বরিশাল রেস্টুরেন্টের ভিতর কাঠের পাটাতন দিয়ে তৈরি মুরগির খুপরি টাইপের ঘরের মধ্যে হোটেল কর্মচারীরা ঘুমাতেন। ঘরটির উচ্চতা চার ফুট। মাথা নিচু করে ঢুকতে হয়। পাশাপাশি ৬ জন কর্মচারি ঘুমিয়ে ছিলেন। এর আগে রবিবার রাত থেকে পরদিন সোমবার সকাল ৮ টা পর্যন্ত তারা রেস্টুরেন্টে ডিউটি করে মুরগির খুপরিতে ঘুমাতে যান। বেলা ১২ টার দিকে অগ্নিকাণ্ডের সময় তারা ঘুমিয়ে ছিলেন। খুপরি টাইপের ঘর থেকে তারা বের হওয়ার সময়ই পাননি। সেখানেই পুড়ে মারা যান। সেই ছয় কর্মচারীর মৃতদেহের গতকাল মঙ্গলবার বিকালে স্যার সলিমুল্লাহ মেডিক্যাল কলেজ (মিটফোর্ড) হাসপাতালের ফরেনসিক বিভাগে ময়নাতদন্ত সম্পন্ন হয়েছে। ময়নাতদন্ত শেষে স্বজনদের কাছে লাশ হস্তান্তর করা হয়েছে।
এদিকে, অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় নিহত রুবেলে বড় ভাই মো. আলী বাদী হয়ে ভবন মালিক রানা ও হোটেলের মালিক ফখর উদ্দিনকে আসামী করে চকবাজার থানায় একটি মামলা দায়ের করেছেন। তবে মামলায় ভবনের চার তলায় অবস্থিত ‘ঢাকা প্লাস্টিক’ কারখানার মালিক নজরুল ইসলামকে আসামী করা হয়নি। মঙ্গলবার সকালে পুলিশ বরিশাল রেস্টুরেন্টের মালিক ফখর উদ্দিনকে গ্রেফতার করে। দুপুরে তাকে ৭ দিনের রিমান্ডের আবেদন জানিয়ে আদালতে পাঠায় পুলিশ। আদালত রিমান্ড শুনানি শেষে ১ দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেন।
এদিকে, নিহতদের পরিবারকে সরকারের পক্ষ থেকে ২ লাখ টাকা সহায়তা দেওয়া হয়েছে। অগ্নিকাণ্ডের পর থেকে চারতলা ভবনটির মালিক রানা পলাতক রয়েছেন। প্লাস্টিক কারখানার মালিক নজরুল ইসলাম গা ঢাকা দিয়েছেন। গতকাল পর্যন্ত তাদেরকে আটক করা যায়নি।
নিচতলার হোটেল থেকেই আগুনের সূত্রপাত
ফায়ার সার্ভিসের প্রাথমিক তদন্তে ওই ভবনের নিচতলার বরিশাল রেস্টুরেন্টে রান্নার কাজে ব্যবহৃত গ্যাস থেকেই অগ্নিকাণ্ডের সূত্রপাত হয়েছে বলে মনে হয়েছে। গতকাল ফায়ার সার্ভিসের তদন্তকারী একটি টিম ঘটনাস্থল পরিদর্শন করে। বরিশাল রেস্টুরেন্টের প্রবেশ মুখেই ডান পাশে রান্নার চুল্লি। পাইপ লাইনের গ্যাসের মাধ্যমে এই হোটেলের রান্নার কাজ চলত। চুলার চেম্বারের পাশেই হোটেলের দেয়াল ঘেঁষে গ্যাসের রাইজার ও গ্যাসলাইন। সেখান থেকে ঝুঁকিপূর্ণ উপায়ে প্লাস্টিক পাইপের মাধ্যমে হোটেলের আরেকটি চুলায় গ্যাসের সংযোগ দেয়া হয়েছে। দুর্ঘটনার পর ওই চুলার বার্নারটি খুলে রাস্তায় পড়ে ছিল আর এই বার্নারের গোড়াতেই প্লাস্টিক পাইপ ঝুলতে দেখা যায়। হোটেলটির ঠিক ওপরেই কাঠের পাটাতন দিয়ে তৈরি করা হয়েছে ছাদ। ছাদের ওপরে কর্মীদের থাকার ব্যবস্থা ছিল। হোটেলের পেছনে আলাদা সিঁড়ি ব্যবহার করে কর্মীরা ওই ঘরে যাতায়াত করতেন। আর দুই শিফটে কাজ করে পালাক্রমে কর্মীরা সেখানে ঘুমাতেন।
লাশ স্বজনদের কাছে হস্তান্তর
প্লাস্টিক কারখানা ও রেস্টুরেন্টে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় নিহত বরিশাল রেস্টুরেন্টের ৬ কর্মীর লাশের ময়নাতদন্ত শেষে স্বজনদের কাছে হস্তান্তর করা হয়েছে। তারা হলেন, ওহাব আলী ওসমান (২৫), বেলাল সরদার (৩৫), স্বপন সরকার (১৮), মোতালেব (১৬), শরীফ (১৬) ও রুবেল (২৮)। মর্গে স্বজনদের অপেক্ষা আর কান্নায় এক শোকের ছায়া নেমে আসে। ওহাব আলী ওসমানের লাশ গ্রহণ করেন তার ভাই সোহরাব হোসেন। তিনি বলেন, আমার ভাইয়ের মৃত্যুর পেছনে হোটেল মালিক ও ভবনের মালিকের অবহেলা রয়েছে। এটা একটা হত্যাকাণ্ড। হোটেলের ভিতরে কাঠের পাটাতন দিয়ে তৈরি করা ঘরে কর্মচারীদের থাকতে দেওয়া হয়, এটা অমানবিক। ভবন মালিক অনুমোদন দেওয়ায় তিনিও দায় এড়াতে পারেন না।
স্যার সলিমুল্লাহ মেডিক্যাল কলেজ মর্গের (মিটফোর্ড হাসপাতাল) ফরেনসিক বিভাগের প্রভাষক ডা. ওমর ফারুকের নেতৃত্বে একটি দল ময়নাতদন্ত করেন। ময়নাতদন্তকারী চিকিৎসক ডা. ওমর ফারুক বলেন, মরদেহগুলো থেকে ডিএনএ নমুনা সংগ্রহ করা হয়েছে। এই নমুনাগুলো সিআইডির ফরেনসিক টিমকে দেওয়া হয়েছে।
থানায় মামলা, হোটেল মালিক রিমান্ডে
প্লাস্টিক কারখানায় অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় মামলা করেছে ভুক্তভোগী এক স্বজনের পরিবার। সোমবার রাতে নিহত রুবেলের বড় ভাই মোহাম্মদ আলী বাদী হয়ে চকবাজার থানায় মামলা করেন। মঙ্গলবার সকালে অভিযান চালিয়ে বরিশাল রেস্টুরেন্টের মালিক ফখরুদ্দিনকে গ্রেফতার করে পুলিশ। তাকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য একদিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেছেন আদালত। চকবাজার থানার ওসি আব্দুল কাইয়ুম বলেন, সোমবার রাতের মামলার পরিপ্রেক্ষিতে মঙ্গলবার সকালে অভিযান চালিয়ে বরিশাল রেস্টুরেন্টের মালিক ফখরুদ্দিনকে গ্রেফতার করা হয়েছে। তাকে ১ দিনের রিমান্ডে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করা হচ্ছে।
আদালত সূত্রে জানা গেছে, দুপুরে তাকে আদালতে হাজির করে সাত দিনের রিমান্ড আবেদন করেন মামলার তদন্ত কর্মকর্তা চকবাজার থানার এসআই রাজীব কুমার সরকার। আসামিপক্ষে আইনজীবী রিমান্ড বাতিল পূর্বক জামিন আবেদন করেন। শুনানি শেষে ঢাকার মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট মোহাম্মদ জসীম এক দিনের রিমান্ডের আদেশ দেন।
ভবন ও কারখানা মালিকের হদিস নেই
পুলিশ জানায়, ৩০, দেবিদাস ঘাট লেনের চারতলা ভবনের মালিক ৩১, রহমতগঞ্জ নিবাসী মোঃ আলম। আলমের মৃত্যুর পর তার বড় ছেলে রানা ওই ভবনটি দেখাশুনা করেন। দলিলপত্রে ভবনটির মালিক মোঃ আলম। চার তলা ভবনের চতুর্থ তলা টিনশেড ঘর। দোতালা থেকে চার তলা পর্যন্ত টিন দিয়ে দেয়াল দেয়া। চতুর্থ তলার টিনশেড ঘরে ঢাকা প্লাস্টিক নামের কারখানা ও গোডাউন ভাড়া দেওয়া রয়েছে। সেখানে পলিথিন ও প্লাস্টিকের খেলনা তৈরি করা হয়। নিচতলায় বরিশাল রেস্টুরেন্টের ভিতরে ফলস সিলিংয়ের সঙ্গে কাঠের পাটাতন দিয়ে মুরগির খুপরি টাইপের ঘর নির্মাণ করেন রেস্টুরেন্ট মালিক ফখর উদ্দিন। ওই খুপরি ঘরে রেস্টুরেন্টের কর্মচারীরা পালাক্রমে ঘুমাতেন। দোতালা, তিন তলা ও চার তলা দীর্ঘ দিন ধরে ভাড়া নিয়ে প্লাস্টিক কারখানা ও গোডাউনের কার্যক্রম পরিচালনা করে আসছিলেন নজরুল ইসলাম। দুর্ঘটনার পর থেকে রানা ও নজরুল ইসলামের হদিস নেই।
জড়িতদের আইনের আওতায় আনতে চেষ্টা চলছে
অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় রেস্টুরেন্টের মালিক ফখর উদ্দিনকে গ্রেপ্তার করার তথ্য জানিয়ে পুলিশের লালবাগ বিভাগের উপ-পুলিশ কমিশনার জাফর আহমেদ বলেন, অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় কারো গাফলতি ছিল বা কী কারণে আগুন লেগেছে সেটি খতিয়ে দেখা হচ্ছে। এ ঘটনায় যারা জড়িত থাকবেন, তাদের আইনের আওতায় আনা হবে। বারবার পুরান ঢাকায় অগ্নিকাণ্ডের ঘটনার সমাধানে পুলিশের উদ্যোগ জানতে চাইলে তিনি বলেন, এ সমস্যা সমাধানে সব সংস্থাকে কাজ করতে হবে। সবাই মিলে কাজ করলে এ ধরনের সমস্যার সমাধান করা যাবে।
নিহতদের পরিবারকে ২ লাখ টাকা সহায়তা
আগুনের ঘটনায় নিহত ছয়জনের পরিবারকে দুই লাখ টাকা করে সহায়তা দেওয়ার ঘোষণা দিয়েছেন শ্রম ও কর্মসংস্থান প্রতিমন্ত্রী মন্নুজান সুফিয়ান। মঙ্গলবার শ্রম মন্ত্রণালয়ের জনসংযোগ কর্মকর্তা আকতারুল আসলাম এ তথ্য জানান। তিনি বলেন, চকবাজারের অগ্নিকাণ্ডে হতাহতের ঘটনায় শ্রম প্রতিমন্ত্রীর শোক প্রকাশ ও নিহতদের প্রত্যেক পরিবারকে দুই লাখ টাকা করে সহায়তা দেওয়ার ঘোষণা করা হয়েছে। অপরদিকে, দুপুরে ঢাকা জেলা প্রশাসক শহীদুল ইসলাম স্যার সলিমুল্লাহ মেডিকেল কলেজ মর্গে লাশ হস্তান্তরের সময় স্বজনদের সঙ্গে কথা বলেন। তিনি নিহত প্রত্যেক পরিবারকে জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে ২৫ হাজার টাকা প্রদান করেন।
দায়ীদের শাস্তি দাবি
চকবাজারের অগ্নিকাণ্ডে হতাহতের ঘটনায় দায়ীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির দাবি জানিয়েছেন ন্যাপ চেয়ারম্যান জেবেল রহমান গানি ও মহাসচিব এম গোলাম মোস্তফা ভুইয়া। মঙ্গলবার গণমাধ্যমে পাঠানো এক বিবৃতিতে তারা এ দাবি জানান। নেতারা বলেন, সরকারের পক্ষ থেকে কোন শাস্তিমূলক ব্যবস্থা না নেওয়ায় বার বার এ ধরনের অগ্নিকাণ্ড ও মৃত্যুর ঘটনা ঘটেই চলছে।
প্রসঙ্গত, সোমবার বেলা ১২টার দিকে চকবাজারের দেবিদাস ঘাট লেনে চার তলা ভবনে অগ্নিকাণ্ডে ৬ জন হোটেল কর্মী আগুনে নিহত হন।
আরো পড়ুন : বিরামপুরে লিচু বাগান থেকে যুবকের লাশ উদ্ধার