ব্রিটেনের কাছ থেকে ১৯৪৮ সালে স্বাধীন হওয়ার পর সবচেয়ে মারাত্মক অর্থনৈতিক সংকটের মধ্যে রয়েছে ২ কোটি ২০ লাখ জনসংখ্যার দেশ শ্রীলঙ্কা। এই পরিস্থিতির জন্য দেশটির প্রবল ক্ষমতাধর রাজাপাকসে পরিবারকেই দায়ী করা হচ্ছে। এরই মধ্যে তুমুল জনরোষ ও বিক্ষোভের মুখে প্রধানমন্ত্রী পদ ছাড়তে এক প্রকার বাধ্য হয়েছেন মাহিন্দা রাজাপাকসে। তবে দেশটির বিক্ষোভকারীদের দাবি প্রেসিডেন্ট গোটাবায়া রাজাপাকসকেও ক্ষমতা ছাড়তে হবে।
শ্রীলঙ্কায় বিপর্যয়ের কারণ
শ্রীলঙ্কা গত ১৫ বছরে সমুদ্রবন্দর, বিমানবন্দর, রাস্তাসহ বিভিন্ন ধরনের মেগা প্রকল্পের কাজ হাতে নেয়। এসব প্রকল্পের জন্য বিলিয়ন বিলিয়ন ডলারের ঋণ নেয় দেশটি। তবে এসব প্রকল্পের জন্য বিপুল অর্থ খরচ করা হলেও অনেক প্রকল্প অর্থনৈতিকভাবে লাভজনক হয়নি।
এছাড়া, বিগত বছরগুলোতে দেশটিতে সরাসরি বিনিয়োগ তেমন হয়নি। এর পরিবর্তে শ্রীলঙ্কা সরকার ঋণ নেওয়ার প্রতি মনোযোগী ছিল। বিশেষ করে চীনের কাছে। গত এক দশকে দেশটি চীনের কাছ থেকে ঋণ নিয়েছে পাঁচ বিলিয়ন ডলার।
দেশটির অনেক বিশ্লেষকদের মতে, রাজাপাকসে সরকার ঋণের অর্থ অনেক অপ্রয়োজনীয় প্রকল্পে ব্যবহার করেছে। সেই সঙ্গে দূর্নীতি তো আছেই।
২০১৯ সালের নভেম্বরে গোটাবায়া রাজাপাকসে প্রেসিডেন্ট হওয়ার পর দেশটিতে ভ্যাট-ট্যাক্স কমানোর সিদ্ধান্ত নেন। এতে দেশটির অনেকেই বিস্ময় প্রকাশ করেছিলেন। ভ্যাট প্রদানের হার ১৫ শতাংশ থেকে কমিয়ে আট শতাংশে আনা হয়।
ছেলেসহ মাহিন্দার দেশত্যাগে নিষেধাজ্ঞা ছেলেসহ মাহিন্দার দেশত্যাগে নিষেধাজ্ঞা
দেশটির অর্থনীতিতে গতি আনতে এই সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। তবে এতে হিতে বিপরীত ঘটে। এরপরেই বিশ্বজুড়ে করোনাভাইরাস হানা দেয়।
কলম্বো বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতির অধ্যাপক শ্রিমাল আবিরত্নে বলেন, আয়কর এবং ভ্যাট কমানোর ফলে সরকারের রাজস্ব আয় ২৫ শতাংশ পর্যন্ত কমে যায়। ফলে সরকার আরও ঋণ নিতে বাধ্য হয়।
এছাড়া দেশটির কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সাবেক সিনিয়র ডেপুটি গভর্নর বার্তা সংস্থা রয়টার্সকে বলেন, ‘ট্যাক্স কমানোর বিষয়টি ছিল একটি বড় ভুল।’
২০১৯ সালের ইস্টার সানডেতে আত্মঘাতী বোমা হামলায় ২৫০ জন নিহত হয়। করোনার প্রকোপ ও বোমা হামলা সব মিলিয়ে দেশটিতে পর্যটন খাতেও ধস নামে।
গোটাবায়া রাজাপাকসে প্রেসিডেন্ট হওয়ার পর দেশটিতে অর্গানিক কৃষি চালু করেন। এতে দেশটির কৃষিক্ষেত্রে রাসায়নিক সার ও কীটনাশক ব্যবহার নিষিদ্ধ করা হয়। এর পরিপ্রেক্ষিতে দেশটিতে সার আমদানিও নিষিদ্ধ করা হয়।
রাজাপাকসের এই সিদ্ধান্তের ফলের শ্রীলঙ্কার কৃষিক্ষেত্রে নেতিবাচক প্রভাব পড়ে। এতে দেশটিতে চালের উৎপাদন ২০ শতাংশ পর্যন্ত কমে যায়। এক সময় যে দেশটি চাল উৎপাদনে স্বয়ংসম্পূর্ণ ছিল সেই দেশটি বাধ্য হয় ৪৫০মিলিয়ন ডলারের চাল আমদানি করে। এতে করে দেশটির মধ্যে চালের দাম হু হু করে বাড়তে থাকে।
এছাড়া অর্গানিক কৃষির নেতিবাচক প্রভাব পড়েছিল দেশটির চা উৎপাদনের ক্ষেত্রে। চা রপ্তানি করে শ্রীলংকা বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করে। সেখানেও বড় ধাক্কা লাগে।
শ্রীলঙ্কান নেতাদের ৫০ বাড়ি জ্বালিয়ে দিয়েছে বিক্ষোভকারীরা শ্রীলঙ্কান নেতাদের ৫০ বাড়ি জ্বালিয়ে দিয়েছে বিক্ষোভকারীরা
পর্যবেক্ষকদের মতে, দেশটির এই চরম অর্থনৈতিক সংকটের মূলে রয়েছে রাজাপাকসে সরকারের অপশাসন। গুরুত্বপূর্ণ পদে স্বজনদের ক্ষমতায় বসানো, অযৌক্তিক সরকারি ব্যয়, অস্বাভাবিক হারে ব্যাংক নোট ছাপানো দেশটির কোমর ভেঙে দিয়েছে।
দেশটিতে এই মুহূর্তে বৈদেশিক ঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে সাড়ে ৪১ বিলিয়ন ডলারের বেশি। অর্থনৈতিক অব্যস্থাপনা ও দুর্নীতির জন্য মাহিন্দা ও গোটাবায়া রাজাপাকসেকে দায়ী করা হচ্ছে।
বিশ্লেষকদের মতে, অর্থনৈতিক অব্যবস্থাপনার কারণে দেশটির আজ এই ভরাডুবি।
এদিকে গত সোমবার (৯ মে) রাজাপাকসের সমর্থকরা বিক্ষোভকারীদের ওপর তাণ্ডব চালালে দেশজুড়ে চরম সহিংসতা শুরু হয়। সেদিন থেকে এখন পর্যন্ত ক্ষমতাসীন এক এমপিসহ ৯ জন নিহত হয়েছেন। আহত হয়েছেন দুই শতাধিক। দেশটির নেতাদের ৫০টির বেশি বাড়ি জ্বালিয়ে দিয়েছে বিক্ষোভকারীরা। এর মধ্যে এমপি ও মন্ত্রীদের বাড়িও রয়েছে। বাধ্য হয়ে প্রধানমন্ত্রী পদ থেকে ইস্তফা দেন মাহিন্দা রাজাপাকসে।
একসময়ে হিরো বনে যাওয়া মাহিন্দা ও গোটাবায়া রাজাপাকসে যে দেশটির জনগণের কাছে ভিলেনে রূপ নিয়েছেন তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না। এখন দেখার বিষয় অথৈ সাগরে রাজাপাকসে পরিবারের তলাবিহীন তরী কতক্ষণ টিকতে পারে। তথ্যসূত্র: বিবিসি, এনডিটিভি, আল জাজিরা।