মৃত ছেলের মুখ দেখেননি, ছিলেন আইসিইউতে, আট বছরের কন্যাসন্তানের অবস্থাও সংকটময়
এডিস মশার ভয়াল থাবায় জনজীবন বিপন্ন। বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষ ডেঙ্গুর কাছে জিম্মি হয়ে পড়েছে। চোখের সামনে চিরতরে চলে যাচ্ছে তরতাজা প্রাণ। মা-বাবার সামনেই হারিয়ে যাচ্ছে তাদের প্রিয় সন্তান। না-ফেরার দেশে চলে যাচ্ছে স্কুল-কলেজের শত শত কোমলমতি শিক্ষার্থী। হারিয়ে যাচ্ছে তাদের বাবা-মা ও পরিবারের সব স্বপ্ন।
তেমনি একজন অভিভাবক রাজধানীর খিলগাঁওয়ের বাসিন্দা শান্তা ইসলাম (৩৫)। তার ছোট ছেলে সাফাত আল আয়াত (১১)। মা ও শিশু দুজনই ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে রাজধানীর মুগদা হাসপাতালে ভর্তি হয়েছিলেন। মা-ছেলে উভয়েরই শারীরিক অবস্থার অবনতি ঘটতে থাকে। একপর্যায়ে মায়ের অবস্থা খারাপ হওয়ায় তাকে হাসপাতালের আইসিইউতে স্থানান্তর করা হয়। ঐ সময় তার ছোট ছেলে খিলগাঁও উচ্চ বিদ্যালয়ের তৃতীয় শ্রেণির ছাত্র সাফাত আল আয়াত মারা যায়। আইসিইউতে থাকায় শেষবারের মতো আদরের ছোট ছেলের মুখও দেখতে পারেননি মা। পরে আইসিইউ থেকে সুস্থ হয়ে বাসায় ফেরেন শান্তা ইসলাম।
ঐ সময় পরিবারের সদস্যদের জিজ্ঞাসা করেন, ‘সবাইকে দেখছি, আয়াত কোথায়?’ পরিবারের সদস্যরা কোনো উত্তর না দিয়ে অঝোরে কাঁদতে থাকেন। কেউ কেউ শান্ত ইসলামকে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে থাকেন। ততক্ষণে তিনি বুঝতে পারছেন, তাকে ছেড়ে না-ফেরার দেশে চলে গেছে কলিজার টুকরা আয়াত। মুহূর্তে পরিবারটি আরও বেশি শোকাতুর হয়ে পড়ে। প্রতিবেশীরা এসে তাদের সান্ত্বনা দেন। ঘরে ফিরতে না ফিরতেই ছোট মেয়ে মারিয়াম (৮) ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়। অবস্থা বেগতিক দেখে তাকে মুগদা হাসপাতালের আইসিইউতে ভর্তি করা হয়েছে। সব মিলিয়ে মাত্র দুই সপ্তাহের মধ্যে ডেঙ্গু তছনছ করে দিয়েছে শান্তা ইসলামের পরিবারকে।
গতকাল বুধবার মুগদা হাসপাতালে শিশুকন্যার শয্যা পাশে দাঁড়িয়ে স্মৃতিচারণা করে কান্নাবিজড়িত কণ্ঠে শান্তা ইসলাম বলেন, ‘ছেলের সঙ্গে কতশত স্মৃতি, কত কথাই বলার ছিল; কিন্তু কিছুই বলতে পারলাম না! এখন ছেলের ঘরে ঢুকলেই বুকটা হাহাকার করে ওঠে। ছেলের থাকার ঘরে পড়ার টেবিলে সাজানো-গোছানো বই-খাতা, চেয়ার-টেবিল, জামাকাপড় সবই আছে। শুধু নেই আমার কলিজার টুকরা ছোট ছেলেটা! যে ছেলে আমাকে ছেড়ে এক সেকেন্ডও থাকতে পারত না, আজ আমার বুক খালি করে অন্ধকার কবরে ঘুমায়! এত ব্যথা, এত কষ্ট আমি কাউকে বোঝাতে পারব না। ডেঙ্গুর ভয়াল থাবা আমাদের জীবন এলোমেলো করে দিয়েছে। সন্তান হারানোর বেদনা যে কত কষ্টের তা কেবল ভুক্তভোগীরাই বুঝতে পারেন। তার সান্ত্বনা দেওয়ার ভাষা কারোর নেই।’
শান্তা ইসলামের বড় ছেলে ফারদিন (১৭) এবার এসএসসি পরীক্ষা দেবে। বর্তমানে শান্তা ইসলাম ছোট মেয়ের শয্যাপাশেই রয়েছেন। কিছুক্ষণ পরপর তিনি তার মেয়েকে জড়িয়ে ধরছেন। মনে করছেন এই বুঝি তাকেও হারাতে হবে। সব সময় সন্তান হারানোর ভয় তাকে তাড়া করে ফিরছে। বিশেষজ্ঞরা বলেন, ডেঙ্গু এবার ভয়ংকর রূপ দিয়েছে। এভাবে একের পর এক পরিবারকে শেষ করে দিচ্ছে। সাফাত আল আয়াতের মতো আরও কত শিশুসহ সব বয়সের মানুষ প্রতিদিন স্বজনহারা হচ্ছে। তাদের পরিবার হয়ে যাচ্ছে নিঃস্ব। ডেঙ্গুতে প্রতিদিন আক্রান্ত ও মৃত্যুর যে সংখ্যা সরকার প্রকাশ করছে, প্রকৃত চিত্র তার চেয়ে প্রায় পাঁচ গুণ বেশি। অনেক পরিবারের আদরের সন্তান যেমন মারা যাচ্ছে, তেমনি পরিবারের একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তিকে হারিয়ে পথে বসছে অনেক পরিবার।
আরো পড়ুন : বৈশ্বিক অর্থনৈতিক সংকট মোকাবিলায় পাঁচ দফা প্রস্তাব তুলে ধরলেন প্রধানমন্ত্রী