রাষ্ট্রে কেন গুম, এর জন্য তো আমাদের শহীদেরা জীবন দেয়নি। সেই ১৯৭১ সালে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী আমাদের বাঙালিদের গুম করেছিল আর আজ স্বাধীনতার ৫০ বছর পরে আবারও সেই গুমের নীতি তৈরি করা হয়েছে। এই স্বাধীন দেশের মানুষ গুম হচ্ছে তাহলে কীভাবে স্বাধীন দেশ পেলো। আজকে আমরা মত প্রকাশের স্বাধীনতা হারিয়ে ফেলেছি। আমি যখন মাইকে কথা বলি আমার ভয় লাগে, আমার মা যখন কথা বলে তখন তিনিও ভয় পান। কেন এই ভয় তাহলে এই স্বাধীনতার মূল্য কোথায়? আমরা তো নির্ভয়ে কথা বলতে পারি না। তাহলে এই আঠারো কোটি মানুষের স্বাধীনতা কোথায়? আমি আমার বাবাকে এই চার বছর ধরে রাস্তায় রাস্তায় খুঁজে বেড়াচ্ছি। আমি আমার বাবাকে ফিরে পাচ্ছি না। আমার ভাই যখন আমাকে প্রশ্ন করে আপু আমার বাবা কি বেঁচে আছে? বা কোথায় আছে? আমি তখন নির্বাক হয়ে যাই, প্রশ্নের উত্তর দিতে পারি না। আমার ভাইয়ের যখন দুই বছর বয়স তখন থেকে এই ছবি হাতে সে রাস্তায় রাস্তায় দাঁড়িয়েছিল।

অনুষ্ঠানে নাগরিক ঐক্যের সভাপতি মাহমুদুর রহমান মান্না বলেন, শেখ হাসিনার লোহার হার্ট আছে। সি ইজ রিয়েলি হার্টলেস। আমি দীর্ঘদিন আওয়ামী লীগ করেছি, কিন্তু তার হার্ট আছে এমন আমি কখনো দেখিনি। অভিনয় করে কথাবার্তা বলেন। কিন্তু এই কান্না তার কাছে যায় না। যে নেত্রী বলেন- যখন ডিমের দাম কম থাকবে, তখন সেদ্ধ করে তা ফ্রিজে রাখবে। উনি জানেন না এমন কোনো কিছু নেই, শুধুমাত্র মানুষের দুঃখ কষ্ট উনার কাছে পোঁছে না। উনার বুকের মধ্যে মমতা নেই। যতই কাঁদেন, তার চোখের কোণ ভিজবে না। এই সরকার যতদিন পর্যন্ত আছে ততদিন পর্যন্ত গুম হয়ে যাওয়া মানুষের কোনো খবর পাওয়া যাবে না। আপনারা কষ্ট পেতে পারেন, তবে পাঁচ বছর আগেও এই একই কথা বলেছি।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক আসিফ নজরুল বলেন, শুধু ক্ষমতায় টিকে থাকার জন্য মানুষকে গুম করা হয়েছে। অবৈধভাবে ক্ষমতায় থাকার জন্য তাদের হত্যা করা হয়েছে। যারা বাংলাদেশে গণতান্ত্রিক অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য কাজ করে তাদেরকে নিশ্চিহ্ন করার জন্য বাংলাদেশকে ভারতের হাতে তুলে দেয়ার জন্য, বাংলাদেশের ব্যাংক লুটপাট করার জন্য, লাখ কোটি টাকা বিদেশে পাচার করার জন্য এই গুমগুলো করা হয়েছে। ভিন্ন মতের মানুষদের মনে ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করার জন্য এইসব করা হয়েছে। যদি আমরা গুমের বিচার চাই, বিচার বহির্ভূত হত্যাকান্ডের বিচার চাই তাহলে জনগণের ভোটে নির্বাচিত সরকার প্রতিষ্ঠা করতে হবে। বাংলাদেশে বাংলাদেশের সরকার প্রতিষ্ঠা করতে হবে।

গণসংহতি আন্দোলনের প্রধান সমন্বয়ক জুনায়েদ সাকি বলেন, বাংলাদেশ যে দেউলিয়া হতে যাচ্ছে এটা ঠেকানোর উপায় এই সরকারের নেই। তারা যতই বলুক তারা অভিজ্ঞ, বর্তমান বিদ্যমান অর্থনৈতিক সংকট তারা কাটিয়ে উঠতে পারবে না। এই সরকার থাকা মানে আরও গভীর অর্থনৈতিক সংকটের মধ্যে যাওয়া। এই সরকার বাসে আগুন দেয়া, হাতে অস্ত্র ধরিয়ে দেয়া, মাদক ধরিয়ে দেয়াসহ নানা ধরনের চক্রান্তের জালসহ সবকিছু করবে। কিন্তু তার বিরুদ্ধে মানুষের শক্তি নিয়ে আমরা রাজপথে দাঁড়াবো। তাদের সব শক্তিকে আমরা নস্যাৎ করে দেবো- সেই শপথ আমাদের নিতে হবে। আপনারা কেউ ভয় পাবেন না। কারণ ওই ভয় পাওয়ানোটাই তাদের সবচেয়ে বড় অস্ত্র।

গণঅধিকার পরিষদের সভাপতি নুরুল হক নুর বলেন, সব সমস্যার কেন্দ্রবিন্দু একজন। তিনি অমরত্ব লাভ করার জন্য আজীবন ক্ষমতায় থাকতে চান। এজন্য বিরোধী দল নির্মূল করার জন্য তার একটা টার্গেট থাকবেই। আগামী দুই মাসের মধ্যে বাংলাদেশের জনগণের ভাগ্য নির্ধারিত হবে। তাই বিরোধী দলের যেসব ভাইয়েরা রাজপথে আন্দোলন করছে তাদেরকে এক হয়ে থাকতে হবে। হয় লড়ো, না হয় মরো।

বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টির সাধারণ সম্পাদক সাইফুল হক বলেন, আমরা কোনো প্রতিশোধের রাজনীতি করি না। কিন্তু যারা খুনি, ডাকাত এবং প্রতিটি গুমের জন্য দায়ী তাদের বিচার করা হবে। দেশকে আইনের শাসন ও গণতান্ত্রিক ধারায় নিয়ে যাবো। সেই লড়াইয়ে আমরা গুম হওয়া পরিবারের সকলের সঙ্গে ভাই-বন্ধু হিসেবে এগিয়ে যাবো। আমরা আপনাদের সঙ্গে ছিলাম, আপনাদের সঙ্গে আছি এবং শেষ পর্যন্ত আপনাদের সঙ্গে থাকবো।

অনুষ্ঠানে আরও বক্তব্য রাখেন, বিএনপি’র মানবাধিকার বিষয়ক সম্পাদক এডভোকেট আসাদুজ্জামান আসাদ, ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশন নির্বাচনে বিএনপি’র সাবেক মেয়র প্রার্থী তাবিথ আউয়াল, জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল জেএসডি স্থায়ী কমিটির সদস্য তানিয়া রব, মায়ের ডাকের সমন্বয়কারী আফরোজা ইসলাম আঁখি প্রমুখ।

আরো পড়ুন : অনিয়মের কারণে ইডিসি প্রকল্পে বছরে সরকারের দেড়শ’ কোটি টাকা গচ্চা 

Share The News

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *