পঁয়ত্রিশ বছর আগে নানা রিজু শেখের বাড়িতে তার জন্ম। বাগেরহাটের মোল্লাহাটেই কেটেছে শৈশব। শৈশবেই নানা বাড়ি ছেড়ে ওঠেন চিতলমারীর ভাড়া বাসায়। বাবা ফেরি করে হাঁড়ি-পাতিল বিক্রি করতেন। অভাব অনটনের সংসার চালানো মা, খালা আর মামারা নানা জাল জালিয়াতি করে চলতেন। তা দেখেই অপরাধের হাতেখড়ি রবিউল ইসলাম ওরফে সোহাগ মোল্লার। মোল্লার হাটে জন্ম নেয়া এই রবিউল বা সোহাগই এখন দুবাইয়ের নিউ গোল্ড সুকের স্বর্ণের দোকানি আরাভ খান। বাগেরহাট থেকে দুবাইয়ের অভিজাত গোল্ড মার্কেটে ব্যবসায়ী হয়ে ওঠা আরাভের পুরো পথটা ছিল নানা অপরাধ আর অনিয়মের ভরা। বলতে গেলে অপরাধের সিঁড়ি বেয়েই এ পর্যন্ত উঠেছেন। সরজমিন বাগেরহাটের মোল্লাহাট ও চিতলমারি ও গোপালগঞ্জ ঘুরে জানা গেছে তার বেড়ে ওঠার নানা চমকপ্রদ তথ্য।
আরাভের বাবার গ্রামের বাড়ি গোপালগঞ্জের কোটালীপাড়ার আশুতিয়া গ্রামে।
বাবা মতিউর রহমান মোল্লা জীবিকার তাগিদে হাঁড়ি-পাতিল কাঁধে করে ফেরি করতেন। টানাপড়েনের সংসার ছিল তাদের। তিন ভাই-বোনের মধ্যে আরাভ বড়। অভাবের সংসারে বেড়ে উঠলেও তার বেশভূষা ও চলাফেরা ছিল উচ্চাবিলাসী।
কৌশলে সখ্যতা গড়তেন প্রভাবশালীদের সঙ্গে। তার মামা-খালা ও মা মিলে করতেন জাল টাকার ব্যবসা। বড় অঙ্কের অর্থ হাতিয়ে নিয়ে মানুষকে ফেলতেন ফাঁদে। বাড়িতে বসাতেন গানের আসর। সেইসঙ্গে ফাঁদ পাততেন কবিরাজির। মানুষের কাছ থেকে মোটা অঙ্কের টাকা ধার নিতেন। পরবর্তীতে তাদের জাল টাকা দিয়ে দেনা পরিশোধ করতেন। জাল টাকা বুঝতে পেয়ে কেউ কেউ টাকা ফেরত চাইলে তাদের দেয়া হতো হুমকি।
শিশু বয়সেই আরাভকে নিয়ে পরিবার বাগেরহাটের চিতলমারীতে চলে যায়। সেখানে একটি স্কুলে ভর্তি করা হয় আরাভকে। স্কুলে ভর্তি হলেও পড়াশোনায় মন ছিল না তার।
২০০৬ সালে নানার এলাকায় ইয়াসমিন সুলতানা রুমা নামে একজনকে বিয়ে করেন আরাভ। তার কোলজুড়ে আসে একটি পুত্র সন্তান। কিছুদিন ঠিকভাবে সংসার করলেও পরে আরাভ বেপরোয়া আচরণ শুরু করেন। টার্গেট করতে থাকেন উচ্চবিত্ত ঘরের নারীদের। উচ্চবিত্ত ঘরের ছেলের পরিচয় দিয়ে বিয়ে করেন একাধিক। বিয়ের পরে ওই নারীদের কাছ থেকে হাতিয়ে নিতেন সর্বস্ব। পরবর্তীতে বন্ধ করে দিতেন যোগাযোগ। এসব কর্মকাণ্ডে দফায় দফায় মামলাও হয়েছে তার বিরুদ্ধে। বিয়ে করে প্রতারণা করেছেন এমন অন্তত ১৫টি অভিযোগ পাওয়ার কথা জানিয়েছেন স্থানীয় ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান।
চাকরির প্রলোভন দেখিয়ে হাতিয়ে নিতেন টাকা। এমন নানা প্রতারণার ঘটনা ঘটিয়ে একপর্যায়ে চলে আসেন ঢাকায়। ঢাকায় এসেও অপরাধ জগতেই গড়ে তোলেন সখ্যতা।
স্থানীয়রা জানায়, গ্রাম ও ঢাকা শহরসহ বিভিন্ন জায়গায় বিত্তশালী এবং ধনীর সন্তানদের টার্গেট করে বন্ধুত্ব করতেন আরাভ। একপর্যায়ে তাদের মোটরসাইকেলসহ অন্য জিনিসপত্র হাতিয়ে নিয়ে লাপাত্তা হতেন। এমন ঘটনা ঘটিয়ে কয়েকবার গ্রামেও গিয়েছিলেন গাঢাকা দিতে। ঢাকায় আসার শুরুতে এক বিদেশি নারীর সঙ্গে সম্পর্ক হয়। এক সময় নাইট বারেও চাকরি করতেন। সেখানে তিনি নারীদের নিয়ে যেতেন।
গোপালগঞ্জ ও বাগেরহাটে আরাভের বাবা ও নানার বাড়ির সরজমিন গিয়ে দেখা যায়, তার গ্রামের বাড়ি আশুতিয়ায় ছোট একটি সেমি পাকা টিনশেড ঘর। ঘরটি তালাবদ্ধ। এলাকাজুড়ে চলছে মানুষের নানা আলোচনা-সমালোচনা। একজন ফেরিওয়ালার ছেলে হয়ে কীভাবে রাতারাতি কোটিপতি বনে গেলেন আরাভ তা নিয়ে কৌতূহল মানুষের।
তার এই উত্থান অনেকের কাছে মনে হচ্ছে বিস্ময়কর। প্রতিবেশীরা জানান, দুবাইয়ে স্বর্ণের দোকান উদ্বোধনের আগেই একমাত্র ছেলে, বাবা-মা এবং দুই বোনকে সেখানে নিয়ে যান আরাভ। এদিকে তার নানাবাড়িও অনেকটা লোকশূন্য। তার মামাও এখন দুবাইয়ে।
গোপালগঞ্জ শহরে বাসা ভাড়া নিয়েও আরাভ নানা প্রতারণামূলক কর্মকাণ্ড করেছেন। ছেলে স্বপ্নের ১১ দিন বয়সের সময় আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর এক কর্মকর্তার মেয়েকে পটিয়ে উধাও হয়েছিলেন আরাভ। পরে চাপে পড়ে ওই মেয়েকে বের করে দেন।
আরাভের ছোট চাচি রাফিজা বলেন, ওরা চিতলমারীতে বেশি থাকতো। এরপর ঢাকা চলে যায়। এরপর প্রতি বছর গ্রামে এসে তিন-চারটা গরু কোরবানি দিতো। আগে ওদের পরিবার অসচ্ছল ছিল। শেষ পাঁচ বছরে আর বাড়িতে আসেনি। আশেপাশে থেকে ঘুরে গিয়েছে। আমরাও এতকিছু জানতাম না। আরাভের দাদার নাম ইয়াকুব মোল্লা। বাবা-মা মাঝে মাঝে ঢাকায় থাকে আবার গ্রামেও আসে। এদের পরিবারের সবাই এখন দুবাই গেছে।
আরাভের বড় চাচা হায়দার আলী মোল্লা বলেন, বহু আগে আরাভ ঢাকায় থাকতো। লোকের মুখে শুনেছি তখন সে বিছানার নিচে টাকা বিছিয়ে ঘুমাতো। সে বাড়িঘরে তেমন থাকেনি। সে খারাপ হতে পারে কিন্তু মানুষের সঙ্গে খুব ভালো ব্যবহার করতো। কিন্তু সে কোথায় কি করতো সেটা আমরা জানতাম না। শুধু ব্যবসা-বাণিজ্য করে এতটুকু জানতাম। এলাকায় তো সে ভালোভাবে ঘুরতো। সে আট বছর আগে যখন গ্রামে আসতো তখন ১০০ মোটরসাইকেল নিয়ে এলাকায় চক্কর দিতো। সে এই পর্যায়ে এসেছে আমরা সেটি জানতাম না। স্বর্ণের দোকান উদ্বোধনের পরে জানতে পারি। বাড়িতে কখনো আসলে কিছু সময় থেকে চলে যেতো। সে গ্রামে আসতো দান-সদকা করতো এটা শুধু দেখতাম। সে ঢাকায় কি করছে না করছে এটা জানার কোনো ইচ্ছা ছিল না। শুনেছি আগের স্ত্রীকে ছেড়ে দিয়ে আবার ঢাকায় বিয়ে করে। ঢাকায় একটা মার্ডার কেসের মামলা আছে এটা জানি। আরাভ এই পর্যায়ে কীভাবে এসেছে, এত টাকার মালিক কীভাবে হলো সেটি যদি আমাদের না বলে তাহলে কি আমরা জিজ্ঞেস করতে পারি? সে ঢাকায় বড় বড় রাজনৈতিক নেতাদের সঙ্গে ঘুরতো। খুলনা এলাকার একজন বড় নেতার সঙ্গেও তার ভালো সম্পর্ক ছিল।
আরাভের মামি বলেন, বাড়িতে কেউ নেই। দুই ছেলে আর আমি আছি। আমার স্বামী দুই মাস ধরে দুবাই আছেন। আরাভের অফিসে ঝামেলা হইছে। এখন সে ঝামেলায় পড়ছে তার একটা একটা করে বউ বেরোচ্ছে। কাজের সুবাধে বিভিন্ন জেলায় থাকার পর সে ঢাকায় চলে যায়। ওদের গ্রামের বাড়িতে খুব একটা থাকেনি। সংসারে সচ্ছলতা আনতে ঢাকা গিয়ে ঘুরতে ঘুরতে এফডিসিতে চাকরি নেয়। তারপর কয়েক বছর পর ভারতে চলে যায়। সেখান থেকে যায় দুবাই।
মোল্লারহাটের আড়–য়াডেহি ৯ নম্বর ওয়ার্ডের সদস্য মারুফ মোল্লা বলেন, তার বাবা ভাঙাড়ি ব্যবসা করতো। এরমধ্যে পরিবারের সবাই ঢাকা থাকতো। পনেরো বছর আগে চিতলমারী এসএম স্কুলে পড়তো। সে এসএসসি পাস করেনি। এখানের মানুষ খুব একটা জানতো না। তার মামা মিলন মাদ্রাসায় পড়তো। ২০১৮ সালে আমার প্রতিদ্বন্দ্বী হয়ে নির্বাচন করেছে। তাদের চলাফেরা, জীবন-যাপন অনেকটা বদলে গিয়েছে। উদ্বোধনের আগে আমরা জানতাম না। উদ্বোধনকে ঘিরে আমরা সবাই এসব জানতে পারি। রবিউল প্রথম যে মেয়েকে বিয়ে করে তার সঙ্গে ডিভোর্স হয় অনেক আগে।
চিতলমারীতে থাকাকালীন সময়ে রুহুলের সঙ্গে বন্ধুত্ব হয় আরাভের। তিনি বলেন, এখানে থাকার পর সে ঢাকায় চলে যায়। মানুষের সঙ্গে অনেক মিশতো। অনেক সাহসী ছেলে ছিল আরাভ তবে কিছুটা উচ্ছৃঙ্খল ছিল। তখন আমাদের বয়স দশ-বারো বছর ছিল। এই বয়সে এমন থাকাটা স্বাভাবিক ছিল। আগে তো ভালো ছিল পরে কি হয়েছে এটা জানি না। একসময়ে সে টুঙ্গিপাড়া যেতো এক নেতার কাছে। সে একাই চলে যেতো তার কাছে। দেখতাম বড় বড় নেতাকর্মীদের সঙ্গে চলাফেরা করতো।
হিরণ ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান মাজহারুল আলম পান্না বলেন, আরাভের বিরুদ্ধে একাধিক মামলায় তার মা এবং দুই বোনকেও আসামি করা হয়। তার ১৫টিরও বেশি বিয়ের তথ্য আমরা জেনেছি। স্থানীয়ভাবে প্রায় ৫-৭ জন নারী বিয়ের অভিযোগ এনে নালিশ করলে সেটা আমি মীমাংসা করে দেই।
উল্লেখ্য, ২০১৮ সালে পুলিশের বিশেষ শাখার (এসবি) পরিদর্শক মামুন ইমরান খানকে পুড়িয়ে হত্যা মামলার ৬ নম্বর আসামি রবিউল ইসলাম আপন ওরফে আরাভ খান সম্প্রতি দুবাইয়ে স্বর্ণের দোকান উদ্বোধন করতে গিয়ে আলোচনায় আসেন। পুলিশ খুনের মামলার আসামি হলেও তার দোকান উদ্বোধন করতে যান ক্রিকেটার সাকিব আল হাসানসহ বেশ কয়েকজন তারকা। এ ঘটনা নিয়ে আলোচনার মধ্যে পুলিশ আরাভের বিরুদ্ধে রেড নোটিশ জারি করতে ইন্টারপোলে চিঠি দেয়। সেই চিঠির প্রেক্ষিতে আরাভের বিরুদ্ধে রেড নোটিশ জারি করে ইন্টারপোল।
আরো পড়ুন : সাংবাদিক শামসুজ্জামানের মুক্তির দাবিতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে মশাল মিছিল