চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের চারটি ওয়ার্ডে অন্তত ১২৩টি জন্ম নিবন্ধনের বিষয়ে কাউন্সিলর ও জন্ম নিবন্ধন কর্মকর্তারা কিছুই জানেন না। তাঁরা বলছেন, একটি চক্র সার্ভার হ্যাক করে এসব নিবন্ধন করেছে। ৬ থেকে ১৮ জানুয়ারির মধ্যে এসব ঘটনা ঘটেছে বলে ধারণা করা হচ্ছে। পৃথক চার থানায় সাধারণ ডায়েরি (জিডি) করা হয়েছে।
৩৮ নম্বর ওয়ার্ডের জন্ম ও মৃত্যু নিবন্ধন কর্মকর্তা সাইফ উদ্দিন অপু জানান, সাপ্তাহিক ছুটির কারণে ৬ ও ৭ জানুয়ারি অফিস বন্ধ ছিল। ৮ জানুয়ারি অফিসে গিয়ে দেখেন, তাঁর অ্যাকাউন্টে জন্ম ও মৃত্যু নিবন্ধন বাবদ যে বিল ছিল তার সঙ্গে আরো দুই হাজার টাকা যোগ হয়ে আছে। কারণ খুঁজতে গিয়ে দেখেন, দুই দিনের ছুটিতে নতুন করে ৪০টি জন্ম নিবন্ধন হয়েছে ওয়ার্ডের লগ ইনের বিপরীতে, যেগুলোর কোনো ডকুমেন্ট তাঁদের হাতে নেই। এমনকি এই নিবন্ধনে যে ঠিকানা ও সই ব্যবহার করা হয়েছে, সেগুলোর সঙ্গে এই কাউন্সিলর ও জন্ম নিবন্ধন কর্মকর্তার সইয়ের মিল নেই।
১০ জানুয়ারি ১১ নম্বর ওয়ার্ডে একই ধরনের ১৮টি জন্ম নিবন্ধনের অস্তিত্ব খুঁজে পান সেই অফিসের কর্মকর্তারা। সেদিনই হালিশহর থানায় জিডিসহ এসব নিবন্ধন ফরম বাতিলের জন্য সিটি করপোরেশনকে লিখিতভাবে জানান তাঁরা। এর মধ্যেই ১৮ জানুয়ারি এই ওয়ার্ডের লগ ইনের বিপরীতে আরো ৫০টি জন্ম নিবন্ধন হয়। এর আগে ১২ জানুয়ারি ১৩ নম্বর ওয়ার্ডে ১০টি জন্ম নিবন্ধন হয়। ১৪ জানুয়ারি ৩২ নম্বর ওয়ার্ডে একইভাবে চারটি জন্ম নিবন্ধন হয়।
৩৮ নম্বর ওয়ার্ড কাউন্সিলর গোলাম মোহাম্মদ চৌধুরী বলেন, ‘বিষয়টি নজরে আসার সঙ্গে সঙ্গে আমরা থানায় জিডি করেছি। এ ছাড়া চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের স্বাস্থ্য বিভাগ, চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসক এমনকি রেজিস্ট্রার জেনারেলকে চিঠি দিয়ে নিবন্ধন হওয়ার ফরমগুলো বাতিলের আবেদন করেছি।’
হালিশহর থানায় জিডির বিষয়টি উল্লেখ করে ১১ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর মোহাম্মদ ইসমাইল বলেন, ‘আমাদের ওয়ার্ডের লগ-ইনের বিপরীতে যেসব জন্ম নিবন্ধন হয়েছে, সেগুলোতে রাজশাহী, জামালপুরের ঠিকানা ব্যবহার করা হয়েছে। কিন্তু নিবন্ধন নম্বর ব্যবহার করা হয়েছে আমার ওয়ার্ডের।’
১৩ নম্বর ওয়ার্ড কাউন্সিলর মোহাম্মদ ওয়াসিম উদ্দিন চৌধুরী বলেন, ‘আমরা ১২ জানুয়ারি প্রথম এটি টের পেয়েছি। সঙ্গে সঙ্গে খুলশী থানায় জিডির পাশাপাশি সিটি করপোরেশন এবং জেলা প্রশাসনকে লিখিতভাবে জানিয়েছি। ঝামেলা এড়াতে আপাতত আমার ওয়ার্ডে সব ধরনের নিবন্ধন কার্যক্রম বন্ধ রেখেছি।’ তিনি বলেন, ‘এই ওয়ার্ডের বিপরীতে যেসব ভুয়া নিবন্ধন হয়েছে সেখানে উখিয়া, চকরিয়ার ঠিকানা ব্যবহার করা হয়েছে। এ কারণে হ্যাকারদের এমন কর্মকাণ্ডে রোহিঙ্গাদের এনআইডি ও পাসপোর্ট সংশ্লিষ্টতার আশঙ্কা করছি।’
৩২ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর জহর লাল হাজারী বলেন, ‘আমার ওয়ার্ডে গত ১৪ জানুয়ারি চার-পাঁচটি ভুয়া জন্ম নিবন্ধনের ঘটনা চিহ্নিত করা হয়েছে। এরই মধ্যে কোতোয়ালি থানায় জিডি করা হয়েছে।’
২০১৯ সালে রোহিঙ্গাদের এনআইডি জালিয়াতির ঘটনা ঘটে চট্টগ্রামে। সে সময় নির্বাচন কমিশন কর্মকর্তা, চট্টগ্রাম জেলা নির্বাচন অফিসের অফিস সহকারী ও আউটসোর্সিংয়ের লোকজনের জড়িত থাকার অভিযোগ ওঠে। সে সময় প্রায় ৫৫ হাজার রোহিঙ্গার এনআইডি তৈরি করে চক্রটি। সে ঘটনায় দুদক, কাউন্টার টেররিজম ও পুলিশের একাধিক মামলা এখনো চলমান।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, ২০০১ সালে হাতে লিখে প্রথম জন্ম নিবন্ধন শুরু হয়। ২০১০ সালে ইউনিসেফের সহযোগিতায় ডিজিটাল নিবন্ধন শুরু করা হয়। সেই সফটওয়্যার অকেজো উল্লেখ করে ২০১৯ সালে সরকার নতুন সফটওয়্যারে জন্ম নিবন্ধনের তথ্য সংরক্ষণ শুরু করে। ২০২১ সালে সফটওয়্যারের তথ্য আপডেট করতে গিয়ে অনেকের তথ্য হারিয়ে যায়। এখন ২০১৯ সালের সফটওয়্যারটিও হালনাগাদ করছে রেজিস্ট্রার জেনারেলের কার্যালয়। এর মধ্যে প্রতিনিয়তই সার্ভার জটিলতায় ভুগছেন সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা। দেশের বিভিন্ন স্থানে ভুয়া নিবন্ধনের ঘটনা ঘটছে।
রেজিস্ট্রার জেনারেল কার্যালয় বলছে, ২০১০ সালে ইউনিসেফের তৈরি পুরনো সফটওয়্যারে নিবন্ধন করা তথ্যে প্রায় ৫০ শতাংশ মতভেদ আছে। এটা দূর করার জন্যই নতুন সফটওয়্যার নেওয়া হয়। কিন্তু নতুন সফটওয়্যারে বেশির ভাগ সময় কাজ করা যাচ্ছে না। বেশ কয়েকটি ফিচার ঠিকভাবে কাজ করছে না। এ জন্য ফের নতুন সফটওয়্যারে কাজ করার পরিকল্পনা চলছে।
চট্টগ্রাম সিটির সচিব ও প্রধান নির্বাহী (ভারপ্রাপ্ত) খালেদ মাহমুদ বলেন, ‘এ পর্যন্ত চারটি ওয়ার্ড থেকে লিখিত অভিযোগ পেয়েছি। অভিযোগ পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে চিহ্নিত করা ফরমগুলো বাতিলের জন্য রেজিস্ট্রার জেনারেল অফিসে চিঠি দিয়েছি।’
সিটি করপোরেশনের প্রধান স্বাস্থ্য কর্মকর্তা ডা. সেলিম আকতার চৌধুরী বলেন, রোহিঙ্গাদের এনআইডি, পাসপোর্ট তৈরি ও মানবপাচারের সঙ্গে জড়িত একটি সংঘবদ্ধ চক্র জন্ম নিবন্ধন সার্ভার হ্যাকিংয়ের সঙ্গে জড়িত থাকতে পারে বলে ধারণা করা হচ্ছে।
স্পর্শকাতর বিষয় বিবেচনায় সিএমপির কাউন্টার টেররিজম এরই মধ্যে তদন্ত শুরু করেছে। বন্দর জোনের অতিরিক্ত উপপুলিশ কমিশনার (কাউন্টার টেররিজম) আসিফ মহিউদ্দীন বলেন, ‘আমরা এরই মধ্যে ১৩ ও ৩৮ নম্বর ওয়ার্ডের জন্ম নিবন্ধন সার্ভার হ্যাকের তথ্যগুলো নিয়ে কাজ শুরু করছি। এখনো মামলা না হলেও স্পর্শকাতর ইস্যু হওয়ার জিডি ধরে কাজ করতে পারে কাউন্টার টেররিজম।’
চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসক আবুল বাসার মোহাম্মদ ফখরুজ্জামান কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘জানতে পেরেছি কিছু জন্ম নিবন্ধন বাতিল করার জন্য চিঠি দেওয়া হয়েছে। আমরা যাচাই করে দেখছি, কেন এমন ঘটনা ঘটেছে। আমাদের কেউ জড়িত আছে কি না সেটাও যাচাই করে দেখব।’
জানতে চাইলে রেজিস্ট্রার জেনারেল মো. রাশেদুল হাসান গতকাল শনিবার কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘আজ (গতকাল) চট্টগ্রামে এসংক্রান্ত একটি মামলা করা হয়েছে। এরই মধ্যে আমরা সার্ভারের নিরাপত্তা জোরদারে ব্যবস্থা নিয়েছি। আর যেগুলো বাতিলের আবেদন এসেছে, সেগুলোর সফটকপি পাওয়া সাপেক্ষে বাতিল করা হবে।’ এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘মূলত আর্থিক সুবিধা নেওয়ার জন্য একটি অসাধু চক্র এমন কর্মকাণ্ড চালিয়ে যাচ্ছে। চক্রটি চিহ্নিত করা গেলে জিজ্ঞাসাবাদে আসল রহস্য বেরিয়ে আসবে।’
আরো পড়ুন : ৯৩ বয়সে চতুর্থ বিয়ে করলেন চাঁদের বুকে ১৯ মিনিট হাটা নভোচারী বাজ অলড্রিন