টঙ্গীতে স্টিল মিলের ভয়াবহ কালো ধোঁয়ায় ছড়াচ্ছে বিষ, জনস্বাস্থ্যে হুমকি

ওকে নিউজ স্পেশাল জনদুর্ভোগ প্রচ্ছদ মুক্তমত শিল্প প্রতিষ্ঠান স্বাস্থ্য কথা হ্যালোআড্ডা

আশপাশে ঘন কালো ধোঁয়ার কারণে দিনের বেলায়ও চারপাশে রাতের অন্ধকার! সকালের প্রখর সূর্যের আলোতেই ঢাকা পড়ে দৃষ্টিসীমা। এমনই চিত্র দেখা গেছে, রাজধানীর পার্শ্ববর্তী টঙ্গীর স্টেশন রোডের অদূরে নিশাতনগর এলাকায়। স্টিল মিলের বিষাক্ত ধোঁয়ায় ভয়াবহ দূষণের শিকার হচ্ছে মানুষ। বিশেষ করে নারী, শিশু ও বৃদ্ধরা আছেন সবচেয়ে ঝুঁকিতে। এখানে শিল্পকারখানার পাশাপাশি আছে ব্যবসা প্রতিষ্ঠান, আবাসিক এলাকা, স্কুল, মসজিদ ও মাদ্রাসা।

এ এলাকার ‘মঙ্গলের বস্তি’র মুখেই এসএস স্টিল মিল। এ মিলের বিষাক্ত ধোঁয়া শোধন আর শব্দ নিয়ন্ত্রণে নেই ন্যূনতম পদক্ষেপ। ফলে মাশুল গুনতে হচ্ছে এলাকার বাসিন্দাদের। অনেকেই আক্রান্ত শ্বাসকষ্টসহ নানা রোগবালাইয়ে। ধোঁয়ার কালো আস্তরণ আশপাশের অন্যান্য কারখানার দেয়ালে দেয়ালে। ঝুঁকিতে আছে অন্যান্য কারখানা। এমন ভয়াবহ দূষণের কারণে অনেক বিদেশি ক্রেতা এ এলাকা থেকে মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছেন। চরম স্বাস্থ্যঝুঁকিতে আছেন অন্য কর্মীরাও। কারখানাটির লোহা পোড়া ধোঁয়াকাণ্ড অজানা নয় পরিবেশ অধিদপ্তরেরও। ভুক্তভোগী এলাকার মানুষের অভিযোগ, অধিদপ্তরের জরিমানা ও নোটিশেও বন্ধ করা যায়নি এসএস স্টিল মিলের কালো ধোঁয়া। কিছুতেই মিলছে না প্রতিকার।
সরেজমিন ঘুরে দেখা গেছে, কোনো অগ্নিকাণ্ড ছাড়াই ধোঁয়ার কুণ্ডলি উড়ছে আকাশে। এসএস স্টিল মিল থেকে নির্গত ধোঁয়ার কারণে পুরো এলাকা অন্ধকার হয়ে আছে। এ মিলের চুল্লিতে জ্বলছে পুরোনো লোহার টুকরো। ধোঁয়া শোধনের নেই কোনো উদ্যোগ । নির্গমন চিমনির উচ্চতা এখানে কম, তাই ধোঁয়া ছাদ ও দেয়ালের টিনের ফাঁক দিয়ে ছড়িয়ে পড়ছে সহজেই। বাতাসে উড়ে ছাই এসে পড়ছে গাছপালা আর আশপাশের বিভিন্ন স্থাপনায়। সেই কারখানার নির্গত বিষাক্ত ধোঁয়ায় দিনেই নামে রাত।

দূষণের শিকার স্থানীয় বাসিন্দারা বলছেন, কালো ধোঁয়ার কারণে শ্বাস নেওয়াই দায় হয়ে পড়েছে। অনেকেই আক্রান্ত শ্বাসকষ্টসহ নানা রোগবালাইয়ে। এসএস স্টিল মিলে কাজ করছেন শতাধিক শ্রমিক। প্রতিবেশীদের সঙ্গে কারখানার শব্দদূষণের শিকার তাঁরাও।

শুধু ধোঁয়া কিংবা শব্দ নয়, এসএস স্টিল মিলের ঝুঁকিপূর্ণ অবকাঠামোয় প্রায়ই ঘটছে দুর্ঘটনা। গত দুই বছরে একাধিক শ্রমিক নিহত ও অর্ধশতাধিক আহতের ঘটনা আছে এই কারখানায়। এ নিয়ে সরকারি বিভিন্ন দপ্তরে অভিযোগ দিয়েও প্রতিকার পাচ্ছেন না সাধারণ মানুষ।

স্থানীয় চা বিক্রেতা আব্দুল মোমেন বলেন, ধোঁয়ায় আকাশ দেখা যায় না। ১০ হাত দূরেও কিছু দেখা যায় না। অনেক কষ্টে আছি। নিঃশ্বাস নিতে কষ্ট হয়। গৃহিণী জোবেদা আক্তার বলেন, দিনের মধ্যে পাঁচ থেকে ছয়বার ঘর পরিষ্কার করা লাগে। কাপড় রোদে দেওয়া যায় না। ধোঁয়ার কারণে সব কালো হয়ে যায়। এখানে ঘরে ঘরে সর্দি-কাশি ও শ্বাসকষ্ট লেগেই আছে।

কসমেটিকস দোকানের মালিক আব্দুল গনি বলেন, দোকানের মালপত্র এসএস স্টিল থেকে আসা ছাইয়ের কারণে কালো হয়ে যায়। ব্যবসা টিকিয়ে রাখা কঠিন হয়ে পড়েছে। শ্বাস নিলে নাকে ময়লা আসে। গোসল করে এলে মনে হয়, এক মাস ধরে গোসল করিনি। শরীর কালো হয়ে যায়। শব্দের কারণে পুরো এলাকা থরথর করে কাঁপে।

স্থানীয় ফার্মেসি দোকানের মালিক মহিব উল্যাহ বলেন, এখানে সর্দি-কাশি ও শ্বাসকষ্টজনিত সমস্যা নিয়ে রোগীরা বেশি আসেন। এসব ওষুধই বিক্রি হয় বেশি।

কারখানার বিষাক্ত ধোঁয়ায় পাশের রপ্তানিমুখী পোশাক ও অন্য কারখানাগুলোর কয়েক হাজার শ্রমিকের কর্মকাণ্ডে বিঘ্ন ঘটাচ্ছে। ব্যাহত হচ্ছে পণ্য রপ্তানির কর্মযজ্ঞ। বিদেশি ক্রেতারা মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছেন। বাতিল হচ্ছে রপ্তানি আদেশ। এসএস স্টিল মিলের পাশের একটি কারখানার নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক কর্মকর্তা বলেন, ধোঁয়ায় শুধু কর্মীরা স্বাস্থ্যঝুঁকিতে রয়েছেন তা-ই নয়, ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে কারখানার অবকাঠামো ও রপ্তানি পণ্যও। ভবনগুলো প্রতি মাসে সংস্কার করতে হচ্ছে। তাঁদের অনেক পণ্য ধোঁয়ায় ক্ষতিগ্রস্ত হয়, যা রপ্তানির অযোগ্য হয়ে পড়ে। প্রায়ই বিদেশি ক্রেতারা কারখানা পরিদর্শনে এলে ধোঁয়াচ্ছন্ন পরিবেশ দেখে অসন্তোষ প্রকাশ করেন; রপ্তানি আদেশ বাতিল করেন। এতে উদ্যোক্তাদের ক্ষতির পাশাপাশি রপ্তানিও বাধাগ্রস্ত হচ্ছে।

আরেক কর্মকর্তা বলেন, রাতদিন ২৪ ঘণ্টা ধোঁয়া বের হচ্ছে। শ্রমিকদের শ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছে। বারবার অভিযোগ জানানো হলেও এসএস স্টিল মিল কর্তৃপক্ষ ধোঁয়া পরিশোধন ও চারপাশে ছড়িয়ে পড়া বন্ধ করতে কোনো ব্যবস্থা নেয়নি।

এ বিষয়ে প্রতিষ্ঠানটির উপমহাব্যবস্থাপক (মানবসম্পদ ও প্রশাসন) মোহাম্মদ মারুফ উর রহমানকে ফোন করা হলে তিনি এ বিষয়ে কোনো কথা বলতে রাজি হননি।

পরিবেশ অধিদপ্তরের একটি সূত্র জানিয়েছে, ২০১৯ সালে পরিবেশ অধিদপ্তরের গাজীপুর জেলা কার্যালয় এসএস স্টিল মিলে অভিযান চালিয়ে ৫০ হাজার টাকা জরিমানা করে।
বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলনের (বাপা) সাধারণ সম্পাদক শরীফ জামিল সমকালকে বলেন, দূষণ ছড়ানোর পরও এ কারখানার বিরুদ্ধে এখনও ব্যবস্থা না নেওয়ায় পরিবেশ অধিদপ্তরের সংশ্লিষ্টদের শাস্তির মুখোমুখি করা দরকার। আমরা এসএস স্টিল মিলের দূষণ বন্ধে প্রাথমিকভাবে সংগঠনের পক্ষ থেকে বিভিন্ন দপ্তরে চিঠি দেব। এর পরও কাজ না হলে ওই এলাকায় বাপার পক্ষ থেকে কর্মসূচি দেওয়া হবে।

গাজীপুরের পরিবেশ অধিদপ্তরের উপপরিচালক মো. নয়ন মিয়া বলেন, অনেক দিন ধরেই তাদের সতর্ক করা হচ্ছে। পরিবেশগত ছাড়পত্রও নবায়ন করেনি এসএস স্টিল মিল। সব ধরনের পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে এই প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে জরিমানাসহ আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হবে। এমনকি আদালতে মামলাও করা হতে পারে।

আরো পড়ুন : এবার আইন সংশোধন হচ্ছে ইচ্ছাকৃত ঋণখেলাপি ধরতে

Share The News

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *