খুলনা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অনার্স শেষ করেছেন ঈশিতা হক। এরপর তিনি ইউরোপের বিভিন্ন দেশে মাস্টার্সের জন্য আবেদন করেন। স্কলারশিপ না মেলায় নিজ খরচেই পড়তে যেতে চান। তিনি ইউনিভার্সিটি কনফারমেশন করেছেন লিথুনিয়ার একটি বিশ্ববিদ্যালয়ে। স্টুডেন্ট ফাইল খোলার জন্য একাধিকবার একাধিক ব্যাংকে যোগাযোগ করেও করতে পারেননি। এ কারণে একটি সেমিস্টার মিস হয়। পরে অন্য এক শিক্ষার্থীর ফাইল ব্যবহার করে তিনি ভর্তি হন। ঈশিতা এই সুযোগ পেলেও অনেকে তাও করতে পারছেন না। এ ছাড়া যেসব শিক্ষার্থী বিদেশে আগে পড়তে গেছেন তারাও দেশ থেকে অর্থ নিতে দুর্ভোগ পোহাতে হচ্ছে ডলার সংকটের কারণে।
ঈশিতার মতো অনেক শিক্ষার্থীই এক ব্যাংক থেকে অন্য ব্যাংকে ঘুরছেন স্টুডেন্ট ফাইল খোলার জন্য। কিন্তু সেই সুযোগ মিলছে কম।
সাজিদ আরাফাত নামের এক শিক্ষার্থী বলেন, আমি ফুল ফান্ডেড স্কলারশিপের জন্য আবেদন করে আসছি দীর্ঘদিন ধরেই।
কিন্তু না হওয়ায় সেল্ফ ফান্ডে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেই। কিন্তু স্টুডেন্ট ফাইল না হওয়ায় আমি যেতে পারিনি। এরপর জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে মাস্টার্সে ভর্তি হয়েছি।
স্টুডেন্ট ফাইল নিয়ে ব্যাংকগুলোর কোনো নিষেধাজ্ঞা না থাকলেও কেউই খুলছেন না ফাইল। যার কারণে অনেক শিক্ষার্থী যেতে পারছেন না দেশের বাইরে। আবার অনেক শিক্ষার্থী এটাস্ট ফাইল দেখিয়ে পাচ্ছেন ভর্তির সুবিধা। স্টুডেন্ট ফাইল না থাকায় স্বপ্ন ধ্বংস হচ্ছে অনেকের। এ ছাড়া বৈধভাবে অর্থ নিতে না পারায় অনেকে হুন্ডির মাধ্যমে অর্থ প্রেরণ করায় বৈদেশিক মুদ্রা হারাচ্ছে বাংলাদেশ। শিক্ষার্থী অভিভাবকরা বলছেন, ইচ্ছা না থাকা সত্ত্বেও বাধ্য হয়ে হুন্ডির আশ্রয় নিচ্ছেন তারা।
নতুন শিক্ষার্থীরা স্টুডেন্ট ফাইল খুলতে পারছেন না। আবার পুরাতন ফাইলধারী শিক্ষার্থীরাও আছেন শঙ্কায়। মালয়েশিয়ায় অধ্যয়নরত মৃণ্ময়ী দেব নাথ বলেন, এখানে আমি পার্ট টাইম জব করি। এরপরও আমার পুরো খরচ বহন করা সম্ভব হচ্ছে না। এজন্য দেশ থেকে টাকা আনতে হয়। কিন্তু ব্যাংকগুলো ডলার পাঠাতে অপারগতা জানায়। প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, এখানে এক ভাই আমাকে প্রয়োজনীয় রিঙ্গিত দিচ্ছেন। এই রিঙ্গিতের সমপরিমাণ টাকা বাবা তার পরিবারের কাছে পৌঁছে দিচ্ছেন। আমি মাসে একবার করে টাকা নেই। এক বছরে ব্যাংক থেকে বাবা টাকা পাঠিয়েছে মাত্র তিনবার। ব্যাংকে বার বার নেতিবাচক কথা শুনতে শুনতে এই বিকল্প পথ বেছে নিতে হয়েছে।
অনেক শিক্ষার্থীই বাধ্য হয়ে আশ্রয় নিচ্ছেন হুন্ডির। জার্মানি প্রবাসী শিক্ষার্থী রোদেলা অর্থিও একই কথা বলেন। তিনি বলেন, স্টুডেন্ট ফাইল খোলার জটিলতার কারণে এক পরিচিত ভাইয়ের ফাইল কন্ট্রাকচুয়ালি নেই। এভাবেই চলছিল। কিন্তু আব্বু টাকা দিতে পারছিলেন না। ব্যাংকগুলো আজ আসেন, কাল আসেন এসব বলতে থাকে। তিনি বলেন, এরপর আমি এক পরিচিত ভার্সিটির ভাইয়ের কাছে টাকা নেই। আর আব্বু হিসাব করে ভাইয়ের দেশে থাকা পরিবারের কাছে পাঠিয়ে দেন। এজন্য ৫ থেকে ১০ শতাংশ অর্থ বেশি দিতে হচ্ছে।
বিদেশে উচ্চশিক্ষা প্রত্যাশী শিক্ষার্থীরা মূলত দেশের ব্যাংকগুলোর মাধ্যমে বিশ্ববিদ্যালয় বা কলেজে ভর্তি, টিউশন, আবাসন ফিসহ বিভিন্ন খরচ পাঠান। এজন্য ব্যাংকে বৈদেশিক মুদ্রা লেনদেনের একটি ফাইল খুলতে হয়। বৈদেশিক মুদ্রায় লেনদেন হয়, ব্যাংকগুলোর এমন সব এডি শাখা থেকেই ফাইল খোলার সুযোগ রয়েছে। ভর্তি প্রক্রিয়া সম্পন্ন হওয়ার পর শিক্ষার্থীদের অভিভাবকরা ওই ব্যাংক হিসাবের মাধ্যমে বিদেশে অর্থ পাঠান।
ক্ষোভ প্রকাশ করে মলডোবায় থাকা শিক্ষার্থী আনন্দ রয় বলেন, এটা একেক দেশের একেক নিয়ম। মলডোবায় স্টুডেন্ট ফাইল থাকা বাধ্যতামূলক। এমনকি যৌথ অ্যাকাউন্ট বা অন্য কারও মাধ্যমে অর্থ দেখানো যাবে না। নতুন সেমিস্টারের জন্য পরিচিত কিছু ছোট ভাই স্টুডেন্ট ফাইলের জন্য ঘুরছে। কিন্তু ফাইল তৈরি করতে পারছে না। তিনি জানান, প্রশাসনের একজন কর্মকর্তার সুপারিশের ব্যবস্থা করার পরও তার খালাতো ভাইয়ের জন্য স্টুডেন্ট ফাইল খুলতে পারেননি তিনি।
নরওয়েতে থাকা শিক্ষার্থী সাদিকুল সম্রাট বলেন, নরওয়েতে বাংলাদেশের শিক্ষার্থীদের আইইএলটিএস স্কোর ভালো থাকলেই আসা যাচ্ছে। কিন্তু তারা স্টুডেন্ট ফাইলের বিষয়ে খুবই রেসট্রিক্ট। তারা প্রোপার ফাইল ও চ্যানেল ছাড়া আসতে দিচ্ছে না। এখন অনেকেরই স্বপ্ন পূরণে বাধা হয়ে গেল। পুরনো শিক্ষার্থী যাদের স্টুডেন্ট ফাইল আছে তাদের বিষয়ে বলেন, এই স্টুডেন্ট ফাইলে ক্রেডিট স্কোরের মাধ্যমে কিছু সংখ্যা যুক্ত থাকে। এই সমপরিমাণ অর্থ ব্যাংকগুলো দিতে কোনো সমস্যা করছিল না। কিন্তু গত কয়েক মাসে ক্রেডিট স্কোরের সমপরিমাণ অর্থ দিতেও ব্যাংকগুলো গড়িমসি করছে। আর শিক্ষার্থীরা বিলম্ব ফি’র হাত থেকে বাঁচার জন্য বাধ্য হয়ে অবৈধ পথে দেশ থেকে টাকা আনছে।
ইতালিতে পড়ছেন নীলজৃত খান রকি। তিনি বলেন, আমি ফাইল ছাড়াই আবেদন করি। ভাইয়ের অ্যাকাউন্টেই ফিক্সড ব্যালেন্স শো করি। ওই ভাই আমার হয়ে টাকা জমা দেন এবং আমি পেপারস জমা দেই। আমার জানা মতে এভাবে সকলে আসতে পারে না। এটা কিছুটা ঝুঁকিপূর্ণ চ্যানেল। তিনি বলেন, আমি যদি স্টুডেন্ট ফাইল খুলতে পারতাম তাহলে আমাকে কোনো ঝুঁকিতে থাকতে হতো না। আর টাকা আনা-নেয়ার জন্য লুকোচুরিও করতে হতো না।
দেশের বেসরকারি ও বিদেশি প্রথমসারির ব্যাংকগুলো বিদেশগামী শিক্ষার্থীদের ফাইল খোলে। তবে ডলার সংকটের কারণে সম্প্রতি বেশির ভাগ ব্যাংকই এসব ফাইল খোলা বন্ধ করে দিয়েছে। কিছু ব্যাংক এখনো চালু রাখলেও প্রভাবশালীদের তদবির লাগছে।
জাতিসংঘের শিক্ষা, বিজ্ঞান ও সংস্কৃতি বিষয়ক সংস্থা ইউনেস্কোর ‘গ্লোবাল ফ্লো অব টারশিয়ারি লেভেল স্টুডেন্টস’ শীর্ষক প্রতিবেদনে বলা হয়, ২০২১ সালে বাংলাদেশ থেকে ৪৯ হাজার ১৫১ শিক্ষার্থী বিদেশে গিয়েছেন উচ্চশিক্ষা নিতে। আর বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য বলছে, ২০২১-২২ অর্থবছরের প্রথম প্রান্তিকে (জুলাই-সেপ্টেম্বর) উচ্চশিক্ষার জন্য বিদেশে পাঠানো ডলারের পরিমাণ ছিল ৯ কোটি ৮৮ লাখ ডলার। ২০২২-২৩ অর্থবছরের প্রথম প্রান্তিকে তা ১৫ কোটি ৩১ লাখ ডলার ছাড়িয়ে গিয়েছে। ২০২১-২২ অর্থবছরে প্রায় ৩২ কোটি ১০ লাখ ডলার পাঠানো হয়েছে শিক্ষার্থীদের উচ্চশিক্ষা বাবদ, যা বাংলাদেশি মুদ্রায় প্রায় ৩ হাজার কোটি টাকা।
কিন্তু কেন খোলা যাচ্ছে না ফাইল। জানতে চাইলে বাংলাদেশ ব্যাংকের একজন কর্মকর্তা বলেন, একেবারেই যে ফাইল খোলা হচ্ছে না তা নয়। তবে নতুন ফাইল প্রয়োজনের তুলনায় অনেক কমে গেছে। বর্তমানে ডলার সংকট রয়েছে, এটা সকলেরই জানা। ব্যাংকগুলো শিক্ষার্থীদের ফাইল না খুলে এলসি, জরুরি আমদানি, নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য দেশে আনছেন। বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে কোনো বাধা না থাকলেও ব্যাংকগুলো এড়িয়ে চলছে বিষয়টি।
প্রতি বছরে ১৪ থেকে ১৫ বার ছেলের কাছে টাকা পাঠাতে হয় রংপুরের এক ব্যবসায়ীর। তার ছেলে বর্তমানে পোল্যান্ডের একটি বিশ্ববিদ্যালয়ে অনার্সে অধ্যয়নরত। তিনি বলেন, প্রতি মাসে গড়ে আমাকে ৫০/৭০ হাজার টাকা পাঠাতে হয়। ছেলের স্টুডেন্ট ফাইল আছে। যে ব্যাংকে ফাইল খোলা তারা প্রয়োজনীয় অর্থ পাঠাচ্ছিল নিয়মিত। কিন্তু গত ফেব্রুয়ারি মাসে ব্যাংক থেকে বলে, এই মুহূর্তে দিতে পারছি না সপ্তাহখানেক পর আসেন। এরপর সেই তারিখে যাওয়ার পর তারা অপারগতা জানায়। সেই মাসে ছেলের কাছে টাকা পাঠাতে বেশ দেরি হয়। মার্চে ছেলের বিশ্ববিদ্যালয়ে সেশন ফি’র ডেট ছিল। যেহেতু এই তারিখ মিস করছে প্রায় ১২/১৩ হাজার টাকা জরিমানা দিতে হবে তাই প্রথম হুন্ডির মাধ্যমে টাকা পাঠাই। এরপরের মাসেও একই কথা বলায় এরপর থেকে হুন্ডির মাধ্যমেই টাকা পাঠাই।
তিনি আরও বলেন, আমার বৈধভাবে টাকা পাঠাতে যে খরচ হতো তার থেকে ৫/৭ হাজার টাকা বেশি লাগছে। তিনি আক্ষেপ করে বলেন, আমার টাকাও বেশি যাচ্ছে দেশও লাভবান হচ্ছে না।
এ বিষয়ে সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ-সিপিডি’র জ্যেষ্ঠ গবেষণা ফেলো তৌফিকুর ইসলাম খান বলেন, যারা বাইরে পড়তে যান তারা ব্যাংকিং চ্যানেল নিতে পারেন, এটা বৈধ। কিন্তু অনেক সময় ব্যাংকগুলো গড়িমসি করে। যার কারণে শিক্ষার্থী-অভিভাবকরা হুন্ডির আশ্রয় নিচ্ছেন। কিন্তু এই হুন্ডিটা হচ্ছে ওভারঅল হুন্ডি নিয়ন্ত্রণ না হওয়ার কারণে। যারা অর্থ পাচার করছেন তারা বৈধ আয়েও করছেন অবৈধ আয়েও করছেন।
আরো পড়ুন : ব্যক্তির সন্তান এবং পরিবারের সদস্যদেরও যুগের পর যুগ যুক্তরাষ্ট্রের ভিসা নিষেধাজ্ঞার প্রভাব থাকে