কোনো কারণ ছাড়াই ঢাকাই ছবি ও টিভির নায়িকারা আওয়ামী লীগের সংরক্ষিত আসনের মনোয়নপত্র কিনেছিলেন। তাদের হুড়োহুড়ি বিস্মিত করেছিল আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীদের। শেষ পর্যন্ত মনোনয়ন তালিকায় তাদের নাম না থাকায় স্বস্তি প্রকাশ করেছেন আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীরা। ধন্যবাদ জানিয়েছেন আওয়ামী লীগ সভানেত্রীকে। অন্যদিকে মনোনয়ন না পেয়ে হতাশ সেই সব আলোচিতরা। কারণ শোবিজ অঙ্গনে তারা এখন নেতিবাচকভাবে আলোচিত। জানা গেছে, একমাত্র তারানা হালিমের নাম সেখানে আছে। কিন্তু তারানা হালিম শোবিজের তারকার চেয়ে বেশি রাজনৈতিক নেতা হিসেবে পরিচিত। তিনি আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য। ধারণা করা হয়েছিল, শোবিজের অন্তত একজনকে হয়তো নেওয়া হবে, যেমনটি নেওয়া হয়েছিল গত বছর। সেবার সুবর্ণা মুস্তাফা রাজনৈতিক গন্ডির বাইরে থেকে এসে আওয়ামী লীগের সংরক্ষিত আসনের জন্য মনোনয়ন পেয়ে সবাইকে চমকে দিয়েছিলেন। এবার সংরক্ষিত আসনে তারানা হালিম ছাড়া শোবিজ জগতের কাউকেই মনোনয়ন দেওয়া হয়নি। যারা মনোনয়ন চেয়েছিলেন তাদের মধ্যে তারিন জাহানের নাম আলোচনায় ছিল এবং তিনি মনোনয়ন পেতে পারেন এমন গুঞ্জনও ছিল। সাম্প্রতিক সময়ে তাকে আওয়ামী লীগের বিভিন্ন ফোরামে অত্যন্ত সরব দেখা গেছে। নির্বাচনের সময় তিনি প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে কয়েকটি জনসভায়ও অংশগ্রহণ করেছিলেন। এজন্যই গুঞ্জন ছিল যে, ক্ষমতার বলয়ে তারিন জাহান হয়তো শেষ পর্যন্ত মনোনয়ন পেতে পারেন। এ ছাড়া শমী কায়সারকে নিয়ে আলোচনা ছিল। তবে শমী কায়সার যেহেতু এফবিসিসিআই- এর পরিচালক সেজন্য তিনি মনোনয়ন পাবেন না- এরকম একটি ইঙ্গিত আগে থেকেই ছিল। তা ছাড়া মনোনয়ন ফরম কিনেছিলেন যে একঝাঁক তারকা আওয়ামী লীগ এসব গ্ল্যামারের কাছে নিজেদের আত্মসমর্পণ করেননি। এটি আওয়ামী লীগের জন্য একটি ইতিবাচক দিক বলে মনে করেন দলটির নেতা-কর্মীরা। আওয়ামী লীগের মধ্যে এ ধরনের আতঙ্ক এবং শঙ্কা ছিল যে, শেষ পর্যন্ত সংরক্ষিত আসনগুলো যেন তারকাদের ক্লাবে পরিণত না হয়। কিন্তু আওয়ামী লীগ সভাপতি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এ ক্ষেত্রে বিচক্ষণতার পরিচয় দিয়েছেন। শোবিজ তারকাদের তিনি তালিকা থেকে বাদ দিয়ে একটি সুস্পষ্ট বার্তা দিয়েছেন যে, রাজনীতির জায়গা রাজনীতিবিদদের জন্যই। শোবিজের তারকারা অবশ্যই আওয়ামী লীগের জন্য কাজ করবেন, ভূমিকা রাখবেন কিন্তু তাদের কর্মক্ষেত্র আলাদা। সংস্কৃতি অঙ্গন থেকেই তারা তাদের দায়িত্ব পালন করবেন এমন একটা বার্তা এবার দেওয়া হলো। দেশের সচেতন নাগরিকরা বলছেন, আওয়ামী লীগ রাজনৈতিক দল। এখানে আদর্শ, নীতি এবং দলের প্রতি আনুগত্য কর্মকান্ডকে মূল্যায়ন করা হয়। শুধু তারকাখ্যাতি বা জনপ্রিয়তার কারণে কেউ উড়ে এসে জুড়ে বসে আওয়ামী লীগের বড় নেতা বা এমপিও হতে পারেন না। এবার মনোনয়নে এটিই ছিল সবচেয়ে বড় চমক। এ নিয়ে বেশকজন মনোনয়ন বঞ্চিত তারকার সঙ্গে কথা বলতে চাইলে বেশিরভাগই এ বিষয়ে কোনো মন্তব্য করতে রাজি হননি। নাম না প্রকাশের শর্তে কয়েকজন আবার বলেছেন, ‘আমাদের নেত্রী যাকে ভালো মনে করেছেন তাকেই দল থেকে মনোনয়ন দিয়েছেন। তিনি অবশ্যই আমাদের চেয়ে ভালো বোঝেন। আমরা দলীয় প্রার্থী যাকে মনোনয়ন দেওয়া হয়েছে তার সঙ্গে আছি। তার সঙ্গে থাকা মানেই দলীয় আদর্শ।’
জানা যায়, সংরক্ষিত নারী আসনের জন্য মনোনয়নপত্র সংগ্রহ করেছিলেন সুজাতা বেগম, লাকী ইনাম, সুবর্ণা মুস্তাফা, শমী কায়সার, রোকেয়া প্রাচী, তারিন জাহান, মেহের আফরোজ শাওন, তানভীন সুইটি, অপু বিশ্বাস, নিপুণ, শামীমা তুষ্টি, শাহনূর, ঊর্মিলা শ্রাবন্তী কর, সোহানা সাবা, জাকিয়া মাহা মুনসহ আরও অনেকে। তবে বাংলাদেশের প্রাচীনতম দল আওয়ামী লীগ এদের কারোর ওপর আস্থা রাখেনি। আস্থা রাখার কোনো কারণও ছিল না। রাজনীতির সঙ্গে অনেকের ন্যুন্যতম সম্পর্কও ছিল না। অনেকে আওয়ামী লীগ সভানেত্রীর নামের আগে বলেছিলেন ‘দেশনেত্রী’। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, মনোনয়ন কেনা প্রার্থীদের কেউ কেউ শোবিজ অঙ্গনে তারকাখ্যাতি লাভ করেছেন ঠিকই, তবে রাজনীতিতে তাদের অবস্থান নেই। তবুও মনোনয়ন চাইতে পিছিয়ে ছিলেন না কেউই। তাই আওয়ামী লীগের ‘প্রভাবশালী নেতাদের’ কাছে যাওয়া-আসা তো চলেছেই, দলের মনোনয়ন ফরম বিক্রির দিনগুলোতে ‘গণহারে’ ফরমও তুলছেন শোবিজ জগতের এসব নায়িকা। শেষ পর্যন্ত তারা মনোনয়ন না পাওয়ায় স্বস্তি প্রকাশ করেছেন ও খুশি হয়েছেন শোবিজ জগতেরই অনেকে এবং আওয়ামী লীগসহ নানা দল ও মতের মানুষ এবং সাধারণ জনগণ।
স্বার্থসিদ্ধিই মূল কারণ : অনুপম হায়াৎ
প্রখ্যাত চলচ্চিত্র সাংবাদিক ও গবেষক অনুপম হায়াৎ শোবিজ জগতের মানুষদের রাজনীতির মাঠে দৌড়ঝাঁপে চরম বিরক্ত। তিনি ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, দুঃখজনক হলেও সত্য যে, এ অভিনয়শিল্পীরা নিজের অভিনয় পেশার চেয়েও রাজনীতিকে অনেক বেশি মর্যাদাপূর্ণ মনে করছেন। এর পেছনে অবশ্য তাদের এমপি বা মন্ত্রী হওয়ার মতো বড় স্বপ্ন দেখাও কাজ করছে। মানে নিজেরা নিজেদের স্বার্থ হাসিলেই বেশি ব্যস্ত তারা। রাজনীতি সম্পর্কে কোনো শিক্ষা বা জ্ঞান না থাকা সত্ত্বেও তারা কেন অভিনয় ছেড়ে সংসদ সদস্য হওয়ার জন্য মরিয়া হয়ে উঠছে। এ নিয়ে প্রশ্ন ওঠাই স্বাভাবিক। এটি ঠিক নয়। তাদের মনে রাখা উচিত, অভিনয় হচ্ছে একটি শিল্প, রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে একে স্বীকৃতি দিয়ে মর্যাদাপূর্ণ করা হয়েছে। কলেজ-ইউনিভার্সিটিতে এ বিষয়ে বিভাগ খোলা হয়েছে। বিভিন্ন ক্ষেত্রে নানা পদ সৃষ্টি করা হয়েছে। তারপরেও এমন মর্যাদাপূর্ণ একটি শিল্পকে বাদ দিয়ে বা ছোট করে তারা কেন রাজনীতির পেছনে ছুটবে। সত্যজিৎ রায়, জহির রায়হান, নায়করাজ রাজ্জাকসহ অনেক খ্যাতিমান তারকা কি কখনো নিজ পেশা বাদ দিয়ে রাজনীতির পেছনে ছুটেছেন? অভিনেত্রী কবরী বা অভিনেতা ফারুকের কথা আলাদা। তারা মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিয়েছেন, ছাত্রজীবন থেকে রাজনীতি করেছেন। তারা রাজনীতিতে আসতে পারেন। কিন্তু হাস্যকর হলেও সত্য, যাদের রাজনীতির সঙ্গে কোনো সম্পৃক্ততা কখনোই ছিল না বা নেই তারা নিজ পেশা ছেড়ে এমপি-মন্ত্রী হওয়ার স্বপ্ন দেখছেন। এদের অনেকেই যে সরকার যখন ক্ষমতাসীন হয় সেই সরকারের বিভিন্ন অঙ্গ প্রতিষ্ঠানে যোগ দেয় আর ভোটের মাঠে নেমে পড়ে। অতীতে অনেককেই জিয়াউর রহমান ও এরশাদের রাজনীতিতে যোগ দিতে দেখা গেছে। পরে আবার স্বার্থ হাসিলের জন্য সরকার বদলের সঙ্গে সঙ্গে দলও বদল করেছে। এর কারণ তারা মনে করে রাজনীতিতে যোগ দিলে আরও বেশি ক্ষমতাবান হওয়া যায়। চলচ্চিত্র, নাটক মানে শোবিজ জগতের নান্দনিকতার কথা এরা ভুলে যায়, নিজস্ব পেশার উৎকর্ষ সাধনের চেষ্টা না করে অমূলক স্বপ্ন দেখে। এর ফলে শোবিজ অঙ্গন এখন কর্মশূন্য হয়ে পড়ছে, যা দুঃখজনক। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী এদের মনোনয়ন না দিয়ে যে বিচক্ষণতার পরিচয় দিয়েছেন তাতে আওয়ামী লীগের সব নেতা-কর্মীসহ বিভিন্ন দল ও মতের সচেতন মানুষ ও শোবিজ অঙ্গনের বোদ্ধাশ্রেণি স্বস্তি প্রকাশ করেছেন এবং খুবই খুশি হয়েছেন।
সুত্র-বাংলাদেশ প্রতিদিন
আরো পড়ুন : ইইউ এর স্থায়ী বাসিন্দাদের ভিসা ছাড়াই ওমরাহ পালনের সুযোগ