সূফী সাধক সব সময় মৃত্যুকে আলিঙ্গন করতে চেয়েছেন হাসিমুখে। কবিতায় সাহিত্যে মৃত্যুকে কখনো বর্ণিল বলা হয়েছে কখনো হয়তো কঠিন। মৃত্যু তো অবধারিত। কিন্তু বর্তমানে অপমৃত্যু সামাজিক ব্যাধিতে রূপ নিয়েছে। সামাজিক অবক্ষয়, পারিবারিক কলহ, নেশা, সোশ্যাল হ্যান্ডেলে বিভিন্ন অ্যাপসে আসক্ত হয়ে অনেকেই নিজেদের সুইসাইডের মতো ভয়ঙ্কর পথ বেছে নিচ্ছে।
সম্প্রতি টিভি অভিনেত্রী হুমায়রা হিমুর আত্মহত্যায় শোবিজ তারকাদের মধ্যে ব্যাপক প্রতিক্রিয়া হয়েছে। তার মতো অনেকেই শোবিজে রয়েছেন যারা অর্থের মোহে বিভিন্ন অনৈতিক কর্মকাণ্ডের সঙ্গে নিজেদের সম্পৃক্ত করেছেন। এসব অপমৃত্যুর কারণ যে শুধু অর্থনৈতিক বিষয় জড়িত তা নয়। ডলি আনোয়ার, নাট্য অভিনেত্রী ডালিয়া রহমান, তাজিন আহমেদ, মিতা নূর, সিনেমার সুপার হিরো সালমান শাহ, জনপ্রিয় ‘ধারাবাহিক এইসব দিনরাত্রি’র টুনি চরিত্রের অভিনেত্রী, জনপ্রিয় মডেল তিন্নি যারা জনপ্রিয়তার শীর্ষে থেকেও কোথাও যেন তাদের ব্যক্তি জীবনে নানান সমস্যায় জড়িত ছিলেন। দর্শকরা পর্দায় ঐসব শিল্পীর অভিনয় দেখে মুগ্ধ হতেন ঠিকই কিন্তু যিনি দর্শকদের আনন্দ দিচ্ছেন ঠিক তার উল্টো চিত্র মিলতো তাদের ব্যক্তি বা পারিবারিক জীবনে। শিল্পীরা নিজেদের সমাজের অন্য দশজন থেকে আলাদা মনে করেন। কারণ তারা আকাশের তারা।
তারকা হওয়া যত না কঠিন ঠিক তার উল্টো চিত্র ইমেজ ধরে রাখা। সিনেমা বা ছোট পর্দা যাই বলি না কেন একজন অভিনেতা বা অভিনেত্রী যখন তাদের সাবলীল অভিনয় দিয়ে শীর্ষে পৌঁছে যান সেই সময়টা শিল্পীদের জীবনে ভয়ঙ্কর সময়। জনপ্রিয়তা বা অর্থ যখন স্রোতের মতো আসতে থাকে সেই সময় অনেকেই খেই হারিয়ে ফেলেন। বিপদগামী বা উচ্ছৃঙ্খল জীবনে অভ্যস্ত হয়ে পড়েন। অর্থের মোহে পড়ে নিজেদের বিভিন্ন অনৈতিক কর্মকাণ্ডের সঙ্গে জড়িয়ে ফেলেন। নদীতে যেমন জোয়ার- ভাটা রয়েছে তেমনি শিল্পীদের জীবনেও উত্থান-পতন রয়েছে। শীর্ষে থাকা কোনো শিল্পী যখন হঠাৎ জনপ্রিয়তার শূন্য কোঠায় পৌঁছায় সেই সময় অনেকেই দিশাহারা হয়ে পড়েন। কারণ জনপ্রিয়তা বা চাহিদা হ্রাস মানেই কাজ কমে যাওয়া, অর্থনৈতিক মন্দা। আমাদের শোবিজে এমন অনেক শিল্পী রয়েছেন যাদের ব্যস্ততা নেই নাটক কিংবা সিনেমায়। কিন্তু তাদের জীবনযাত্রা বিলাসিতা চোখে পড়ার মতো। তাদের অর্থের উৎস কোথায়? গণমাধ্যমের অনেকেই ঐসব উচ্ছৃঙ্খল শিল্পীদের অর্থের উৎস জানেন কিন্তু প্রকাশ করেন না। তাতে বিনোদন জগতের বাসিন্দাদের সম্পর্কে দর্শকদের মনে বাজে ধারণা হবে। অবশ্য সবাই যে উচ্ছৃঙ্খল তা কিন্তু নয়। আর সবচেয়ে বড় কথা হচ্ছে একজন অভিনেত্রীকে মিথ্যা স্বপ্ন-অর্থের লোভ সব কিন্তু এই পেশায় সম্পৃক্ত ব্যক্তিই দেখায়। অনেক অভিনেত্রীর সরলতার সুযোগ নিয়ে তাদের অন্ধকার জগতের পথে নিয়ে যায়। শিল্পীদের আত্মহত্যা সাধারণ মানুষের মনে তাদের সম্পর্কে নেতিবাচক ধারণার জন্ম দেয়। তারা কেন এই আত্মহনন পথ বেছে নেন সেই সব কথা উঠে এসেছে তারকাদের কথোপকথনে।
নাদিয়া আহমেদ (টিভি অভিনেত্রী) : হুমায়রা হিমুর এই মৃত্যু পুরো শিল্পী পরিবারকে মর্মাহত করেছে। ওর সঙ্গে আমি চলতি ধারাবাহিক ‘বকুলপুর সিজন টু’ এবং ‘বউ বিভ্রাট’ দুটি নাটকে কাজ করেছি। ওর মতো এত প্রতিভাবান অভিনেত্রী শুধু অভিনেত্রীই নয়-হাতের অন্যান্য কাজ যেমন-গহনা তৈরি করা, কাপড় সেলাই, সব কাজে পটু ছিল সে। তার মা’র মৃত্যুই তাকে একাকিত্বে পেয়ে বসেছিল। মা’র মৃত্যুই তাকে ধীরে ধীরে সবকিছু থেকে দূরে সরিয়ে দিয়েছিল। অভিনেতা-অভিনেত্রীদের ক্যারিয়ারে যোগ-বিয়োগ থাকবেই। অভিনয় জীবন এত মসৃণ নয়। দর্শকরা শুধু শোবিজ তারকাদের হাসিমুখ দেখতেই অভ্যস্ত। আর আমরাও আমাদের ভেতরের দুঃখ-কষ্ট লুকিয়ে রাখি। যেটা করা উচিত নয়। পরিবারের সদস্যদের বা বন্ধুদের সঙ্গে যে কোনো সমস্যা নিয়ে আলাপ করা উচিত। সুইসাইড প্রবণতা আজকাল প্রবলভাবে দেখা দিচ্ছে সমাজে। যেহেতু আমরা শিল্পী তাই আমাদের খবরটা প্রচার হয়। সে তার একাকিত্ব দূর করার জন্য বিগো অ্যাপসকে বন্ধু করে নিয়েছিল। যা তার জীবনে মারাত্মক ভুল ছিল। আমি মাঝে মাঝে তাকে বুঝাতাম তুমি বাসা থেকে বের হও-একা একা থেকো না, ভালো বন্ধু বানাও বা বিয়ে-শাদী করে সংসার করো। উত্তরে সে বলতো একাই ভালো আছি। বিগো অ্যাপ-এ অনেক লোকের সঙ্গে কথা বলি, সময় কেটে যায়। আমি ব্যক্তিগতভাবে অনেক পরিচালকদের অনুরোধ করতাম তাকে নাটকে সুযোগ দেয়ার জন্য। অনেকেই কথা রেখেছেন। কিন্তু শুটিং করতে যেয়ে সারাক্ষণ বিগো লাইভে ঝুঁকে থাকতো। পরবর্তীতে পরিচালকরা বাধ্য হতো তাকে বাদ দিতে। সারা জীবন একাই থাকলো। বিয়েও করলো না। সে যাদের বন্ধু বলতো তারা সত্যিই কি তার বন্ধু ছিল? তাজিন আপু, মিতা নূর আপা এবার হিমু এদের অপমৃত্যু থেকেই আমাদের শিক্ষা নিতে হবে-এদের আমরা দোষী বলি। সত্যিই কি তারা একাই দোষী।
তানভীন সুইটি : অভিনেতা-অভিনেত্রীদের ব্যক্তি জীবনে অনেক গল্প থাকে- সেটা সাধারণ দর্শক বুঝতে পারে না। হুমায়রা হিমুর মতো একজন প্রাণোচ্ছল প্রতিভাবান শিল্পীর এই অপমৃত্যু কল্পনারও বাইরে। সময়কে মেনে নিতে হয়। জীবনে ঝড়ঝাপ্টা আসবেই সেটা মোকাবিলা করার মতো শিল্পীদের মানসিকতা থাকতে হবে। শোবিজ তারকাদের প্রতি দেশ ও জাতীয় প্রত্যাশা অনেক উঁচু থাকে। বেশকিছু মৃত্যু বিনোদন শিল্পীদের প্রশ্নবিদ্ধ করে দিয়েছে। আর সবচেয়ে বেশি যে বিষয়টা আমাদের সবাইকে খেয়াল রাখতে হবে সেটা হচ্ছে ভালো সার্কেল বানাতে হবে। সব সময় যে অভিনয়ের শীর্ষে থাকবেন-অর্থ কামাবেন এটা মিথ্যা কথা। সময়কে মেনে নিতে হবে। তারকা লাইভ লিড করার জন্য যত্রতত্র যাকে তাকে বন্ধু বানাতে হবে কেন? লোভ মারাত্মক ব্যাধি। যা আপনাকে অবশ্যই ধ্বংসের পথে নিয়ে যাবে। হিমুর এই পরিণতি একদিনে হয়নি। সে পরিচিত অভিনয় জগৎ থেকে নিজেকে গুটিয়ে কিছু বিপদগামী লোকদের বন্ধু বানিয়েছিল। তাজিন আহমেদ, মিতা নূর এরা সবাই হতাশায় ডুবে গিয়েছিল। আমি সুইটি কুড়ি বছর আগে কি এই পজিশনে ছিলাম। ত্রিশ দিনই ব্যস্ত ছিলাম শুটিং নিয়ে। আগের মতো ব্যস্ততা কী এখন আছে আমার? তাই বলে সবকিছু থেকে বিচ্ছিন্ন আমি নই। সহশিল্পীদের সবার সঙ্গে সৌজন্যপূর্ণ সম্পর্ক রেখেই প্রতিনিয়ত চলছি। অর্থের প্রতি অতি লোভ অবশ্যই আপনাকে ধ্বংস করে দিবে।
তাহমিনা সুলতানা মৌ : ডিপ্রেশন থেকে একজন প্রতিভাবান অভিনেত্রী হুমায়রা হিমু নিজেকে কিছু মুখোশধারী ভয়ঙ্কর ব্যক্তিদের বন্ধু বানিয়েছিল। আর তার খেসারত দিলো আত্মহত্যার মধ্যদিয়ে। হতাশা কার জীবনে নেই বলতে পারেন? আমরা সবাই কমবেশি হতাশার মধ্যদিয়ে জীবন পার করে দেই। তাই বলে অপমৃত্যু? অভিনয় জগৎ থেকে নিজেকে গুটিয়ে নিয়ে নিজেকে অন্য একজন জগতের বাসিন্দা বানিয়ে দিলো। আরে ভাই সব সময় কী অভিনয়ে ব্যস্ততা থাকবে। বয়স সময় সবকিছুই বিবেচনায় রাখতে হবে আমাদের। একটা সময় প্রচুর কাজ সে করেছে তার সেই কাজগুলো প্রশংসিত হয়েছিল। সেই কাজের ধারাবাহিকতা সে ধরে রাখতে পারেনি। সব সময় কী সুযোগ পাবেন আপনি। সময় কাল গল্প নাটকের পরিবর্তন হয় সেটা মেনেই চলা উচিত শিল্পীদের। শোবিজের একেকটা অপমৃত্যু সামাজিকভাবে আমাদের কাঠগড়ায় দাঁড় করিয়ে দিচ্ছে? এখন তো কাজের অনেক সুযোগ, অনেক টিভি চ্যানেল। প্রচুর কাজ হচ্ছে। হতাশার তো কিছু নেই। একটা কথা মনে রাখতে হবে সব সময়ই যে আপনি সুযোগ পাবেন সেটাও বিবেচ্য বিষয় নয়। অর্থকষ্ট কমবেশি শিল্পীদের জীবনে থাকেই। অনেক শিল্পী রয়েছেন যেভাবেই হোক সামাজিক স্ট্যাটাস বজায় রাখতে হবে কেন ভাই? সারাজীবন কি পোলাও খেতে হবে। আপনি আপনার থেকে নিচের দিকে তাকান, অনেকেই রয়েছে এ সমাজে একবেলা ঠিকমতো খেতে পায় না। তাই বলে কী তারা অন্যায় পথ বেছে নিচ্ছে।
রোজিনা : বেশ ক’বছর আগের কথা। আমি এবং হুমায়রা হিমু কোনো একটা চ্যানেলের অনুষ্ঠানে অতিথি ছিলাম। প্রোগ্রাম শেষ করে আমি উত্তরার বাসায় ফিরবো- ঐ সময় কোনো কারণে তার ট্রান্সপোর্টের অসুবিধা হচ্ছিল। আমি তাকে আমার গাড়িতে করে তার বাসায় পৌঁছে দেই। সে সময় সে বললো আপা আমি নিজে জুয়েলারি তৈরি করি। আপনাকে উপহার দিবো। অবশ্য এর আগেই তার নাটক বিভিন্ন চ্যানেলে দেখেছি। খুব ভালো অভিনয় করতো। তার এই মৃত্যু আমার মনে দাগ কেটে যায়। বিভিন্ন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে যে খবর প্রকাশ পাচ্ছে সত্যিই বেদনাদায়ক। আমাদের জীবনে অর্থই সবকিছুর মূল আমি সব সময় এটা মানি না। সম্মানটা অর্থের চেয়ে অনেক বড়।
অঞ্জনা : অভিনয় এমন একটা পেশা যে পেশায় সাফল্যের পরের শব্দটাই থাকে ব্যর্থতা। যার অবস্থান পাশাপাশি। একটু বেহিসেবী হলেই অর্জিত সম্মান মুহূর্তেই ধূলিস্যাৎ। আমিও একদিন নতুন ছিলাম অভিনয় জগতে। অনেক অধ্যবসায় আর ধৈর্যের পরই অঞ্জনা হতে পেরেছি। হুমায়রা হিমুর এ অপমৃত্যুর বিষয়টা পুরো শিল্পী পরিবারের জন্য দুঃসংবাদ। আমরা যারা অভিনেত্রী তাদের খুব সাবধানে পা ফেলতে হয়। এ পেশায় অনেক প্রলোভন, চোরা বাঁকও রয়েছে। শিল্পীরা অল্পতে যেমন সন্তুষ্ট ঠিক তেমনি ছোট কোনো ঘটনা তাকে অভিমানি করতে পারে। অর্থের চেয়ে জীবন অনেক মূল্যবান। আজকাল তো শোবিজও সিন্ডিকেটের কবলে। যা খুবই দুঃখজনক। অনেক প্রতিভাবান গুণী শিল্পী অভিমান করে শুটিংয়ের বাইরে রয়ে গেছেন। তারা কাজ পাচ্ছেন না। বেকারত্ব তাদের প্রতিনিয়ত কুরে কুরে খাচ্ছে। একদা একজন ব্যস্ত শিল্পী সিন্ডিকেটের কবলে পড়ে কর্মহীন হয়ে ঘরে বসে সময় কাটাচ্ছেন। শুধু কর্মহীনই হচ্ছেন না সঙ্গে অর্থকষ্টেও ভুগছেন। ধীরে ধীরে চেনা-জানা সহশিল্পীদের সঙ্গে দূরত্ব তৈরি করে নানান অনৈতিক কর্মকাণ্ডের সঙ্গে নিজেকে যুক্ত করে ধীরে ধীরে অন্ধকার পথে এগিয়ে যাচ্ছেন। একেকটা অপমৃত্যু আমাদের শিল্পী সমাজকে জনগণের মাঝে হেয় করে দিচ্ছে।
আরো পড়ুন : তিন ঘণ্টার ব্যবধানে রাজধানীতে ছয় বাসে আগুন দিল দুর্বৃত্তরা