রাজধানীতে হঠাৎ বেপরোয়া হয়ে উঠেছে সন্ত্রাসী ও ছিনতাইকারীরা। চলতি বছরের প্রথম ৮৫ দিনে ৩৪ জন খুন হয়েছেন। গত বৃহস্পতিবার রাতে শাহজাহানপুরে ব্যস্ত সড়কে এক আওয়ামী লীগ নেতাকে গুলি করে হত্যার তিন দিন পর রবিবার ভোরে মিরপুরের শেওড়াপাড়ায় দুর্বৃত্তের ছুরিকাঘাতে এক দন্ত চিকিৎসক নিহত হন। এসব ঘটনায় সাধারণ মানুষের মধ্যে উদ্বেগ ও আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়েছে।
নৃশংস হত্যার পাশাপাশি নারী নির্যাতন, ধর্ষণ, অপহরণ, মাদক কারবার, অজ্ঞান পার্টির দৌরাত্ম্য বাড়ছে।
খুনের ঘটনার তথ্য-উপাত্ত বিশ্লেষণ করে পুলিশ জানায়, ব্যক্তিগত বিরোধ, পারিবারিক কলহ, আর্থিক লেনদেন, মাদক, সামাজিক আধিপত্য নিয়ে বিরোধ, জমিজমা দখল এবং কোথাও কোথাও রাজনৈতিক কারণে এসব হত্যাকাণ্ড ঘটেছে।
প্রতিটি খুনের ঘটনায় সংশ্লিষ্ট থানায় মামলা করা হয়। চাঞ্চল্যকর কিছু হত্যার রহস্য উদঘাটন করেছে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনী। তবে একাধিক মানবাধিকারকর্মী বলেছেন, বেশির ভাগ ঘটনায় অপরাধীরা ধরা না পড়ায় উদ্বেগ-উত্কণ্ঠা দেখা যাচ্ছে।
অপরাধ ও সমাজ বিশ্লেষকরা বলছেন, শুধু সামাজিক, পারিবারিক, রাজনৈতিক ও ব্যক্তিগত বিরোধে খুনখারাবি ঘটছে, তা বলা যাবে না। আইন-শৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনীর গাফিলতিও কিছুটা দায়ী। আছে বিচারের দীর্ঘসূত্রতা। দেশে আইন থাকা সত্ত্বেও এর সঠিক প্রয়োগ নেই। এতে অপরাধ করেও আইনের ফাঁকফোকর দিয়ে পার পেয়ে যাচ্ছে অপরাধীরা।
অপরাধ বৃদ্ধির কারণ জানতে চাইলে পুলিশের একাধিক কর্মকর্তা বলেন, এত দিন করোনার কারণে রাস্তায় মানুষের উপস্থিতি কম ছিল। এখন পরিস্থিতি স্বাভাবিক হওয়ায় মানুষের ব্যস্ততা বাড়ছে। মাদকসেবীর সংখ্যা বেড়েছে। রাজনৈতিক ও স্বার্থসংশ্লিষ্ট দ্বন্দ্বও রয়েছে। এসব কারণে অপরাধ কিছুটা বাড়ছে।
ডিএমপি সদর দপ্তরের এক কর্মকর্তা কালের কণ্ঠকে বলেন, রাজধানীতে আগে থেকে প্রতি মাসে ১২-১৩টি খুন হচ্ছে। এখনো একইভাবে খুন হচ্ছে। তবে এখন অপরাধের ধরন কিছুটা পরিবর্তন হয়েছে। ব্যক্তিগত বিরোধে হত্যাকাণ্ড ঘটছে বেশি।
হঠাৎ অপরাধ বৃদ্ধির কারণ জানতে চাইলে ডিএমপি কমিশনার মুহা. শফিকুল ইসলাম কালের কণ্ঠকে বলেন, বিচ্ছিন্নভাবে কিছু খুনের ঘটনা ঘটছে। ছিনতাই কিছুটা বেড়েছে। তবে সব ধরনের অপরাধ নিয়ন্ত্রণে চেষ্টা চলছে।
ডিএমপির গত দুই মাস ২৭ দিনের তথ্য বলছে, রাজধানীতে খুনসহ ছিনতাই, দস্যুতা, চাঁদাবাজি, গাড়ি চুরির মতো অপরাধ বেড়েছে। ডিএমপির আওতাধীন ৫০ থানায় হওয়া মামলার তথ্য বিশ্লেষণ করে অপরাধের এমন চিত্র পাওয়া গেছে।
ডিএমপির মাসিক অপরাধচিত্রের প্রতিবেদন অনুযায়ী, রাজধানীতে চলতি বছরের গত দুই মাস জানুয়ারি ও ফেব্রুয়ারিতে খুনসহ নানা অপরাধে পাঁচ হাজার ২৩টি মামলা করা হয়েছে। এর মধ্যে ২১টি খুনের মামলা, সাতটি ডাকাতির, ২৬টি দস্যুতার, ২৬টি ছিনতাই ও চাঁদাবাজির, ধর্ষণসহ অন্যান্য নারী নির্যাতনের ৩১১টি মামলা, সাতটি অপহরণ, গাড়ি চুরিসহ অন্যান্য চুরির অভিযোগে ৩৪৫টি মামলা অন্যতম।
ডিএমপির তথ্যে জানা গেছে, চলতি বছরের জানুয়ারিতে ৯ জন এবং ফেব্রুয়ারিতে ১২ জন খুন হন। আর চলতি মাসের প্রথম ২৭ দিনে খুন হন ১৩ জন।
আলোচিত হত্যাকাণ্ড: সর্বশেষ গত রবিবার ভোরে দুর্বৃত্তরা মিরপুরের শেওড়াপাড়ায় বুলবুল হোসেন নামের এক দন্ত চিকিৎসককে ছুরিকাঘাত করে হত্যা করে। এর আগের দিন শনিবার সন্ধ্যায় সবুজবাগের বেগুনবাড়ীতে বাসায় ঢুকে শিশুসন্তানদের সামনে তানিয়া নামের এক গৃহবধূকে কুপিয়ে হত্যা করে দুর্বৃত্তরা। এর আগে গত বৃহস্পতিবার রাতে শাহজাহানপুরে ব্যস্ত সড়কে সন্ত্রাসীদের গুলিতে প্রাণ হারান মতিঝিল থানা আওয়ামী লীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক জাহিদুল ইসলাম টিপু ও কলেজছাত্রী সামিয়া আফরিন প্রীতি। এ ছাড়া সম্প্রতি দুর্বৃত্তদের ছুরিকাঘাতে ছয় পুলিশ সদস্য আহত হন।
রাজধানীতে লুটে বাধা দিলেই খুন: মালপত্র লুটের সময় বাধা পেলে খুন করছে দুর্বৃত্তরা। ২২ জানুয়ারি ভোরে রাজধানীর যাত্রাবাড়ীতে মেয়র হানিফ ফ্লাইওভারে মহির উদ্দিনকে (৫০) খুন করে দস্যুদল। এ ঘটনায় গ্রেপ্তার চারজনকে জিজ্ঞাসাবাদে পুলিশ জানতে পেরেছে, রাতের শেষ ভাগে লেগুনা গাড়ি নিয়ে যাত্রী তুলে এই চক্র যাত্রীদের সব কিছু ছিনিয়ে নেয়। এরপর চলন্ত গাড়ি থেকে ফেলে হত্যা করে।
সম্প্রতি হত্যাসহ নানা অপরাধ বৃদ্ধির কারণ সম্পর্কে মাওলানা ভাসানী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্রিমিনোলজি অ্যান্ড পুলিশ সায়েন্স বিভাগের অধ্যাপক মুহাম্মদ উমর ফারুক বলেন, বর্তমানে বেশির ভাগ মানুষ সামাজিক জীবনের মধ্যে নেই। অর্থনৈতিক ও ভোগবাদ জীবনের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। এ কারণে ব্যক্তি তাঁর ন্যূনতম চাহিদা পূরণে অপরাধমূলক কাজ করতেও দ্বিধাবোধ করছে না। এই জায়গায় কেউ ফোকাস করছে না।
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য ও সমাজবিজ্ঞানী অধ্যাপক ইফতেখার উদ্দিন চৌধুরী বলেন, অপরাধ বেড়ে যাওয়ার অন্যতম কারণ আইনের অপপ্রয়োগ।