অনলাইনে লোভনীয় বিজ্ঞাপন দিয়ে ফরেক্স ট্রেডিং সাইটে মানুষের বিনিয়োগের কোটি কোটি টাকা বিদেশে পাচার করছিল একটি চক্র। দীর্ঘদিন ধরে লাভের আশায় বিনিয়োগ করে অনেক মানুষ সর্বস্বান্ত হয়েছেন। লাভ তো দূরের কথা, অনেকে তাদের বিনিয়োগের টাকাও তুলতে পারেননি।
অথচ অননুমোদিত এসব সাইটে বাংলাদেশ ব্যাংকসহ সংশ্লিষ্ট অন্য কোনো প্রতিষ্ঠানের নিয়ন্ত্রণ নেই। তাই নীরবে বছরের পর বছর ধরে একটি বিদেশি চক্র বাংলাদেশে তাদের কিছু তথাকথিত প্রতিনিধি নিয়োগ করে দিব্যি কার্যক্রম পরিচালনা করে আসছিল। তবে শেষ পর্যন্ত রেহাই মেলেনি।
ওই চক্রের চার সদস্যকে পাবনার ঈশ্বরদী এবং ঢাকার বিভিন্ন এলাকায় অভিযান চালিয়ে গ্রেফতার করেছে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ (ডিবি)। তারা হলেন- মো. আবিদ রহমান শুভ, মো. ফয়সাল আহম্মেদ সরকার, কামরুন নাহার ও তাইফুর রহমান তন্ময়। তাদের কাছ থেকে ২৬টি চেকবই, ১৩টি এটিএম কার্ড, ৪টি ল্যাপটপ, ৪টি ডেক্সটপ, ১০টি মোবাইল ফোন, ১২টি সিমকার্ড, নগদ ১ লাখ ৫২ হাজার টাকা, ২টি পাওয়ার ব্যাংক ও ১টি নোটপ্যাড জব্দ করা হয়। রমনা মডেল থানায় ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের একটি মামলায় তাদের গ্রেফতার দেখানো হয়েছে।
ডিবি জানায়, ফরেক্স ট্রেডিং সাইটগুলো হলো অনেকটা শেয়ারবাজারে শেয়ার কেনাবেচার মতো। এটি অনলাইনে শেয়ার কেনাবেচার একটি প্ল্যাটফরম। এটাতে বাংলাদেশ সরকারের অনুমোদন ও বাংলাদেশ ব্যাংকের নিয়ন্ত্রণ নেই। এটি একটি উচ্চ ঝুঁকিপূর্ণ এবং অবৈধ ই-ট্রানজেকশন করার মাধ্যম, যেখানে গ্রাহকরা সহজেই প্রতারিত হয়। এই ফরেক্স সাইটগুলো দেশের বাইরে থেকে পরিচালিত হয়, যেখানে বাংলাদেশের কোনো সংস্থারই নিয়ন্ত্রণ নেই। সবকিছুর নিয়ন্ত্রণ বিদেশি কর্তৃপক্ষের হাতে। তাদের সাইটগুলো বাংলাদেশে পরিচালনার জন্য বিভিন্ন সেকশনে তারা বাংলাদেশি কিছু লোক নিয়োগ করে। যার মধ্যে কল সেকশন, লোকাল ডিপোজিটর, ট্রেডারের তথ্য যাচাই এবং অ্যাডমিন শাখা উল্লেখযোগ্য।
চক্রের সদস্যরা ফেসবুক, ইউটিউব, হোয়াটসঅ্যাপসহ অন্যান্য সামাজিক যোগযোগমাধ্যমে লোভনীয় বিজ্ঞাপন দিয়ে লোকজনকে ফরেক্স ট্রেডিং সাইটে ট্রেড করার জন্য আকৃষ্ট করে। যথাযথ কর্তৃপক্ষের অনুমতি ছাড়া ফরেক্স ট্রেডিং অ্যাকাউন্ট খোলার নামে তারা গ্রাহকের ব্যক্তিগত তথ্য সংগ্রহ করে। আগ্রহী ব্যক্তি তাদের সাইটে ট্রেড করার জন্য নিজের এনআইডি, পাসপোর্টসহ অন্যান্য তথ্য দিয়ে রেজিস্ট্রেশন করার পর সাইটের বাংলাদেশে কর্মরত প্রতিনিধিরা কল করে সাইটে কীভাবে বিনিয়োগ করবেন সে-সংক্রান্ত নির্দেশনা প্রদান করেন এবং লোকাল ডিপোজিটরের নম্বর সরবরাহ করেন।
লোকাল ডিপোজিটর বাংলাদেশি টাকার বিনিময়ে ট্রেড করতে আগ্রহী ব্যক্তিদের কাছে সাইট কর্তৃক প্রদত্ত ই-কারেন্সি সরবরাহ করে কিংবা বিভিন্ন উপায়ে ডলার-ক্রিপ্টোকারেন্সি সংগ্রহ করে। পরে ফরেক্স ট্রেডিং সাইটগুলোতে ট্রেডিং করতে ইচ্ছুক ব্যক্তিদের কাছে বেশি দামে বাংলাদেশি টাকায় তা বিক্রি করে। ডলার-ক্রিপ্টোকারেন্সি বিক্রিতে অর্জিত বাংলাদেশি টাকা লেনদেনের কাজে ব্যাংক অ্যাকাউন্ট এবং মোবাইল ব্যাংকিং অ্যাকাউন্ট ব্যবহার করে থাকে। সাধারণ মানুষ লাভের আশায় ফরেক্স সাইটগুলোতে বিনিয়োগ করে প্রতারিত হন। তার বিনিয়োগ করা সব টাকা, ডলার, ই-কারেন্সি ব্রোকাররা লস দেখায়। বিনিয়োগ করা টাকা সুকৌশলে বিদেশে পাচার করে ব্রোকাররা, যা বিনিয়োগকারীরা বুঝতেও পারেন না।
ডিবির তদন্ত-সংশ্লিষ্টরা বলছেন, গ্রেফতার আবিদুর রহমান শুভ দুই বছর ধরে এক্সএম গ্লোবাল লিমিটেডের লোকাল ডিপোজিটর হিসেবে কাজ করছেন। বিভিন্ন ক্লায়েন্ট ও ডিপোজিটরদের যখন তাদের ওয়েবসাইটে ফরেক্স ট্রেডিং করার জন্য ডলার বা ক্রিপ্টোকারেন্সি প্রয়োজন হয়, তখন ফয়সাল আহম্মেদ সরকার ও নাজমুল হাসান রিপনের কাছ থেকে ডলার-ক্রিপ্টোকারেন্সি সংগ্রহ করে। পরে বেশি দামে ট্রেডারদের কাছে বাংলাদেশি টাকায় বিক্রি করে। লেনদেনের ক্ষেত্রে ব্যাংক অ্যাকাউন্ট এবং মোবাইল ব্যাংকিং ব্যবহার করে। বিক্রি করা ডলার-ক্রিপ্টোকারেন্সি গ্রাহকের এক্সএম গ্লোবাল লিমিটেড ব্রোকারের অ্যাকাউন্টে জমা করে, যা মূলত এক্সএমের নিজস্ব ই-কারেন্সি জমা হয়।
শুভ এক্সএম ব্রোকারের লোকাল ডিপোজিটর হিসেবে কাজ করায় লেনদেন সহজ হয় এবং বেশিসংখ্যক গ্রাহক না বুঝে বিনিয়োগ করে প্রতারিত হন। তিনি এক্সএম পার্টনার হিসেবে কাজ করেন। গ্রেফতার ফয়সাল আহম্মেদ সরকার ২০১৪ সালে মালেয়শিয়ায় অবস্থানকালে সাইপ্রাসের নাগরিক পেরিস তাকে ফরেক্স ট্রেডিং সাইটের অনুবাদক এবং সোশ্যাল মার্কেটিং এক্সিকিউটিভ হিসেবে নিয়োগ দেন। পরে ২০১৭ সালে বাংলাদেশে আসার পর এক্সএম গ্লোবালের বাংলাদেশি অংশের পার্টনার হিসেবে তিনি নিয়োগ পান। ওই সাইটের বাংলাদেশ অংশের বিজনেস ডেভেলপমেন্ট ম্যানেজার সাইপ্রাসের নাগরিক সার্জিও হারিসের নির্দেশে শুভকে লোকাল ডিপোজিটর হিসেবে কমিশনের ভিত্তিতে নিয়োগ দেওয়া হয়।
আসামি কামরুন নাহার ২০১৭ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে অনলাইনে বিডি জবসের মাধ্যমে আবেদন করেন। পরে আইটি গ্রো ডিভিশন লিমিটেড নামক প্রতিষ্ঠানের ইন্দোনেশিয়ার নাগরিক ইনস্ট্রাফরেক্সের ব্যবস্থাপনা পরিচালক এনডি সানারজো সাইমাতুপেগ অনলাইনে ভাইভা নিয়ে কামরুন নাহারকে বাংলাদেশি অংশের ক্লায়েন্ট রিলেশন ম্যানেজার পদে নিয়োগ দেন। ইনস্ট্রাফরেক্স সাইটে তিনি তার মোবাইল নম্বর ব্যবহার করেন।
জিজ্ঞাসাবাদে তিনি আরও জানান, ইনস্ট্রাফরেক্স সাইটটি প্রথমে আইটি গ্রো ডিভিশন লিমিটেড নামক একটি প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে ২০১৩ সাল থেকে বাংলাদেশে তার কার্যক্রম পরিচালনা করে। তবে বর্তমানে তারা লন্ডা অনলাইন টেকনোলজিস ইনক নামে বাংলাদেশে কার্যক্রম পরিচালনা করছে।
তাইফুর রহমান তন্ময় ইন্দোনেশিয়ান নাগরিক এনডি সানারজো সাইমাতুপেগের মাধ্যমে ২০১৩ সালে নিয়োগ পেয়ে ইনস্ট্রাফরেক্স ট্রেডিং সাইটের বাংলাদেশ অংশের হিউম্যান রিসোর্স ম্যানেজার ও অ্যাডমিন হিসেবে কাজ করেন। পরে এই প্রতিষ্ঠানটি তাদের নাম পরিবর্তন করে কার্যক্রম পরিচালনা করে। প্রতিষ্ঠানটির কোনো জনবল প্রয়োজন হলে তিনি নিয়োগ দেন।
রমনা থানার মামলার এজাহারে উল্লেখ করা হয়, মামলার বাদী নিয়মিতভাবে অনলাইনে ফেসবুক, ইউটিউবসহ বিভিন্ন সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে সাইবার অপরাধীদের অপরাধমূলক কর্মকান্ড নিয়ে নজরদারি করছিলেন। এ সময় তিনি দেখতে পান, কতিপয় সাইবার অপরাধী আকর্ষণীয় অফার দিয়ে বাংলাদেশে অননুমোদিত ফরেক্স ট্রেডিংয়ের নামে ইলেকট্রনিকস ডিভাইস ব্যবহার করছে।
তারা অনলাইনে ডলার, ইউএসডিটি, এডিএ, ইটিএইচ, বিটিসি, বিএনবি, ইটিসিসহ ক্রিপ্টোকারেন্সির মাধ্যমে শেয়ার ক্রয়-বিক্রয়ের নামে কৌশলে বিপুল পরিমাণ টাকা ও ডলার হাতিয়ে নিচ্ছে। ফরেক্স ট্রেডিংয়ের অনলাইন ব্রোকাররা বাংলাদেশি কিছু অপরাধীর সহায়তায় আকর্ষণীয় বিজ্ঞাপনের মাধ্যমে সাধারণ লোকজনকে আকৃষ্ট করে।
পরে বিনিয়োগের নামে অনলাইনে অননুমোদিত লেনদেনে উদ্বুদ্ধ করে সর্বস্ব লুটে নেয়। অনলাইনে শেয়ার বিক্রির জন্য ফরেক্স ট্রেডিং সাইট খুলে বিভিন্ন ডিজিটাল ব্যাংকিং মাধ্যমে সংগ্রহের জন্য বাংলাদেশে কিছু লোকাল এজেন্ট নিয়োগ করা হয়। এজেন্টরা বিকাশ, নগদ, রকেটসহ অন্যান্য মোবাইল ব্যাংকিং অ্যাকাউন্ট ও ব্যাংক অ্যাকাউন্টের মাধ্যমে লোভনীয় বিজ্ঞাপনে আকৃষ্ট হয়ে অনলাইনে ট্রেড করতে ইচ্ছুক সাধারণ মানুষের কাছ থেকে অনলাইনে ক্রিপ্টোকারেন্সি বিক্রির নামে নগদ টাকা সংগ্রহ করে।
এর পরিপ্রেক্ষিতে অবৈধ এ কার্যক্রমে জড়িত থাকার জন্য ২০ জন এজাহারনামীয় এবং ৮০-৯০ জন অজ্ঞাতনামা আসামির বিরুদ্ধে মামলা করা হয়।
ডিবির সাইবার অ্যান্ড স্পেশাল ক্রাইম বিভাগের এডিসি আশরাফউল্লাহ বলেন, চক্রটি দীর্ঘদিন ধরে মানুষকে লোভ দেখিয়ে বিনিয়োগ করে লস দেখাচ্ছিল। মূলত তারা বিনিয়োগের সব টাকা বিদেশে পাচার করেছিল। এ পর্যন্ত তাদের কোটি কোটি টাকা পাচারের তথ্য পাওয়া গেছে। তাই অনলাইনে ট্রেড করা থেকে বিরত থাকতে হবে।
কারণ, বাংলাদেশ সরকার কর্তৃক অনুমোদিত কোনো ফরেক্স ট্রেডিং সাইট নেই। এসব সাইটে বিনিয়োগ করে কেউ এখন পর্যন্ত লাভবান হয়নি। হঠাৎ লাভের মুখ দেখলেও এর পরিণতি হয় শূন্য ব্যালেন্স। এ ছাড়া তারা যে লোভনীয় বিজ্ঞাপন দেয় এর সবটুকুই মানুষকে প্রতারিত করার উদ্দেশ্যে।
আরো পড়ুন : মেসি নাকি গ্রিজমান পাচ্ছেন সোনার বল!