তাসমিমা হোসেন: নভেম্বরের এক হেমন্তের দিনে ৩৪ বছর আগে যাত্রা শুরু করেছিল পাক্ষিক অনন্যা। জীবনানন্দ দাশের প্রিয় হেমন্ত! কুয়াশাচ্ছন্ন সকাল। মিষ্টি রোদের আদর। জ্যোত্স্নাপ্লাবিত রাত। কৃষিপ্রধান আমাদের জনজীবনে হেমন্ত আসে আনন্দ-বেদনার নরম পায়ে। আর এমনই দিনে, এক অজানা স্বপ্নাঞ্জন মেখে যাত্রা শুরু করেছিল পাক্ষিক অনন্যা। সাফল্য-ব্যর্থতা বড় কথা নয়। বরং সময়ের ওপর আঁচড় রেখে যাওয়াটাও আসল কথা।
গত ৩৪ বছরে আমরা ক্রমশ অকল্পনীয় এক সময়ে এসে দাঁড়িয়েছি। কে না জানে, পরিবর্তনই জীবনের ধর্ম। বাংলাদেশেও ব্যাপক বিশাল বিপুল পরিবর্তন এসেছে। সাবেক মিস ইউনিভার্স খেতাবজয়ী কৃষ্ণাঙ্গ নারী জাজিবিনি টুনজিকে জিজ্ঞাসা করা হয়েছিল, কন্যাশিশুদের জন্য কোন বিষয়টি তিনি প্রশিক্ষণের জন্য সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ মনে করেন? দক্ষিণ আফ্রিকার এই সুন্দরী বলেন—‘নেতৃত্ব দিতে। এমন নয় যে নারীরা নেতৃত্ব দিতে চান না। কিন্তু সমাজ আমাদের জন্য প্রতিকূল ব্যবস্থা করে করেছে। সে কারণেই বাচ্চা মেয়েদের শেখানো দরকার, কীভাবে সমাজে জায়গা তৈরি করতে হয়।’
মেয়েদের নেতৃত্ব দেওয়ার জায়গায় বাংলাদেশ বাহ্যিকভাবে অনেক এগিয়ে বলে মনে হতে পারে। বর্তমানে এ দেশের প্রধানমন্ত্রী, বিরোধীদলীয় নেত্রী, স্পিকার থেকে শুরু করে বৃহৎ কিছু ক্ষেত্রে ক্ষমতায়নের জায়গায় নারীরা অর্জন করেছেন সমীহযোগ্য গুরুদায়িত্ব। কিন্তু নারীর ক্ষমতায়নের সার্বিক পরিসংখ্যান অন্য কথা বলে। বাংলাদেশে সরকারি ও আধাসরকারি প্রতিষ্ঠানে অনুমোদিত পদের সংখ্যা প্রায় ১১ লাখ। এর মধ্যে নারীর সংখ্যা ৮৩ হাজারের কাছাকাছি। শতকরা হিসেবে মাত্র ৭ দশমিক ৬ ভাগ। উপসচিব পদ থেকে সচিব পদ পর্যন্ত নারীদের সংখ্যা মাত্র ১ শতাংশ বা তারও কম। অথচ দেশের অর্থনীতির প্রধান চালিকাশক্তি তৈরি পোশাকশিল্প ও কৃষি খাতে নারীর ভূমিকা ব্যাপক। তৈরি পোশাক খাতের মোট জনশক্তির ৮০ ভাগই নারী।
দুঃখজনকভাবে এই আধুনিক যুগে এসেও বেশির ভাগ বাবা-মায়ের কাছে কন্যাসন্তান আকাঙ্ক্ষিত নয়। এখনো বহু ক্ষেত্রে মেয়েদের জীবনের কোনো মূল্যই যেন নেই। ২৯ বছর আগে, ১৯৯৩ সালে হঠাৎ বাংলাদেশের এক সাহসিনী নারীর মাথার বেশ চড়া দাম ধার্য করা হয়। আমি অবাক হয়ে ভাবলাম—বাংলাদেশের নারীর মাথার আবার দাম আছে নাকি? ভাবলাম, এ নারীকে তো পুরস্কৃত করতে হয়! আর এভাবেই মাথায় ভাবনা এলো বছরের আলোচিত ১০ জন নারীকে নিয়ে ‘অনন্যা শীর্ষদশ’ করা যেতে পারে। সেই শুরু। তারপর একে-একে গত ২৮ বছর ধরে ২৮০ জন কৃতী নারীকে বৈচিত্র্যময় বিভিন্ন ক্ষেত্র থেকে বাছাই করে ‘অনন্যা শীর্ষদশ’ সম্মাননায় ভূষিত করা হলো। বলা যায়, বাংলাদেশে নারী জাগরণের বিস্ময়কর পথ-পরিক্রমার সাক্ষী থেকেছে পাক্ষিক অনন্যা। এই প্রায় তিন দশকে অনন্যার পাশে যারা দাঁড়িয়েছিলেন, যারা সম্মাননা পেয়েছেন, তাদের অনেকেই চলে গেছেন না-ফেরার জগতে। তাদের প্রতি জানাই গভীর শোক ও শ্রদ্ধা।
অনন্যা এমনই তিনটি দশকের সাক্ষী—যে সময় দ্বিমেরু যুগের অবসান ঘটিয়ে বিশ্বে শুরু হয়েছিল বহুমেরু যুগের, পতন ঘটেছিল সোভিয়েত ইউনিয়নের, চালু হয়েছিল মুক্তবাজার অর্থনীতি, ঘটেছিল নাইন-ইলেভেনের মতো তোলপাড় করা ঘটনা। আর এসবের মধ্যে নীরবে বিপ্লব ঘটিয়ে ফেলেছে তথ্যপ্রযুক্তি। তারপর এলো কোভিড-১৯ মহামারি। এখন চলছে রুশ-ইউক্রেন যুদ্ধ। শোনা যাচ্ছে বিশ্বব্যাপী এক গভীর মন্দার পদধ্বনি। এত সব ঘটন-অঘটনের ভেতর দিয়েই বাংলাদেশের নারীদের অনুপ্রেরণার একটি প্ল্যাটফরম হওয়ার চেষ্টা অব্যাহত রেখেছে পাক্ষিক অনন্যা। মহামারির সময়ও অনন্যা শীর্ষদশ প্রদান থেমে থাকেনি।
আজ বাংলা একাডেমির আবদুল করিম সাহিত্যবিশারদ মিলনায়তনে বিকেল ৪টায় প্রদান করা হচ্ছে গত বছরের আলোচিত শীর্ষদশ নারীকে। এবার যারা অনন্যা শীর্ষদশ সম্মাননা অর্জন করেছেন, তাদের সঙ্গে অতি সংক্ষেপে পরিচিত হওয়া যাক।
আজীবন সম্মাননা পাচ্ছেন কারুশিল্পী সরত মালা চাকমা : রাঙ্গামাটির তবলছড়ির মাস্টার কলোনিতে ৯০ বছর আগে জন্মগ্রহণ করেন সরত মালা চাকমা। সাত বছর বয়সে তার কারুশিল্পে হাতেখড়ি হয়। সরত মালা সারা জীবনে দেশ-বিদেশ থেকে জিতেছেন অসংখ্য পুরস্কার। ২০১৬ সালে উইভার্স ফেস্টিভ্যালে তাকে বিশেষ সম্মাননায় ভূষিত করা হয়। এখন তার একটি চোখ খারাপ, আরেকটি ভালো চোখ নিয়েই তিনি এখনো সেলাইয়ের কাজ করেন।
অর্থনীতিবিদ নাজনীন আহমেদ :মেধার অপূর্ব রোশনাই ছড়ানো নাজনীন আহমেদ ১৯৯০ সালে ঢাকা শিক্ষা বোর্ডের অধীনে এইচএসসিতে এবং ১৯৮৮ সালে যশোর শিক্ষা বোর্ডের অধীনে এসএসসিতে সম্মিলিত মেধাতালিকায় প্রথম স্থান অর্জন করেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা শেষ করে নাজনীন প্রথমে ‘সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ’ (সিপিডি)-তে যোগদান করেন। বর্তমানে তিনি জাতিসংঘ উন্নয়ন কর্মসূচি (ইউএনডিপি) বাংলাদেশের কান্ট্রি ইকোনমিস্ট।
করপোরেট ব্যক্তিত্ব বিটপী দাশ চৌধুরী :বিটপী দাশ চৌধুরী বর্তমানে একটি মাল্টিন্যাশনাল ব্যাংকের হেড অব করপোরেট অ্যাফেয়ার্স এবং ব্র্যান্ড অ্যান্ড মার্কেটিংয়ে সুনামের সঙ্গে দায়িত্ব পালন করছেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইবিএ এবং পরবর্তী সময়ে ইন্টারন্যাশনাল বিজনেস এবং ফিন্যান্স নিয়ে দেশের বাইরে এমবিএ করেন। তিনি ব্যাংকের মধ্যে নন-ব্যাংকিং কাজ করে থাকেন, যেখানে প্রতিটি দিন আসলে নতুন চ্যালেঞ্জ ও নতুন কর্মপরিকল্পনার।
অভিনেত্রী ও নির্দেশক ত্রপা মজুমদার :বাংলাদেশের মঞ্চ-অভিনয়ের কিংবদন্তি শিল্পীদ্বয় ফেরদৌসী মজুমদার ও রামেন্দু মজুমদারের কন্যা ত্রপা মজুমদার সুনাম অর্জন করেছেন মঞ্চ-অভিনয়ের পাশাপাশি নির্দেশনাতেও। থিয়েটারের ‘পোহালে শর্বরী’ নাটকটিতে বাবা রামেন্দু মজুমদারের সঙ্গে সংযুক্ত নির্দেশনা দিয়েছেন ত্রপা। ইতিপূর্বে তিনি নির্দেশনা দিয়েছেন লালন ফকিরের জীবনী-নাটক ‘বারামখানা’। মার্কিন নাট্যকার লি ব্লেসিংয়ের ‘ইনডিপেনডেন্স’ অবলম্বনে ‘মুক্তি’ নাটকটি নির্দেশনা দিয়েছেন ত্রপা।
অদম্য সাহসী শাহিনুর আক্তার :সন্তানের বিপদে মায়েদের মনে যেন বিস্ময়কর শক্তি সঞ্চারিত হয়। এমনই এক কাহিনির স্রষ্টা ইয়াকুবের মা শাহিনুর আক্তার। তার ছেলে ইয়াকুব লিবিয়া থেকে ইতালি যাওয়ার পথে নিখোঁজ হয়ে যান। ছেলেকে উদ্ধারের জন্য কুমিল্লার প্রত্যন্ত অঞ্চল থেকে একা লিবিয়ায় ছুটে যান মা শাহিনুর। বাংলাদেশ সরকারের সহযোগিতায় মাফিয়াদের হাত থেকে ছেলেকে উদ্ধার করে আনেন শাহিনুর আক্তার।
বিজ্ঞানী সালমা সুলতানা :সালমা সুলতানা বাংলাদেশের গবাদি পশু খাতের প্রথম নারী উদ্যোক্তা, পেশাদার ট্রেইনার ও উন্নয়নকর্মী। ২০২১ সালে সিঙ্গাপুরভিত্তিক বিজ্ঞান সাময়িকীতে ১০০ এশিয়ান বিজ্ঞানীদের তালিকায় তিনি অষ্টম স্থান দখল করেন। সালমা সুলতানা বাংলাদেশে প্রথম বেসরকারি প্রাণিস্বাস্থ্য ও চিকিৎসা প্রশিক্ষণকেন্দ্র মডেল লাইভস্টক অ্যাডভান্সমেন্ট ফাউন্ডেশন গড়ে তুলেছেন।
প্রযুক্তিবিদ রুদমীলা নওশীন :বাংলাদেশের স্বনামধন্য প্রতিষ্ঠান স্কলাসটিকা থেকে এ লেভেল শেষ করে যুক্তরাষ্ট্রে ক্যালিফোর্নিয়ার স্যান জোস স্টেট ইউনিভার্সিটি থেকে ইলেকট্রিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে গ্র্যাজুয়েশন করেন রুদমীলা নওশীন। পরবর্তী সময়ে মাস্টার্স অব সায়েন্স ইন ডিজিটাল কমিউনিকেশন অ্যান্ড মাল্টিমিডিয়া বিষয়ে মাস্টার্স শেষ করেন। বর্তমানে তিনি যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক প্রতিষ্ঠান কনফিগ-ভিআর (ConfigVR) ও কনফিগ-আরবোটের (ConfigRbot) প্রতিষ্ঠাতা ও সিইও।
আলোকচিত্রশিল্পী শাহরিয়ার ফারজানা :চট্টগ্রামের বাঁশখালী উপজেলার মেয়ে শাহরিয়ার ফারজানা আলোকচিত্রে ইতিমধ্যে শতাধিক জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পুরস্কারে ভূষিত হয়েছেন। তার জীবনের দুর্বিষহ সময়ে সবচেয়ে বড় বন্ধু হিসেবে হাজির হয় আলোকচিত্রশিল্প। প্রতি বছরই অসংখ্য আন্তর্জাতিক পুরস্কারের বিরল পালক জমা হচ্ছে তার মুকুটে। ফটোগ্রাফি ছাড়াও শাহরিয়ার ফারজানা গত ৯ বছর ধরে ‘নারীকণ্ঠ’ নামের একটি মাসিক পত্রিকা সম্পাদনা ও প্রকাশনায় যুক্ত রয়েছেন।
মার্শাল আর্ট প্রশিক্ষক সান্ত্বনা রানী রায় :সান্ত্বনা রানী রায় ২০১২ থেকে ২০১৭ পর্যন্ত পাঁচটি আসরে স্বর্ণ জিতে নিজেকে সেরা প্রমাণ করেন। ২০১৭ সালে উত্তর কোরিয়ায় অনুষ্ঠিত ২০তম বিশ্ব তায়কোয়নদো প্রতিযোগিতায় তিনি ব্রোঞ্জ পদক অর্জন করেন। ২০১৮ থেকে এখন পর্যন্ত পাঁচটি ঘরোয়া প্রতিযোগিতা ও দুটি আন্তর্জাতিক প্রতিযোগিতায় অংশ নিয়ে পাঁচটি স্বর্ণ এবং একটি করে রৌপ্য ও ব্রোঞ্জ পদক পেয়েছেন।
নারী উদ্যোক্তা মোছা. ইছমত আরা :ইছমত আরার বাড়ি শেরপুরের নালিতাবাড়ীর নন্নী ইউনিয়নের পশ্চিমপাড়ায়। একদিন বোনের বাড়িতে বেড়াতে গিয়ে পরচুলা তৈরির কারখানার সন্ধান পান তিনি। সেখানে ভর্তি হয়ে সেই কাজ রপ্ত করেন। তারপর নিজেই পরচুলা বানানোর কাজ শুরু করেন। এখন বিভিন্ন ইউনিয়নের কয়েক হাজার নারী তার মাধ্যমে কাজ করছেন। ইছমত আরার প্রচেষ্টায় গ্রামের শত শত নারীর দারিদ্র্য ঘুচেছে।
বাংলাদেশের প্রথম ফিফা নারী রেফারি জয়া চাকমা : রাঙ্গামাটির মেয়ে জয়া ক্লাস ফোরে পড়ার সময় শিশু একাডেমিতে খেলার মাধ্যমে খেলোয়াড়ি জীবন শুরু করেন। একপর্যায়ে জাতীয় নারী দলে জায়গা পান জয়া। ২০১২ সালে তিনি জাতীয় দল থেকে বাদ পড়েন। রেফারি হিসেবে শুরু করেন নতুন জীবন। ২০১৯ সালে ফিফার রেফারি হওয়ার পরীক্ষায় পাশ করার মাধ্যমে তিনি অর্জন করেন বাংলাদেশের প্রথম ফিফা নারী রেফারি হওয়ার বিরল গৌরব।
পরিশেষে বলতে চাই, লন্ডন স্কুল অব ইকোনমিকসের সাবেক শিক্ষক জঁ দ্রেজ বলেছেন, ভারতের তুলনায় যেসব সূচকে বাংলাদেশে এগিয়ে রয়েছে তার বেশির ভাগই নারীকেন্দ্রিক বা নারীদের সক্রিয় অংশগ্রহণের ফলেই সম্ভব হয়েছে। সরকার ২০৩০ সালের মধ্যে জাতিসংঘের টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা (এসডিজি) অর্জন করতে চায়। এই এসডিজির পঞ্চম লক্ষ্য, নারী ও কন্যাশিশুর সমতা অর্জন এবং নারীর ক্ষমতায়ন। অন্ধকার দূর করতে এখনো অনেক কাজ করতে হবে। একটি বনে অসংখ্য জোনাকি থাকলে সেই বনকে কখনো পুরো আঁধারে ঢেকে রাখা যায় না। বিন্দু বিন্দু করেই সিন্ধু হয়। এজন্য এগিয়ে আসতে হবে সকল বিন্দুকে। নারী! তুমি জানো কি—কী শক্তি আছে তোমার মধ্যে? বিকশিত করো নিজেকে, সমাজকে, রাষ্ট্রকে। তুমি ভালো না থাকলে ভালো থাকবে না সমাজ, উন্নত হবে না রাষ্ট্র।
সুত্র- ইত্তেফাক অনলাইন
আরো পড়ুন : সার্বিক পরিস্থিতিতে পোশাকশিল্পে বহু কারখানা বন্ধ হচ্ছে আবার বন্ধের ঝুঁকিতে অনেকগুলো