জাতীয় পার্টি (জাপা) নিয়ে নাটকীয়তার অবসান হয়েছে। আওয়ামী লীগের সঙ্গে গোপন আসন সমঝোতায় ৭ জানুয়ারির ভোটে অংশগ্রহণ নিশ্চিত করেছে দলটি। গতকাল মনোনয়নপত্র প্রত্যাহরের শেষ সময়ে দলের পক্ষ থেকে নির্বাচনে অংশ নেওয়ার ঘোষণা করা হয়। আওয়ামী লীগের সঙ্গে জোট বা মহাজোট গঠন না করলেও ২৬টি আসনে গোপন সমঝোতায় জাতীয় পার্টি নির্বাচনে অংশ নিতে সম্মত হয়। এ ২৬টি আসনে নৌকা প্রতীকে কোনো প্রার্থী থাকবে না। তবে নির্বাচন অংশগ্রহণমূলক দেখানোর জন্য অন্যান্য আসনে জাতীয় পার্টির কোনো প্রার্থীকে মনোনয়ন প্রত্যাহার করতে হয়নি। ফলে ২৮৩ আসনে ভোট করবে দলটি। ২৬টি আসনে নৌকা প্রতীক প্রত্যাহার করা হলেও অধিকাংশ আসনেই আওয়ামী লীগের স্বতন্ত্র প্রার্থী থাকায় বিজয়ী হওয়ার বিষয়ে নিশ্চিত হতে পারছে না জাতীয় পার্টি। আবার দলটির অনেক হেভিওয়েট প্রার্থী ২৬ আসনের সমঝোতায় নিজের আসন না থাকায় ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন। তারা বলছেন, অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন দেখানোর জন্য নিজের টাকা খরচ করে অহেতুক মাঠে থাকব না।
যেসব আসনে নৌকা থাকবে না : নৌকা প্রতীক ছাড়াই জাতীয় পার্টির প্রার্থীরা যে ২৬ আসনে লড়বেন, তারা হলেন- ঠাকুরগাঁও-৩ আসনে হাফিজ উদ্দিন আহমেদ, কিশোরগঞ্জ-৩ আসনে মো. মুজিবুল হক চুন্নু, রংপুর-১ আসনে হোসেন মকবুল শাহরিয়ার, রংপুর-৩ আসনে জি এম কাদের, নীলফামারী-৪ আসনে আহসান আদেলুর রহমান, কুড়িগ্রাম-১ আসনে এ কে এম মুস্তাফিজুর রহমান, কুড়িগ্রাম-২ আসনে পনির উদ্দিন আহমেদ, নারায়ণগঞ্জ-৫ আসনে সেলিম ওসমান, গাইবান্ধা-১ আসনে শামীম হায়দার পাটোয়ারী, গাইবান্ধা-২ আসনে মো. আবদুর রশিদ সরকার, ঢাকা-১৮ আসনে শেরীফা কাদের, নীলফামারী-৩ আসনে রানা মোহাম্মদ সোহেল ও বগুড়া-৩ আসনে নুরুল ইসলাম তালুকদার, ব্রাহ্মণবাড়িয়া-২ রেজাউল ইসলাম ভূইয়া, চট্টগ্রাম-৮ আসনে সুলেমান আলম শেঠ, বগুড়া-২ আসনে শরিফুল ইসলাম জিন্নাহ, সাতক্ষীরা-২ আসনে মো. আশরাফুজ্জামান, ফেনী-৩ আসনে মাসুদ উদ্দিন চৌধুরী, চট্টগ্রাম-৫ আসনে আনিসুল ইসলাম মাহমুদ, পটুয়াখালী-১ আসনে রুহুল আমিন হাওলাদার, ময়মনসিংহ-৫ আসনে সালাহ উদ্দিন আহমেদ মুক্তি, ময়মনসিংহ-৮ আসনে ফখরুল ইমাম, পিরোজপুর-৩ আসনে মো. মাশরেকুল আজম রবি, হবিগঞ্জ-১ আসনে মো. আবদুল মুনিম চৌধুরী, মানিকগঞ্জ-১ আসনে জহিরুল আলম রুবেল ও বরিশাল-৩ আসনে গোলাম কিবরিয়া টিপু।
সমঝোতায় বাদ পড়লেন বর্তমান সংসদের যেসব এমপি : বর্তমান সংসদের এমপি হওয়া সত্ত্বেও আওয়ামী লীগের নৌকা ছাড় না পাওয়া নেতারা হলেন- ঢাকা-৪ সৈয়দ আবু হোসেন বাবলা, ঢাকা-৬ কাজী ফিরোজ রশীদ, নারায়ণগঞ্জ-৩ লিয়াকত হোসেন খোকা, রংপুর-১ মসিউর রহমান রাঙ্গা, রংপুর-৩ সাদ এরশাদ, সুনামগঞ্জ-৪ পীর ফজলুর রহমান মিসবাহ, রবিশাল-৬ নাসরিন জাহান রত্না, পিরোজপুর-৩ রুস্তম আলী ফরাজী ও ময়মনসিংহ-৪ আসনের রওশন এরশাদ। এরমধ্যে রওশন এরশাদ ও সাদ এরশাদ দলের মনোনয়ন নেননি। মসিউর রহমান রাঙ্গা ও রুস্তম আলী ফরাজী দলীয় মনোনয়ন পাননি।
সমঝোতায় নতুন যারা নৌকা ছাড় পেলেন : বর্তমান সরকারের সংসদ সদস্য না হওয়া সত্ত্বেও নতুন করে জাতীয় পার্টির যেসব নেতা নৌকা প্রতীক ছাড় পেয়েছেন তারা হলেন- রংপুর-১ আসনে হোসেন মকবুল শাহরিয়ার, কুড়িগ্রাম-১ আসনে এ কে এম মুস্তাফিজুর রহমান, গাইবান্ধা-২ আসনে মো. আবদুর রশিদ সরকার, ঢাকা-১৮ আসনে শেরীফা কাদের, ব্রাহ্মণবাড়িয়া-২ রেজাউল ইসলাম ভূইয়া, সাতক্ষীরা-২ আসনে মো. আশরাফুজ্জামান, পটুয়াখালী-১ আসনে রুহুল আমিন হাওলাদার, ময়মনসিংহ-৫ আসনে সালাহ উদ্দিন আহমেদ মুক্তি, পিরোজপুর-৩ আসনে মো. মাশরেকুল আজম রবি, হবিগঞ্জ-১ আসনে মো. আবদুল মুনিম চৌধুরী ও মানিকগঞ্জ-১ আসনে জহিরুল আলম রুবেল।
জোট নয় কৌশল : গতকাল মনোনয়ন প্রত্যাহারের শেষ দিনে আওয়ামী লীগের সঙ্গে সমঝোতা প্রসঙ্গে জাতীয় পার্টির মহাসচিব মুজিবুল হক চুন্নু বলেন, কোনো জোট হয়নি। আসন সমঝোতা হয়নি। তবে কিছু আসনের ক্ষেত্রে কিছু কৌশল রয়েছে। জাতীয় পার্টি ২৮৩টি আসনে ভোটে অংশে নেবে।
এর আগে সকাল থেকেই জাতীয় পার্টির কার্যালয়ের সামনে বিক্ষোভ করে দলটির নেতা-কর্মীরা। বিক্ষুব্ধ নেতা-কর্মীদের একটি অংশ নির্বাচন বর্জনের দাবি জানিয়ে মিছিল করেন। জি এম কাদের কার্যালয়ে ঢোকার পরপরই গণমাধ্যম কর্মীরা তাঁর সঙ্গে কথা বলার চেষ্টা করেন। তিনি তাঁর কক্ষে চলে যান। এ সময় জাতীয় পার্টির নেতারা কার্যালয়ে যাওয়ার পর বনানী থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তাসহ (ওসি) আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর বিভিন্ন পর্যায়ের কর্মকর্তারা সেখানে পৌঁছান। তারা কার্যালয়ের ভিতরে গিয়ে কেউ চেয়ারম্যান এবং কেউ মহাসচিবের কক্ষের ভিতরে, কেউ সামনে অবস্থান নেন।
সমঝোতায় আসন পেলেও স্বতন্ত্র প্রার্থী নিয়ে চিন্তা : বিএনপি ও সমমনাদের বর্জনের মধ্যে ভোট জমিয়ে তুলতে আওয়ামী লীগের কৌশল এখন চিন্তার ভাঁজ ফেলেছে নির্বাচনে থাকা জাতীয় সংসদের প্রধান বিরোধী দল জাতীয় পার্টিতে। তিন মেয়াদে বিরোধী দলে থাকা জাতীয় পার্টির সঙ্গে ২৬ আসনে সমঝোতা হলেও ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ ভোটের মাঠে স্বতন্ত্র প্রার্থীদের রেখেছে। এ অবস্থায় জাতীয় পার্টিসহ ১৪ দলের শরিকরা কতটা বিজয়ী হয়ে আসতে পারবেন এ নিয়ে তারা আছেন টেনশনে। জাতীয় পার্টির দায়িত্বশীলরা বলছেন, তফসিল ঘোষণার পর থেকে গতকাল পর্যন্ত প্রতিটি বৈঠকে আওয়ামী লীগের স্বতন্ত্র প্রার্থীদের তুলে নেওয়ার জন্য দাবি জানানো হলেও শেষ পর্যন্ত এ বিষয়টির কোনো সুরাহা হয়নি।
নাটকীয়তার অবসান : ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ ও জাতীয় পার্টির আসন ভাগাভাগির বিষয়টি কয়েক দিন ধরেই ছিল রাজনৈতিক আলোচনার কেন্দ্রবিন্দু। পার্টির মহাসচিব মুজিবুল হক চুন্নু নির্বাচনি তফসিল ঘোষণার পর থেকে প্রতিদিন বনানীর কার্যালয়ে বলেছেন, জাতীয় পার্টি আওয়ামী লীগের সঙ্গে কোনো জোট করবে না। মানুষ ভোট দিতে পারলে জাতীয় পার্টি সরকার গঠন করবে আর আওয়ামী লীগ বিরোধী দলে যাবে। আওয়ামী লীগের সঙ্গে বৈঠক প্রসঙ্গে বলেছেন, নির্বাচনি পরিবেশ নিয়ে কথা বলেছেন। এ কথাও বলেছেন, রাজনীতিতে শেষ কথা বলে কিছু নেই। আসন সমঝোতা না হলে নির্বাচন থেকে সরে দাঁড়াতে পারে জাতীয় পার্টি এমন আলোচনাও ছিল রাজনৈতিক অঙ্গনে। গত কয়েক দিনের বৈঠকে জাতীয় পার্টির পক্ষ থেকে ৫০টি আসনের দাবি করা হলেও শেষ পর্যন্ত ২৬টি আসনে তারা সমঝোতায় পৌঁছায়। রাজধানীর ২০টি আসন থেকে এবার কোনো ছাড় দিতে রাজি ছিল না আওয়ামী লীগ। কিন্তু শেষ পর্যন্ত পার্টির তিন হেভিওয়েট নেতা কো-চেয়ারম্যান কাজী ফিরোজ রশীদ, সৈয়দ আবু হোসেন বাবলা ও সালমা ইসলামকে বাদ দিয়ে কীভাবে শেরীফা কাদের ঢাকা-১৮ আসনে আওয়ামী লীগের ছাড় পেলেন এ নিয়ে পার্টিতে চলছে আলোচনা।
আরো পড়ুন : রাষ্ট্রের সঙ্গে ভয়ংকর প্রতারণা রংধনু গ্রুপের চেয়ারম্যান রফিকুল ইসলামের