ঢাকায় প্রকোপ বেড়েছে ডেঙ্গুর। বাড়ছে মৃত্যুর মিছিল। এতে প্রতিদিনই যুক্ত হচ্ছে নতুন নতুন নাম। ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে প্রাণ হারিয়েছেন চিকিৎসক, শিক্ষক, ব্যাংকার, রাজনীতিবিদ, পুলিশ, সিনিয়র সহকারী সচিব, শিক্ষার্থী, অভিনেত্রী, শিশুসহ বিভিন্ন পেশার মানুষ। শুধু মৃত্যুতে শেষ নয়। প্রিয়জনকে হারিয়ে নিঃস্ব বহু পরিবারও। শেষ সম্বলটুকু বিক্রি করেও সন্তানকে বাঁচাতে পারেননি অনেকেই। সন্তান কিংবা পরিবারের একমাত্র উপার্জনকারীকে হারিয়ে ঢাকা ছেড়েছে কয়েকটি পরিবার। এদিকে হাসপাতালের বিছানায় কাতরাচ্ছেন হাজারো রোগী। ঢাকার বাইরেও ছড়িয়েছে ডেঙ্গু।
এতে আতঙ্কিত সাধারণ মানুষ। অনেকেই বলছেন, ঢাকা দুই সিটি করপোরেশনে ব্যাপক হারে ছড়িয়েছে ডেঙ্গু। অধিকাংশ বাসা-বাড়িতেই ডেঙ্গু আক্রান্ত রোগীর তথ্য মিলেছে। সরকারি হাসপাতালে ভর্তি হতে না পেরে প্রাইভেট ক্লিনিক ও বাসাবাড়িতে চিকিৎসা নিচ্ছে কেউ কেউ। সংশ্লিষ্টদের দাবি সরকারি হিসাব মতে ডেঙ্গুতে আক্রান্ত ও মৃত্যুর যে তথ্য প্রকাশ হচ্ছে, বাস্তবে তা কয়েকগুণ বেশি।
ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে ঢাকা মেডিকেল কলেজ (ঢামেক) হাসপাতালের আইসিইউতে চিকিৎসাধীন অবস্থায় গত ১১ই আগস্ট মৃত্যু হয় শরিফা বিনতে আজিজ (২৭) নামের এক নারী চিকিৎসকের। শুধু শরিফা নয়, ৮ই আগস্ট ভোরে ঢামেকের আইসিইউতে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান ডেঙ্গু আক্রান্ত আরেক নারী চিকিৎসক ডা. আলমিনা দেওয়ান মিশু। ২২শে জুন ঢামেকে মারা যান ডা. এম আরিফুর রহমান। তিনি বিসিএস স্বাস্থ্য ক্যাডারের ৩৯তম ব্যাচের কর্মকর্তা। একই রোগে আক্রান্ত হয়ে একইদিনে মারা যান সাভারের সমাজভিত্তিক মেডিকেল কলেজের চিকিৎসক ডা. ফাতেমা-তুজ-জোহরা রওনক। ৩২ বছর বয়সী ডা. রওনক মৃত্যুকালে দেড় বছর বয়সী ছেলে শিশুকে রেখে যান। ২৫শে জুলাই রাজধানীর আনোয়ার খান মডার্ন মেডিকেল কলেজের অষ্টম ব্যাচের শিক্ষার্থী সৈয়দা সাদিয়া ইয়াসমিন (রাইসা) মারা যান। তিনি এমবিবিএস শেষ বর্ষের শিক্ষার্থী ছিলেন। ১১ই আগস্ট সকালে রাজধানীর মগবাজারের ইনসাফ বারাকাহ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান ভিকারুননিসা নূন স্কুল অ্যান্ড কলেজের শিক্ষিকা মোরশেদা বেগম। ১৫ই আগস্ট ডেঙ্গুতে মারা যান আইডিয়াল স্কুল অ্যান্ড কলেজের শিক্ষার্থী আফিয়া জাহান। একই প্রতিষ্ঠানের আরেক শিক্ষার্থী ইশাত আজহার ১৬ই জুলাই রাজধানীর একটি বেসরকারি হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান। ২৫শে আগস্ট ডেঙ্গুতে মারা যান ব্যাংকার ফারজানা শারমিন। তিনি দৈনিক সমকালের যুগ্ম বার্তা সম্পাদক জাহেদ রুবেলের স্ত্রী।
এদিকে এক সপ্তাহের ব্যবধানে রাজধানীতে মারা গেছে দুই ভাইবোন। ডেঙ্গুতে দুই সন্তান হারিয়ে দিশাহারা তাদের বাবা-মা। সন্তানহারা বিলাপে ভারী হয়ে উঠেছে মধ্য পাইকপাড়া। ১৮ই আগস্ট ডেঙ্গুতে মারা যায় আরাফাত নামে ৯ বছর বয়সী পুত্র সন্তান। ২৫শে আগস্ট মারা যান ৬ বছর বয়সী কন্যা সন্তান রাইদা। ৩০শে আগস্ট চট্টগ্রামে মৃত্যু হয় আফনান নাছির বর্ষা (২১) নামের আরেক শিক্ষার্থীর। ৩রা আগস্ট ধানমণ্ডির একটি হাসপাতালে মৃত্যু হয় রুদ্র চন্দ্র সরকার নামে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের এক শিক্ষার্থী। ৬ই আগস্ট সকালে মাদারীপুরে একটি হাসপাতালে মারা যান আরিফা আক্তার নামে তৃতীয় শ্রেণির আরেক ছাত্রী।
ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে কয়েকদিন চিকিৎসা নিয়েও মুক্তি মেলেনি তরুণ অভিনেত্রী ও এইচএসসি পরীক্ষার্থী নিশাত আরা আলভিদা। গত ৩১শে আগস্ট মারা যান তিনি।
ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে চিকিৎসাধীন বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সহকারী সচিব এস. এম নাজিয়া সুলতানা ২৫শে জুলাই মারা যান। আট মাসের অন্তঃসত্ত্বা নাজিয়া সুলতানা মারা যাওয়ার দুইদিন আগে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছিলেন। ৩রা জুন সকালে রাজধানীর একটি বেসরকারি হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান ভিকারুননিসা নূন স্কুল অ্যান্ড কলেজের একাদশ শ্রেণির শিক্ষার্থী ইলমা জাহান। রাজধানীর আশা ইউনিভার্সিটির ইংরেজি বিভাগের অনার্স তৃতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী মুমতারিনা মাহি ঐশ্বর্য মারা যান ২৮শে আগস্ট। ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হলে ঢাকার সেন্ট্রাল ইন্টারন্যাশনাল মেডিকেল কলেজ হসপিটালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় তার মৃত্যু হয়। ২৭শে জুলাই রাজবাড়ীর বালিয়াকান্দিতে ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে ৯ মাসের অন্তঃসত্ত্বা রুমা বিশ্বাস নামের এক নারীর মৃত্যু হয়েছে। ওই সময় তার গর্ভে থাকা শিশুটিও মারা যায়।
গত ২১শে আগস্ট চট্টগ্রামে মারা যান এমাদুল হোসেন (৩২) নামে এক পুলিশ সদস্য। এর আগে গত ৭ই জুলাই চট্টগ্রামে ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে শ্রাবন্তী সরকার নামে ১১ বছর বয়সী আরেকটি শিশুর মৃত্যু হয়। শ্রাবন্তী সরকার নগরীর সেন্ট স্কলাসটিকা স্কুলের পঞ্চম শ্রেণির শিক্ষার্থী ছিল। ২১শে আগস্ট রাতে ফরিদপুর বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে মারা যান শাহ আলম নামের এক চাকরিজীবী। ২২শে আগস্ট যশোরের ইবনে সিনা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মৃত্যু হয় আকরামুল আলম নামের এক স্কুল শিক্ষকের। ৩০শে আগস্ট ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে মারা যান নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশন (নাসিক) ৫ নম্বর ওয়ার্ড পঞ্চায়েত কমিটির সভাপতি ও আওয়ামী লীগ নেতা আনিসুর রহমান। ১৪ই জুন ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে ফারজান আহমেদ ওরফে রাফি নামের এক বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রের মৃত্যু হয়েছে। ফারজান আহমেদ রাজশাহী প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের (রুয়েট) ইলেক্ট্রিক্যাল অ্যান্ড ইলেক্ট্রনিকস ইঞ্জিনিয়ারিং চূড়ান্ত বর্ষের ছাত্র ছিলেন।
৩১শে আগস্ট সাভারে ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে রওনক মৃধা (১১) নামের এক স্কুল শিক্ষার্থীর মৃত্যু হয়েছে। মারা যাওয়া রওনক আশুলিয়ার ইয়ারপুর ইউনিয়নের শিমুলতলা এলাকার মহসিন মৃধার মেয়ে। সে সৃষ্টি সেন্ট্রাল স্কুল অ্যান্ড কলেজের পঞ্চম শ্রেণির শিক্ষার্থী ছিল।
চলতি বছরে এখন পর্যন্ত একদিনে সর্বোচ্চ ১৯ জনের মৃত্যু হয়েছে। ৩১শে আগস্ট পর্যন্ত সরকারি হিসেবে ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে মোট প্রাণ হারিয়েছেন ৫৯৩ জন। এর মধ্যে আগস্ট মাসেই প্রাণ হারিয়েছেন ৩৪২ জন। হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন আরও ৭১ হাজার ৯৭৬ জন। এরমধ্যে একদিনেই সর্বোচ্চ আক্রান্ত হয়েছেন ২ হাজার ৯৫৯ জন। ডেঙ্গুতে মৃত্যু ও আক্রান্তদের পর্যালোচনায় নারী ও শিশুদের হার সবচেয়ে বেশি। এদিকে চলতি বছরে এখন পর্যন্ত ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল ও রাজধানীর মুগদা মেডিকেল কলেজে চিকিৎসাধীন অবস্থায় ২ শতাধিক ডেঙ্গু রোগীর মৃত্যু হয়েছে বলে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের হেলথ ইমার্জেন্সি অপারেশন সেন্টার ও কন্ট্রোল রুমের তথ্যে উঠে এসেছে।
আরো পড়ুন : নিউ ইয়র্ক টাইমসের মতে নীরবে ধ্বংস করা হচ্ছে বাংলাদেশের গণতন্ত্রকে, কাঠগড়ায় মিলিয়ন মিলিয়ন মানুষ