বান্দরবান প্রতিনিধি: বান্দরবানের রোয়াংছড়ি উপজেলায় গোলাগুলিতে আটজনের মৃত্যুর ঘটনায় স্থানীয়দের মধ্যে চরম আতঙ্ক বিরাজ করছে। সেখানে এখন থমথমে অবস্থা। আতঙ্কিতদের একজন ষাটোর্ধ্ব অংশৈহ্লা খিয়াং। যেখানে হত্যাকাণ্ড ঘটেছে সেই খামতাংপাড়ার কার্বারি (পাড়া প্রধান) তিনি। গোলাগুলিতে ভয় পেয়ে অন্য সবার মতো তিনিও আশ্রয় নিয়েছেন রোয়াংছড়ি সরকারি উচ্চ বিদ্যালয়ে।
দুঃসহ সেই স্মৃতি হাতড়ে তিনি বললেন, ‘রাত তখন ৮টাও বাজেনি। পাড়ার অনেকে রাতের খাবার খেয়ে বিছানায় শুয়ে পড়েছে। অনেকে খাওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছিল। হঠাৎ করে পাড়ার দক্ষিণ দিকের জঙ্গল থেকে গুলির শব্দ কানে আসে। পুরো পাড়াতে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে। গরু, ছাগল, মুরগি, জমির ফসল সব রেখে অন্যদের মতো আমিও জঙ্গলে আশ্রয় নেই। পুরো রাত জঙ্গলে থেকে ভোরের দিকে চলে আসি রোয়াংছড়ি উচ্চ বিদ্যালয়ে। জানিনা আমাদের কার বাড়ি কীভাবে আছে। পোষা প্রাণীদের কী অবস্থা তাও জানা নেই।’ অংশৈহ্ল খিয়াং যখন এসব কথা বলছিলেন, তাঁর চোখ ছলছল করছিল।
এদিকে নিহতদের পরিচয় মিলেছে। তবে স্বজনরা লাশ নেননি। লাশ গ্রহণ করেছে বম সোশ্যাল কাউন্সিল। তবে গতকাল শনিবার সন্ধ্যা পর্যন্ত কোনো মামলা হয়নি।
রোয়াংছড়ি উচ্চ বিদ্যালয়ে গিয়ে দেখা যায়, আশ্রয়কারী কয়েক পরিবার একত্রিত হয়ে রান্নাবান্না করছে। খাবার ও পাতিল বিতরণ করেছে সেনাবাহিনী ও স্থানীয় প্রশাসন। কয়েকজনকে দেখা গেল বিমর্ষ মুখে বসে আছেন। ভবিষ্যৎ নিয়ে উদ্বিগ্ন তাঁরা।
এই আশ্রয়কেন্দ্রে এখন শিশুসহ অন্তত ২০০ জন নারী-পুরুষ আছেন। রুমা উপজেলা সদরের বম কমিউনিটি সেন্টারে আশ্রয় নিয়েছেন ২০ পরিবারের ৭০ জন নারী-পুরুষ ও শিশু। তাঁদেরই একজন অমিয় খিয়াং বলেন, ‘সরকার আমাদের তিনবেলা খাবার দিচ্ছে। আর্মিও (সেনাবাহিনী) খাবার দিয়ে সহযোগিতা করছে। কিন্তু আমরা শান্তি চাই। নিরাপদে বাড়ি ফিরতে চাই।’ তিনি বলেন, এক সঙ্গে অনেক মানুষ এখানে। গোসল ও বাথরুমে খুব সমস্যা হচ্ছে।
রোয়াংছড়ি উপজেলা পরিষদ চেয়ারম্যান চহাই মং মার্মা বলেন, এখানে আশ্রয় নেওয়া মানুষের মধ্যে এখনও আতঙ্ক বিরাজ করছে। তাঁরা এই মুহূর্তে বাড়ি ফিরে যেতে চাচ্ছেন না। পরিস্থিতি আরও শান্ত ও স্বাভাবিক হলে প্রশাসনের মাধ্যমে ফিরতে চান তাঁরা।
বৃহস্পতিবার রাতের গোলাগুলির ঘটনায় খামতাংপাড়ার লোকজনের একাংশ রোয়াংছড়িতে এবং কিছু লোক রুমা উপজেলা সদরে আশ্রয় নিয়েছেন বলে জানান উপজেলা চেয়ারম্যান উহ্লাচিং মার্মা। তিনি বলেন, খামতাংপাড়ায় গোলাগুলির ঘটনার পর কিছু মানুষ বম কমিউনিটি সেন্টারে আশ্রয় নিয়েছে। পরিষদের পক্ষ থেকে সহযোগিতা করার মতো কোনো তহবিল নেই। তবে স্থানীয় পর্যায়ে সহযোগিতার টাকা উত্তোলন করে তাঁদের খাবার-দাবারসহ অন্যান্য সামগ্রী দেওয়া হচ্ছে। তাঁদের খাবারের আপাতত কোনো সংকট নেই। এরপরও সহযোগিতার জন্য সরকারের কাছে আবেদন করা হয়েছে।
রুমা সদরে বম কমিউনিটি সেন্টারে আশ্রয় নেওয়া হোমতি খিয়াং বলেন, ‘জনপ্রতিনিধি, প্রশাসন, স্থানীয়রা আমাদের সহযোগিতা করছে। কিন্তু আমাদের মনে এখনও আতঙ্ক। এই আশ্রয়কেন্দ্রে এসেও মনে শান্তি নেই। ভালো ঘুম হচ্ছে না। বাড়িতে ফেলে আসা গরু-ছাগলগুলো নিয়ে দুশ্চিন্তায় আছি। বাড়ির কথা মনে উঠলে মন কাঁদে।’
রোয়াংছড়ির ইউএনও খোরশেদ আলম চৌধুরী জানান, গোলাগুলির ঘটনার পর সেনাবাহিনী ও পুলিশ নিরাপত্তা জোরদার করেছে।
লাশ গ্রহণ বম সোশ্যাল কাউন্সিলের: আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর ভাষ্য, পাহাড়ের দুই সশস্ত্র গ্রুপ কুকি-চিন ন্যাশনাল ফ্রন্ট (কেএনএফ) ও ইউনাইটেড পিপলস ডেমোক্রেটিক ফ্রন্টের (ইউপিডিএফ-গণতান্ত্রিক) মধ্যে বৃহস্পতিবার রাতে গুলি বিনিময়ের ঘটনা ঘটে। এতে কেএনএফের আট সদস্য নিহত হয়। শুক্রবার দুপুরে মরদেহ উদ্ধার করে পুলিশ।
শনিবার দুপুরে জেলা সদর হাসপাতালে মরদেহ হস্তান্তরের সময় ছিলেন রোয়াংছড়ি থানার এসআই জীবন। তিনি বম সোশ্যাল কাউন্সিলের সভাপতি লাল জার বমের কাছে মরদেহ হস্তান্তর করেন। এসআই জীবন বলেন, নিহতদের কোনো আত্মীয়স্বজন না পাওয়ায় লাশ বম সোশ্যাল কাউন্সিলের কাছে হস্তান্তর করা হয়েছে। মরদেহ হস্তান্তরের সময় হাসপাতাল মর্গের কাছে আরও কয়েকজন নারী-পুরুষকে দেখা গেছে। তাদের কাছ থেকে জানার চেষ্টা করা হয়েছে তাঁরা নিহতদের আত্মীয়স্বজন কিনা। তাঁরা কোনো উত্তর দেননি। তবে মর্গ থেকে লাশ চাঁদের গাড়িতে করে নিয়ে যাওয়ার সময় দু’জনকে অঝোরে কাঁদতে দেখা যায়।
লাল জার বম বলেন, যাঁরা কান্না করছেন, তাঁদের পরিচয় জানা নেই। তবে নিহতদের কোনো আত্মীয়স্বজন আসেননি বলে মনে হচ্ছে। তাই সব লাশ বম সোশ্যাল কাউন্সিলের পক্ষ থেকে গ্রহণ করা হয়েছে। ছয়টি মরদেহ জুরভারংপাড়ায় পাঠানো হবে। আর দুটি পাঠানো হবে রোয়াংছড়ি উপজেলার রনিনপাড়া ও পানখিয়াংপাড়ায়।
নিহতদের পরিচয়: পুলিশ নিশ্চিত না করলেও শনিবার বম সোশ্যাল কাউন্সিলের পক্ষ থেকে নিহতদের পরিচয় জানানো হয়েছে। নিহতরা হলেন কাঁচামাল ব্যবসায়ী ভান লাল দুহ বম ওরফে ভান দুহ, জুমচাষি সাং খুম লিয়ান বম ওরপে আবেই, কলেজপড়ুয়া সান পির থাং বম ও বয়রেম বম, জুমচাষি লাল লিয়ান ঙাক বম, সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের অফিস সহায়ক লাল ঠা জার বম; তাঁরা রুমা উপজেলার জুরভারংপাড়ার বাসিন্দা। অন্যদিকে রোয়াংছড়ি উপজেলার রয়েছেন কাঁচামাল ব্যবসায়ী পানখিয়াংপাড়ার জাহিম বম ও রনিনপাড়ায় জৌ বম।
তবে রোয়াংছড়ি থানার ওসি আবদুল মান্নান বলেন, নিহতদের নাম-পরিচয় এখনও পাওয়া যায়নি। এই বিষয়ে নিশ্চিত হতে পুলিশ কাজ করছে। অপেক্ষা করা হচ্ছে কেউ মামলা করতে আসে কিনা; কেউ না এলে পুলিশ মামলা করার উদ্যোগ নেবে।
আরো পড়ুন : ভোলাহাটে বিএনপি’র অবস্থান কর্মসূচি