ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় (ঢাবি) শাখা ছাত্রলীগের নেতাকর্মীদের পক্ষে ‘সাফাই’ গেয়ে সোশ্যাল মিডিয়ায় একটি স্ট্যাটাস দিয়েছেন বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের কেন্দ্রীয় সমন্বয়ক সারজিস আলম।
তার দাবি, ঢাবির হলগুলোতে ছাত্রলীগের যে কমিটি হতো তাতে প্রায় ৮০ ভাগ শিক্ষার্থী থাকতেন বিভিন্ন সুবিধার জন্য। আর তারাই আন্দোলনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছেন। শুধু তাই নয়, ছাত্রলীগের এসব পোস্টেড ও নন পোস্টেড নেতারা ১৫ জুলাই পর্যন্ত আন্দোলন চালিয়ে না নিলে ৫ আগস্ট কখনো সম্ভব হতো কিনা সন্দেহ আছে৷
সোমবার রাতে ‘একটা বিষয়ে স্পষ্ট দ্বিমত প্রকাশ করতে চাই’ শীর্ষক শিরোনামে লেখা দীর্ঘ একটি স্ট্যাটাসে এমন মতামত প্রকাশ করেন সারজিস।
এই সমন্বয়ক এমন সময় এ মন্তব্য করলেন যার পাঁচদিন আগেই সন্ত্রাসী কাজে জড়িত থাকার অভিযোগে আওয়ামী লীগের ছাত্র সংগঠন ছাত্রলীগকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করেছে সরকার। ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগের এই ছাত্র সংগঠনের বিরুদ্ধে কোটা সংস্কার ও সরকার পতন আন্দোলন চলাকালে ছাত্র-জনতা হত্যা ও অসংখ্য মানুষের জীবন বিপন্ন করা এবং বিভিন্ন সময় সন্ত্রাসী কাজে জড়িত থাকার অভিযোগ আনা হয়েছে।
সরকারি চাকরিতে কোটা পদ্ধতি সংস্কারের দাবিতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আন্দোলনের সময় গত ১৫ জুলাই প্রথম শিক্ষার্থীদের ওপর হামলা করে ছাত্রলীগ। এতে তিন শতাধিক শিক্ষার্থী আহত হন। তাদের মধ্যে অনেক ছাত্রীও ছিলেন। আন্দোলনকারীদের ওপর হামলার একপর্যায়ে ধারালো অস্ত্র, রড ও লাঠিসোটা হাতে থাকা ছাত্রলীগ নেতাকর্মীর দখলে চলে যায় ক্যাম্পাস। সংঘর্ষের সময় অনেককেই আগ্নেয়াস্ত্র হাতে দেখা গেছে। হামলার প্রতিবাদে পরদিন সারা দেশে শিক্ষার্থীদের আন্দোলনে শুরু হলে বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে পুলিশের গুলিতে নিহত হন আবু সাঈদ। এরপর থেকে ৫ আগস্ট পর্যন্ত বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ও ক্ষমতাসীন দলের নেতাকর্মীদের হামলায় সহস্রাধিক ছাত্র-জনতা শহিদ হন।
স্ট্যাটাসে সারজিস আলম বলেন, বিষয়টা শুধু ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়কে কেন্দ্র করে৷ যেহেতু অন্য ক্ষেত্র নিয়ে আমার ক্লিয়ার আইডিয়া নেই। তাই সেসব রিলেট না করার জন্য আহবান করছি৷ এবার আরেক প্রসঙ্গে আসি৷ হলের যে ছাত্রলীগের কমিটি হতো এখানে প্রায় ৮০ শতাংশ শিক্ষার্থী কমিটিতে থাকত কিছু কারণে। যেমন- ভালো একটা রুম বা সিট যেন পাওয়া যায়, যেন চাকরি হওয়া পর্যন্ত হলে থাকা যায়, অন্যরা যেন তার ওপর অন্যায় না করে বা ট্যাগ না দেয়, বাকি ২০ শতাংশের মধ্যে অনেকে ক্ষমতার অপব্যবহার করত, অনেকে ভিন্নমতের লোকদের ওপর অত্যাচার করত, অনেকে নেতা হওয়ার জন্য প্রার্থী হতো, অনেকে একটু ফাপর নিয়ে চলত৷
তিনি বলেন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রিক এই প্রথম ধাপের ১৬-১৭ দিনের আন্দোলনে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে ওই ৮০ ভাগ স্টুডেন্ট ৷ তারা যেমন পোস্টেড ছিল তেমনি হলের তুলনামূলক ক্লিন ইমেজ প্রভাব রাখা ফেস ছিল৷ তারা হল থেকে ব্যানার নিয়ে আন্দোলনে ঐক্যবদ্ধভাবে নেমেছিল বলেই অন্য নন-পোস্টেড সাধারণ শিক্ষার্থীরা তাদের সঙ্গে বের হয়ে আসতে পেরেছিল এবং এ কারণেই ক্যান্ডিডেটরা হল থেকে প্রোগ্রাম নিয়ে আন্দোলনে আসা আটকাতে পারেনি৷ এই পোস্টেড ছেলেরা হল থেকে এক হয়ে বের না হলে নন-পোস্টেডরাও এক হয়ে বের হয়ে আসার সাহস করতে পারত না৷ ওই গার্টস আর বোল্ডনেস এই ছেলেগুলাই শো করতে পারে৷ হলের পার্সপেক্টিভে সত্য এটাই যে, এই পোস্টেড তুলনামূলক ক্লিন ইমেজের হলের ছেলেরা আন্দোলনে এসেছিল বলেই ১ জুলাই থেকে ১৫ জুলাই সম্ভব হয়েছিল এবং আন্দোলনটাকে প্রাথমিকভাবে অন্য কোনো দলের বা সরকারবিরোধী ট্যাগ দেওয়া যায়নি ৷
১৫ জুলাই পর্যন্ত আন্দোলন না আসলে ৫ আগস্ট কখনো সম্ভব হতো কিনা সে বিষয়ে ঢের সন্দেহ আছে বলে মনে করেন সারজিস।
স্ট্যাটাসে নিজেই প্রশ্ন ছুড়ে দিয়ে জুলাই শহিদ স্মৃতি ফাউন্ডেশনের সাধারণ সম্পাদক আরও বলেন, এই পোস্টেড ছেলেগুলোকে আমি ছাত্রলীগ ট্যাগ দিয়ে নিষিদ্ধের কাতারে ফেলব কিনা৷
উত্তরে সারজিস বলেন, ফেলব না৷কারণ হিসেবে তিনি বলেন, যারা ১ জুলাই থেকে আমাদের সঙ্গে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে নিজের জীবন বাজি রেখে রাজপথে ন্যায়ের পক্ষে নিজের অবস্থান জানান দিয়েছে, তারা তাদের পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে গিয়েছে৷ সত্য এটাই যে, এই আন্দোলন সফল না হলে এই ছেলেগুলোকেই সবচেয়ে বেশি ভোগান্তি পোহাতে হতো৷ বিশ্বাসঘাতক ট্যাগ দেওয়া হতো৷
যে সিস্টেমের কারণে এদেরকে বাধ্যতামূলক ছাত্রলীগের রাজনীতি করতে হয়েছে, পোস্ট নিতে হয়েছে সেই সিস্টেমের জন্য দায়ী হলে আপনাদের সবাইকে দায়ী হতে হবে৷ কারণ আপনারা চুপ ছিলেন৷ হলে ও ক্যাম্পাসে দিনের পর দিন ওদের সঙ্গে হওয়া অন্যায়ে কেউ বাধা দেননি৷ ওরা যদি সেফটি অ্যান্ড সিকিউরিটির জন্য পোস্ট নেয় তবে আপনিও নিজের গা বাঁচাতে চুপ ছিলেন৷ বরং যখনই সুযোগ হয়েছে ওরা সাহস করে ঐক্যবদ্ধ হয়ে রাজপথে নেমে এসেছে৷ আর তখনো আপনি নিরব দর্শক হয়ে অনেক কিছু শুধু দেখে গেছেন৷
‘এই ৮০ ভাগ ছেলের কেউ যদি পূর্বে কোনো অন্যায়ের সঙ্গে জড়িত থাকে তবে তদন্ত সাপেক্ষে তার শাস্তি হোক, কেউ যদি পরে কোনো অন্যায়ে জড়িত হয় তবে তদন্ত সাপেক্ষে তারও শাস্তি হোক৷ কিন্তু যখন দরকার ছিল তখন রাজপথে নামালাম আর এখন ক্যাম্পাসে ছাত্রলীগের পোস্টেড দেখেই গণহারে গ্রেফতার হবে এটা কখনোই সমর্থন করি না৷ এটা হতে পারে না’৷
সারজিস বলেন, যারা সময়ের প্রয়োজনে ন্যায়ের পক্ষে ছাত্রলীগের সব বাধা উপেক্ষা করে আমার সঙ্গে জীবন বাজি রেখে রাজপথে নেমেছে তারা আমার ভাই৷ ২৪ এর অভ্যুত্থানের যোদ্ধা৷ আমি তাদের পক্ষে থাকব৷ সত্য সত্যই৷ কে কী বলল তাতে আমার কিছু যায় আসে না।
আরো পড়ুন : ২৮ নভেম্বর ২০২৪, গোবিন্দগঞ্জের যত খবর