হঠাৎ হামলায় পুরো বিশ্বকে চমকে দিয়েছে ফিলিস্তিনের মুক্তকামী গোষ্ঠী হামাস। পালটা আক্রমণে ভয়ংকর হয়ে উঠেছে ইসরাইলও। রক্তক্ষয়ী লড়াই চলছে এখনো। থামার কোনো নাম নেই। সংঘর্ষে নিহত হয়েছে দুই হাজারের বেশি মানুষ।
ইসরাইলের সামরিক বাহিনীর অস্ত্রের জোরে দিন দিন আরও ভয়ংকর হয়ে উঠছে যুদ্ধ। সমরবিশ্বে ইসরাইলের সামরিক শক্তি বেশ প্রসিদ্ধ।
অন্যদিকে হামাসও বিশ্বের সবচেয়ে ভারী অস্ত্রধারী স্বাধীনতাকামী সংগঠনগুলোর একটি। তবে তা ইসরাইলের তুলনায় নিতান্ত তুচ্ছ হলেও মধ্যপ্রাচ্যের বিশেষজ্ঞ ড্যানিয়েল গারলাচ বলেছেন, ‘হামাসের অভিজাত বাহিনীর শক্তি হলো এর জনগণের সংকল্প।
এই যোদ্ধারা ফিরে আসার পরিকল্পনা করে না। তারা শহিদ হওয়ার উদ্দেশ্যেই যুদ্ধে যায়। আর এটাই তাদের বড় শক্তি।’ সম্প্রতি জার্মান সংবাদ মাধ্যম ডয়েচ ভেলেকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে এ কথা বলেন তিনি।
হামাসের মজুদ অস্ত্র
ইসরাইলের ওপর আকস্মিক আক্রমণকে অপারেশন ‘আল-আকসা বন্যা’ নাম দিয়েছে হামাস। অভিযানের প্রথম ২০ মিনিটে হামাস ৫ হাজারেরও বেশি রকেট ছুড়েছিল। এমনকি ইসরাইলের সীমান্ত শহর থেকে প্রায় ৮০ কিলোমিটার দূরে তেল আবিব পর্যন্ত বিস্ফোরক ছুড়ে ফেলেছিল।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, হামাসের রকেট এবং ক্ষেপণাস্ত্র অনুমান করা প্রায় অসম্ভব। তবে বিবিসির এক প্রতিবেদন অনুসারে, হামাসের কাছে কাশেম (পরিসীমা ১০ কিমি. পর্যন্ত) ও কুদস ১০১ (পরিসীমা প্রায় ১৬ কিমি. পর্যন্ত) নামে স্বল্প-পরিসরের সিস্টেম রয়েছে। এছাড়াও দীর্ঘ পরিসরের সিস্টেমের মধ্যে রয়েছে হামাস এম-৭৫ (পরিসীমা ৭৫ কিমি. পর্যন্ত), ফজর (পরিসীমা ১০০ কিমি. পর্যন্ত), আর-১৬০ (পরিসীমা ১২০ কিমি. পর্যন্ত) এবং এম-৩০২ (পরিসীমা ২০০ কিমি. পর্যন্ত)।
প্রতিবেদনে স্পষ্টভাবে বলা হয়েছে, হামাস গোষ্ঠীর কাছে এমন অস্ত্র আছে যা জেরুজালেম ও তেল আবিব দুই শহরকেই লক্ষ্যবস্তু করতে পারে। পুরো উপকূলীয় অঞ্চলকে হুমকি দিতে পারে। যুদ্ধে রকেট ও ক্ষেপণাস্ত্র ছাড়াও ড্রোনও ব্যবহার করছে হামাস।
যুক্তরাষ্ট্রের স্টিংগারের মতো অ্যান্টি-ট্যাঙ্ক মিসাইলও রয়েছে সংগঠনটির কাছে। যুক্তরাজ্যের কিংস কলেজের অধ্যাপক ক্লার্ক বলেন, ‘হামাস নির্দিষ্ট ধরনের জিনিস দিয়ে খুব সুসজ্জিত এবং সেগুলো ব্যবহার করার জন্য তারা বিশেষভাবে প্রশিক্ষিত। তবে হামাসের যোদ্ধার সংখ্যা নিয়ে এখনো কোনো নির্দিষ্ট পরিমাণ জানা যায়নি।’
এ বিষয়ে অধ্যাপক ক্লার্ক বলেন, ‘আগে প্রায় ১০ হাজার যোদ্ধা ছিল বলে অনুমান করা হয়েছিল। কিন্তু সহিংসতা বৃদ্ধির সঙ্গে অতিরিক্ত যোদ্ধা একত্রিত করায় তাদের সংখ্যা ১০ হাজার হামাসের প্রতিশ্রুতিবদ্ধ যোদ্ধা বেড়ে ৪০ হাজার অথবা ৫০ হাজার পর্যন্ত যেতে পারে। হামাসের শক্তিশালী প্যারাগ্লাইডারের ব্যবহার যুদ্ধে একটি ভিন্ন ও উন্নত রূপ দিয়েছে। এটি মোটরচালিত। প্যারাগ্লাইডাররা প্রতি ঘণ্টায় সাধারণত ১৫ থেকে ৫০ মাইল ভ্রমণ করতে পারে।
তবে হামাসের এই সিস্টেমগুলো কীভাবে পেয়েছে তা নিয়ে উদ্বেগ চলছে। চিন্তায় পড়েছেন ইসরাইলের বিশেষজ্ঞরা। এটি এখনো নিশ্চিতভাবে জানা যায়নি।
আমেরিকান বিজনেস ম্যাগাজিন ফোর্বস রিপোর্ট করেছে, ইরানের মতো দেশগুলো তাদের আর্থিক সহায়তা দেওয়ার পাশাপাশি এসব অস্ত্র তৈরির জন্য ইঞ্জিনিয়ারিং জ্ঞান, মোটর পরীক্ষা এবং অন্যান্য প্রযুক্তিগত দক্ষতার নীলনকশাও দেয়।
এর আগের একটি প্রতেবেদনে ফোর্বস জানায়, ইরানি উপদেষ্টারা হামাসকে শিখিয়েছেন কীভাবে জেরুজালেম এবং তেল আবিবের মতো শহরগুলোতে আঘাত হানা যায়। কীভাবে আর-১৬০ ও সেজিল সিরিজের মতো ব্যয়বহুল বৃহত্তর রকেট তৈরি করতে হয়।
এপি রিপোর্ট করেছে, দেশীয় ক্ষেপণাস্ত্র ছাড়াও ইরান এবং সিরিয়াও অন্যান্য স্থান থেকে অস্ত্র পাচারে সহায়তা করেছে। তবে এ খবর অস্বীকার করেছে ইরান।
জোর দিয়ে বলেছে, হামাস একটি স্বাধীন অপারেশন চালাচ্ছে। জাতিসংঘে হামাসের আক্রমণের সিদ্ধান্তে কুদস বাহিনী (ইরানের সামরিক গোয়েন্দা বাহিনী) জড়িত থাকার ধারণাকে দৃঢ়ভাবে প্রত্যাখ্যান করেছে।
বিবৃতিতে বলা হয়েছে, ফিলিস্তিনি প্রতিরোধের সিদ্ধান্তগুলো স্বায়ত্তশাসিত ও অটলভাবে ফিলিস্তিনি জনগণের বৈধ স্বার্থের সঙ্গে মিলিত। আমরা তাদের প্রতিক্রিয়ার সঙ্গে জড়িত নই। কিন্তু আমরা তাদের পাশে অটল সমর্থনে দৃঢ়ভাবে দাঁড়িয়েছি।
ইসরাইলের সামরিক বাহিনী
ইসরাইলের সামরিক বাহিনী ইসরাইল ডিফেন্স ফোর্স (আইডিএফ), ইসরাইল নেভাল ফোর্স (আইএন) এবং ইসরাইল এয়ার ফোর্স (আইএএফ) নিয়ে গঠিত। তাদের স্থায়ী সেনা সংখ্যা ১ লাখ ৬৯ হাজার ৫০০। রিজার্ভ সেনার সংখ্যা ৩ লাখ থেকে বেড়ে ৪ লাখ ৬৫ হাজারে।
২০২২ সালের ইউএস নিউজ অ্যান্ড ওয়ার্ল্ড রিপোর্টে বলা হয়েছে, ইসরাইল বিশ্বের ১০টি শক্তিশালী, রাজনৈতিকভাবে প্রভাবশালী এবং সামরিকভাবে শক্তিশালী দেশের মধ্যে একটি। ইসরাইলের অস্ত্রের ব্যাপক মজুদ রয়েছে।
আয়রন ডোম
ইসরাইলের শক্তিশালী অস্ত্র আয়রন ডোম মিসাইল শিল্ড। একটি বায়ু প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা। লোহার গম্বুজও বলা হয়। এটি সম্ভবত ইসরাইলের অস্ত্রাগারের সবচেয়ে বিখ্যাত অস্ত্র। শত্রুর ছোড়া রকেটগুলো প্রতিহত করতে এটি অত্যন্ত কার্যকর। যার সাফল্যের হার ৯৬ শতাংশ পর্যন্ত।
মেরকাভা ট্যাঙ্ক
মেরকাভা ট্যাঙ্কটি ইসরাইলের প্রধান যুদ্ধ ট্যাঙ্ক। জার্মান লিওপার্ড যুদ্ধ ট্যাঙ্কের মতো। ৬৪ টন ওজনের এ ট্যাঙ্কটি চারজনের একটি ক্রুর মাধ্যমে পরিচালিত হয়। এটি অ্যান্টি-ট্যাঙ্ক লাহার ক্ষেপণাস্ত্র নিক্ষেপ করতেও সক্ষম।
এম-১০৯ হাউইটজার
স্বচালিত আর্টিলারি অস্ত্র এম-১০৯ হাউইটজার। শত্র“কে সম্পূর্ণরূপে ধ্বংস করতে প্রতি মিনিটে চারবার ফায়ার করতে পারে।
কেফির ফাইটার জেট
কেফির ফাইটার জেট, যার অর্থ সিংহের বাচ্চা। একজন পাইলট এই জেটটিকে ঘণ্টায় ২ হাজার ৪৪০ কিলোমিটার গতিতে নিয়ে যেতে পারেন। এটির যুদ্ধের পরিসীমা ৬৭০ কিলোমিটার। এটি ক্ষেপণাস্ত্র, মেশিনগান এবং অন্যান্য বোমা দিয়ে সজ্জিত। গাজা উপত্যকায় হামলা চালাতে এসব যুদ্ধবিমান ব্যবহার করা হচ্ছে।
এফ-১৬ ফ্যালকন ফাইটার জেট
এফ-১৬ ফ্যালকন ফাইটার জেট যুক্তরাষ্ট্রের তৈরি। যুদ্ধ পরিসীমা ৫৪৬ কিলোমিটার। প্রতি ঘণ্টায় ২ হাজার ১৭৮ কিলোমিটার যেতে পারে। এক একটি ফাইটার জেটে একটি ২০ মিমি রোটারি কামান, দুটি এয়ার-টু-এয়ার মিসাইল, ছয়টি আন্ডারউইং বোমা, তিনটি আন্ডার-ফুসেলেজ বোমাসহ এয়ার-টু-সার্ফেস এবং এয়ার-টু-শিপ মিসাইল রয়েছে। ইসরাইলে এই জেট আছে মোট ১৯৬টি।
এফ-১৫ স্ট্রাইক ঈগল
এটি যুক্তরাষ্ট্রের তৈরি ফাইটার জেট। ঘণ্টায় ২ হাজার কিলোমিটারের বেশি গতিতে উড়ে। ৬০ হাজার ফুট উচ্চতায় উঠতে পারে। যুদ্ধ পরিসীমা ১ হাজার ২৭২ কিলোমিটার। এতে একটি ২০ মিমি কামান, এয়ার-টু-এয়ার মিসাইল, এয়ার-টু-সার্ফেস মিসাইল রয়েছে। এফ-১৫ স্ট্রাইক ঈগল আছে মোট ৮৩টি।
এফ-৩৫ স্টিলথ ফাইটার জেট
এটি রাডার দিয়ে শনাক্ত করা অত্যন্ত কঠিন। যুদ্ধের পরিসীমা ১ হাজার ২৩৯ কিলোমিটার। প্রতি ঘণ্টায় ১ হাজার ৯৭৬ কিলোমিটার যেতে পারে। এতে ২৫ মিমি কামান, এয়ার-টু-এয়ার, এয়ার-টু-সার্ফেস এবং অ্যান্টি-শিপ মিসাইল রয়েছে। মোট ৩০টি এফ-৩৫ স্টিলথ ফাইটার জেট আছে।
অ্যাপাচি হেলিকপ্টার
এটি বিশ্বের সেরা অ্যাটাক হেলিকপ্টারগুলোর মধ্যে একটি। এমনকি ভারতের অস্ত্রাগারেও এগুলো রয়েছে। ইসরাইলে মোট হেলিকপ্টারের সংখ্যা ১৪২টি। যার মধ্যে অ্যাপাচি হেলিকপ্টার রয়েছে ৪৩টি।
কিছু প্রতিবেদন অনুসারে, ইসরাইলের কাছে প্রায় ৯০টি প্লুটোনিয়াম পারমাণবিক ওয়ারহেড রয়েছে। যার ১০০-২০০টি অস্ত্রের উৎপাদন ক্ষমতা রয়েছে। এছাড়াও ৫৩০টি কামান, ৪৯টি নৌশক্তি ও ৫টি সাবমেরিনও রয়েছে।
আরো পড়ুন : ইসরাইল বাঙ্কার বাস্টার ব্যবহার করে গাজার টানেল ধ্বংস করতে চায়