আসছে না নতুন কোনো বিনিয়োগ। তারল্য সংকটে শেয়ারবাজারে লেনদেন এখন তলানিতে। দীর্ঘ সময় ধরে বিনিয়োগকারীদের একটি অংশ শেয়ার বিক্রি করে অপেক্ষা করছে। কেউ কেউ বিক্রি করতে পারছে না শেয়ার দর ফ্লোর প্রাইসে আটকে থাকার কারণে। নানা সংকটে প্রতিদিন শেয়ারবাজারে বিনিয়োগকারীদের পুঁজি উধাও হয়ে যাচ্ছে। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, অর্থনীতির সংকটে চরম মূল্য দিতে হচ্ছে শেয়ারবাজারে বিনিয়োগকারীদের। ব্যাংক ঋণের উচ্চ সুদহার, ডলার সংকটের সঙ্গে মিলেছে রাজনৈতিক অনিশ্চয়তা। বিনিয়োগকারীরা বলছেন, সরকারের কাছে গুরুত্ব হারিয়েছে শেয়ারবাজার। কর্তৃপক্ষ যেন ফিরেও দেখছে না শেয়ারবাজার পরিস্থিতি উন্নতি করতে।
অর্থনীতিবিদ অধ্যাপক আবু আহমেদ বলেন, বেশকিছু বিষয় নিয়ে মানুষের মধ্যে অনিশ্চয়তা কাজ করছে। এর মধ্যে আগামী জাতীয় নির্বাচনের একটি প্রভাব রয়েছে। অর্থনৈতিক বিভিন্ন সূচক নিম্নমুখী। দেশের দেনা বাড়ছে। ব্যালান্স অব পেমেন্টস নিম্নমুখী। ফলে বড় বিনিয়োগ করছে না। বিশেষ করে বিদেশি বিনিয়োগ এখন এক প্রকার বন্ধ আছে। নতুন বিনিয়োগ নেই। পাশাপাশি যারা শেয়ার বিক্রি করছে তারা নতুন করে ক্রয় করছে না। এর কারণে দীর্ঘ দরপতনের মুখে পড়েছে শেয়ারবাজার। জানা গেছে, চলতি বছরজুড়েই একটানা দরপতনে শেয়ারবাজারে ভয়াবহ জটিল পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে। গত বছর থেকে ডলার সংকট হলে শেয়ারবাজারে ভয়াবহ পতন শুরু হয়। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ করতে বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন (বিএসইসি) ফ্লোর প্রাইস (দর কমার নির্ধারিত সীমা) আরোপ করে। এরপর বাজার আর ঘুরে দাঁড়াতে পারেনি। তবে চলতি বছরের জুনে বাজার কিছুটা ঊর্ধ্বমুখী হয়ে উঠলেও এরপর ফের ভয়াবহ পতনের দিকে ছুটে চলেছে শেয়ারবাজার। অনেকে বলছেন, ২০১০ সালের পর এত বড় লোকসানে পড়তে হয়নি, যা বর্তমান ধসের কারণে হয়েছে। বিএসইসি বিভিন্ন সময় নানা ধরনের পদক্ষেপ নেওয়ার পরও বাজার ঘুরে দাঁড়াতে পারছে না। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, দ্রুত সময়ের মধ্যে বাজার আবার ঘুরে দাঁড়াবে। বিনিয়োগ ধরে রাখতে হবে। বিনিয়োগকারীদের বিনিয়োগ করা পুঁজি হারিয়ে অনেকেই দিশাহারা। প্রতিদিনই শেয়ার ও ইউনিটের দাম কমায় বিনিয়োগকারীদের লোকসানের পাল্লা ভারী হচ্ছে। পতনের হাত থেকে রক্ষা পাচ্ছে না শক্ত ভিতের ওপর দাঁড়িয়ে থাকা কোম্পানিগুলোও। লোকসান কমাতে দিশা খুঁজে পাচ্ছেন না সাধারণ বিনিয়োগকারীরা। চলমান দরপতনের পেছনে যুক্তিসংগত কারণ নেই বলে মনে করছেন শেয়ারবাজার বিশ্লেষকরাও। তারা বলছেন, টানা দরপতনের কারণে ভালো মৌল ভিত্তির অনেক কোম্পানির শেয়ারের দাম অবমূল্যায়িত হচ্ছে। বাজারসংশ্লিষ্ট ও বিনিয়োগকারীদের ধারণা, ফ্লোর প্রাইস দিয়ে আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচন পর্যন্ত বাজার আটকে রাখতে চাইছে সরকার। নির্বাচনের পর বাজার নিয়ে চিন্তা করবে। অন্যদিকে বিদেশে ডলার চলে যাবে এ আশঙ্কায় বহুজাতিক কোম্পানির লভ্যাংশ বিতরণ বন্ধ রয়েছে। তবে এর আগে সরকারের পক্ষ থেকেও বিভিন্ন সময়ে বেশকিছু প্রণোদনা বাজারে দেওয়া হয়েছে। কিন্তু এর কোনো কিছু দীর্ঘমেয়াদে কাজে আসেনি। বর্তমানে অলিখিতভাবেই চিহ্নিত কয়েকটি সিন্ডিকেট বাজার ওঠানো-নামানোর দায়িত্ব পালন করছে। অর্থনীতিবিদ ও বাজার সংশ্লিষ্টদের মতে, মোটা দাগে বাজারে দুটি সংকট। চাহিদার দিক থেকে সংকট হলো-এই বাজারের প্রতি বিনিয়োগকারীদের আস্থা নেই। ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের (ডিএসইর) সর্বশেষ বাজার লেনদেনে বড় ধরনের দরপতন হয়েছে। গতকালের বাজার লেনদেনে দেখা গেছে, ডিএসইতে সব খাত মিলে মাত্র ১৭টি প্রতিষ্ঠানের শেয়ার ও ইউনিটের দাম বেড়েছে। বিপরীতে দাম কমেছে ১৩৪টির। আর ১৩৯টির দাম অপরিবর্তিত রয়েছে। দাম অপরিবর্তিত থাকা বেশির ভাগ প্রতিষ্ঠান ফ্লোর প্রাইসে আটকে রয়েছে। ক্রেতা না থাকায় দীর্ঘদিন ধরে এসব প্রতিষ্ঠানের শেয়ার বিক্রি করতে পারছেন না বিনিয়োগকারীরা। দাম বাড়ার তুলনায় প্রায় ৮ গুণ বেশি প্রতিষ্ঠান দাম কমার তালিকায় স্থান করে নেওয়ায় ডিএসইর প্রধান মূল্যসূচক ডিএসইএক্স ২০ পয়েন্ট কমে ৬ হাজার ২০৯ পয়েন্টে অবস্থান করছে। ডিএসইতে লেনদেন কমে ৩০০ কোটি টাকার ঘরে চলে এসেছে। দিনভর বাজারটিতে লেনদেন হয়েছে ৩৬৯ কোটি ৯৬ লাখ টাকা। জানতে চাইলে বিএসইসির সাবেক চেয়ারম্যান ফারুক আহমেদ সিদ্দিকী বলেন, ফ্লোর প্রাইস দিয়ে বাজার একরকম অকার্যকর করে রাখা হয়েছে বলা যায়। কোথাও এটা নেই। পরিস্থিতি জটিল হলে সর্বোচ্চ এক সপ্তাহের জন্য দেওয়া হয় ফ্লোর প্রাইস। দিনের পর দিন বাজার অকার্যকর করে রাখার কোনো মানে নেই। এটা সান্ত্বনা ছাড়া আর কিছু নয়। সাহস করে যদি ফ্লোর প্রাইস উঠিয়ে দেওয়া হয় বাজার গতিশীল হয়ে উঠবে। জোর করে বাজারে কোনো ধরনের হস্তক্ষেপ ভালো কিছু নিয়ে আসে না। বাজার বিনিয়োগকারীদের ওপর ছেড়ে দিতে হবে। ক্রয়-বিক্রয় করার প্ল্যাটফরম করতে হবে। তবেই বাজারে তারল্য সংকট থাকবে না।
আরো পড়ুন : গাইবান্ধার ৫টি আসনে লাঙ্গলের হাল ধরলেন যারা