ডেঙ্গুর হটস্পটগুলোর বেশির ভাগই ঢাকার উত্তর সিটিতে 

জনদুর্ভোগ প্রচ্ছদ মুক্তমত লাইফ স্টাইল স্বাস্থ্য কথা হ্যালোআড্ডা

ডেঙ্গুর নতুন হটস্পট এখন ঢাকার উত্তর সিটি করপোরেশন এলাকা। ডেঙ্গুতে সর্বোচ্চ সংক্রমিত ১৫ এলাকার ১১টিই ঢাকা উত্তর সিটিতে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার এক প্রতিবেদনে এমন চিত্র উঠে এসেছে। সম্প্রতি প্রতিবেদনটি প্রকাশ করেছে সংস্থাটি। প্রতিবেদন অনুযায়ী, এক মাসের ব্যবধানে ঢাকার সবচেয়ে বেশি সংক্রমিত থানা পল্লবীতে। এখানে ডেঙ্গু রোগীর সংখ্যা বেড়েছে ৬৪ শতাংশ। সবচেয়ে বেশি ১২২ শতাংশ বেড়েছে মিরপুরে।

এ বিষয়ে দেশের খ্যাতিমান ভাইরোলজিস্ট, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক ভিসি অধ্যাপক ডা. নজরুল ইসলাম বলেন, মশা নিধনে আমরা অন্ধকারে আছি। উত্তর সিটি করপোরেশনে মশা নিধনে গাছাড়া ভাব লক্ষ্য করছি। আর এতেই উত্তর সিটি করপোরেশন এলাকায় ডেঙ্গুর নতুন হটস্পট বেশি দেখা যাচ্ছে। তিনি আরও বলেন, দক্ষিণের চেয়ে উত্তরে এডিস মশার লার্ভা বা শূককীট অনেক বেশি।

বাসিলাস থুরিনজেনসিস ইসরায়েলেনসিস (বিটিআই) নামের ব্যাকটেরিয়ার প্রয়োগে উত্তর সিটি করপোরেশন ব্যর্থ হয়েছে। কোনো কাজে আসছে না। কোনো ভালো কর্মসূচি দেখছি না। সাধারণ মানুষকে সম্পৃক্ত করার দরকার ছিল। তাও করতে পারেনি। যেটা পাশের দেশের ওয়েস্ট বেঙ্গলে করতে পেরেছে।

কীটতত্ত্ববিদ ও গবেষক, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. কবিরুল বাশার বলেন, উত্তর সিটিতে মশার ঘনত্ব বেশি। উত্তর সিটির মশা নির্মূলে কিছুটা ভাটা পড়েছে। বিটিআই প্রয়োগেও ব্যর্থ। তিনি বলেন, বর্তমানে কর্মসূচিতে ঢিলেঢালা ভাব। তিনি বলেন, যেখানে মানুষের ইমিউনিটি সিস্টেমে এন্টিবডি কম থাকে সেখানে রোগী বেশি পাওয়া যায়। এখন গ্রামেও রোগী বাড়ছে। এখন প্রকৃতির ওপর ভরসা করে থাকাকেই বোধ হয় শ্রেয় মনে করা হচ্ছে।

চলতি বছর ডেঙ্গুর ব্যাপক প্রকোপ শুরু হওয়ার পর ঢাকার দুই সিটির মধ্যে যাত্রাবাড়ী ছিল সবচেয়ে বেশি আক্রান্ত এলাকা। ঢাকা দক্ষিণ সিটির এই এলাকা আগস্ট মাসের শুরুতেও ছিল ডেঙ্গুর হটস্পট। শুধু যাত্রাবাড়ী নয়, ঢাকার দুই সিটির মধ্যে যে ১০টি এলাকায় আক্রান্তের সংখ্যা বেশি ছিল, এর ছয়টিই ছিল দক্ষিণ সিটির। তবে পরিস্থিতি পাল্টে গেছে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (ডব্লিউএইচও) এক প্রতিবেদনে দেখা গেছে, আগস্ট মাসের শেষ সপ্তাহে নগরীর সর্বোচ্চ সংক্রমিত ১৫টি এলাকার মধ্যে ১১টিই ঢাকা উত্তর সিটির। এর মধ্যে ১০টি স্থানেই ডেঙ্গুর সংক্রমণ বাড়ছে। আগস্ট মাসের শেষ সপ্তাহে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের বর্ষাকালীন মশার জরিপে দেখা গেছে, দক্ষিণের চেয়ে উত্তরে এডিস মশার লার্ভা বা শূককীট অনেক বেশি। এখন উত্তর সিটিতে মশার লার্ভার উপস্থিতি অনেক বেশি হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে রোগী বেড়ে যাওয়ার সম্পর্ক থাকতে পারে বলে মনে করেন জনস্বাস্থ্যবিদ এবং আইইডিসিআর-এর উপদেষ্টা ডা. মুশতাক হোসেন। তিনি বলেন, কর্তৃপক্ষের আত্মতুষ্টিতে ভোগার কারণেই হয়তো এখানে ডেঙ্গু বাড়তে শুরু করেছে। ঢাকা উত্তরে তাই ডেঙ্গু বাড়ছে।

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা ২০শে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত দেশের ডেঙ্গু পরিস্থিতি বিশ্লেষণ করে একটি প্রতিবেদন দিয়েছে। প্রতিবেদনে আগস্ট মাসের শেষ সপ্তাহে ঢাকার ১৫টি থানার ডেঙ্গু সংক্রমণের চিত্র তুলে ধরা হয়। বেশি সংক্রমণ হওয়া ১১টিই ঢাকা উত্তর সিটির মধ্যে পড়েছে। এর মধ্যে শীর্ষে আছে পল্লবী এলাকা। দ্বিতীয় ও তৃতীয় স্থানে আছে উত্তরা ও বাড্ডা এলাকা। তিনটি এলাকাই ঢাকা উত্তর সিটির মধ্যে পড়েছে। বাকি সাত এলাকা হলো-ক্যান্টনমেন্ট, দক্ষিণখান, মিরপুর, গুলশান, রামপুরা, কাফরুল, খিলক্ষেত ও মোহাম্মদপুর। মোহাম্মদপুর বাদ দিয়ে উত্তর সিটির ১০টি থানাতেই ডেঙ্গু রোগীর সংখ্যা বাড়ছে। প্রতিবেদন অনুযায়ী, এক মাসের ব্যবধানে ঢাকার সবচেয়ে বেশি সংক্রমিত থানা পল্লবীতে ডেঙ্গু রোগীর সংখ্যা বেড়েছে ৬৪ শতাংশ। সবচেয়ে বেশি ১২২ শতাংশ বেড়েছে মিরপুরে।

১৫টি বেশি সংক্রমণ এলাকার মধ্যে দক্ষিণ সিটির থানাগুলো হলো-যাত্রাবাড়ী, কদমতলী, সবুজবাগ ও খিলগাঁও। সবক’ট এলাকাতেই সংক্রমণ কমছে। যাত্রাবাড়ীতে রোগী কমেছে প্রায় ৭০ ভাগ। দক্ষিণের আরেক ডেঙ্গুপ্রবণ এলাকা সবুজবাগে ৬০ ভাগের বেশি রোগী কমেছে।

মশা নিয়ন্ত্রণে ড্রোন ওড়ানো, গাপ্পি মাছের ব্যবহার আর সর্বশেষ এডিস মশার লার্ভা নির্মূলে প্রথমবারের মতো ‘বাসিলাস থুরিনজেনসিস ইসরায়েলেনসিস (বিটিআই)’ নামে একধরনের ব্যাকটেরিয়ার প্রয়োগ এমন নানা উদ্যোগ নেয় উত্তর সিটি। তারা বিটিআই আনতে মার্শাল অ্যাগ্রোভেট কেমিক্যাল ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেডকে কাজ দেয়। এ প্রতিষ্ঠানের নিবন্ধনই ছিল না। প্রতিষ্ঠানটি সিঙ্গাপুরের বেস্ট কেমিক্যাল লিমিটেড থেকে বিটিআই আনার কথা বলে আনে চীন থেকে। তবে সেই বিটিআই কার্যকর বলে জানায় সরকারের দুটি সংস্থা। তবে কার্যকর হলেও উত্তর সিটি সূত্র জানাচ্ছে, বিটিআই নিয়ে কেলেঙ্কারির পর এর ব্যবহারই বন্ধ হয়ে গেছে।

উত্তর সিটির ৭৫ শতাংশ এলাকায় এডিস মশার লার্ভার ঘনত্ব বা বিআই ২০ শতাংশের বেশি। দক্ষিণ সিটির ১৯ ভাগ এলাকায় বিআইয়ের পরিমাণ ২০-এর বেশি।

ডেঙ্গুতে একদিনে আরও ১৩ প্রাণহানি: দেশে ডেঙ্গুতে ২৪ ঘণ্টায় আরও ১৩ জনের মৃত্যু হয়েছে। এ পর্যন্ত ১০৩০ জনের প্রাণ গেছে ডেঙ্গুতে। একদিনে আরও ২ হাজার ৭৯৯ রোগী হাসপাতালে চিকিৎসা নিতে ভর্তি হয়েছেন। দেশে ইতিমধ্যে ডেঙ্গু রোগী মৃত্যু ও শনাক্তে পুরনো সব রেকর্ড ভেঙে নতুন রেকর্ড সৃষ্টি হয়েছে। রাজধানীর চেয়ে দ্বিগুণের বেশি রোগী শনাক্ত হচ্ছে গ্রামে। মৃত্যুও বেশি গ্রামে। চলতি বছরের এ পর্যন্ত ২ লাখ ১১ হাজার ৬৮৩ জন ডেঙ্গু রোগী হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন। এর মধ্যে রাজধানীতে ৮৫ হাজার ১৪০ জন এবং ঢাকার বাইরে ১ লাখ ২৬ হাজার ৫৪৩ জন। মৃত ১০৩০ জনের মধ্যে নারী ৫৮৩ জন এবং পুরুষ ৪৪৭ জন। মোট মৃত্যুর মধ্যে ঢাকার বাইরে মারা গেছেন ৩৬৮ জন এবং রাজধানীতে ৬৬২ জন।

ডেঙ্গু বিষয়ক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, গত ২৪ ঘণ্টায় ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হওয়া ২ হাজার ৭৯৯ জনের মধ্যে ঢাকার বাসিন্দা ৬৮২ জন এবং ঢাকার বাইরে ২ হাজার ১১৭ জন। বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়েছে, নতুন ২ হাজার ৭৯৯ জনসহ বর্তমানে দেশের বিভিন্ন সরকারি ও বেসরকারি হাসপাতালে সর্বমোট ভর্তি থাকা ডেঙ্গু রোগীর সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ৯ হাজার ১৯৮ জনে। ঢাকার বিভিন্ন সরকারি ও বেসরকারি হাসপাতালে ভর্তি আছেন ২ হাজার ৯৪০ জন এবং ঢাকার বাইরে ৬ হাজার ২৫৮ জন। চলতি বছরে এ পর্যন্ত ২ লাখ ১১ হাজার ৬৮৩ জন ডেঙ্গু রোগী হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন। ভর্তি রোগীর মধ্যে পুরুষ আক্রান্ত ১ লাখ ২৮ হাজার ৫১৮ জন এবং নারী ৮৩ হাজার ১৬৫ জন। সুস্থ হয়ে বাড়ি ফিরেছেন ২ লাখ ১ হাজার ৪৫৫ জন। অধিদপ্তরের তথ্য মতে, চলতি বছরের জানুয়ারি মাসে ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন ৫৬৬ জন এবং মারা গেছেন ৬ জন, ফেব্রুয়ারিতে আক্রান্ত ১৬৬ জন এবং মারা গেছেন ৩ জন, মার্চে ভর্তি রোগীর সংখ্যা ১১১ জন এবং এপ্রিলে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন ১৪৩ জন এবং মারা গেছেন ২ জন। মে মাসে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন ১ হাজার ৩৬ জন এবং মারা গেছেন ২ জন। জুন মাসে ৫ হাজার ৯৫৬ জন এবং মারা গেছেন ৩৪ জন। জুলাইতে শনাক্ত ৪৩ হাজার ৮৫৪ জন এবং মারা গেছেন ২০৪ জন। আগস্টে ৭১ হাজার ৯৭৬ জন শনাক্ত এবং প্রাণহানি ৩৪২ জন। সেপ্টেম্বরে শনাক্ত রোগী ৭৯ হাজার ৫৯৮ জন এবং মারা গেছেন ৩৯৬ জন। অক্টোবরের ৩ দিনে শনাক্ত রোগীর সংখ্যা ৮ হাজার ২৭৭ জন এবং মৃত্যুবরণ করেছে ৪১ জন। তবে বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ডেঙ্গু আক্রান্তের সংখ্যা আরও বেশি হবে। কারণ অনেক ডেঙ্গু রোগী বাসায় থেকে চিকিৎসা নেন, তাদের হিসাব স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের খাতায় নেই।

আরো পড়ুন : ড. ইউনূসসহ গ্রামীণ টেলিকমের ৭ জনকে দুদকে তলব

Share The News

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *