দুর্নীতির মাধ্যমে হাতিয়ে নেওয়া সরকারি অর্থের ৪৭ হাজার কোটি টাকা উদ্ধার করেছে বাংলাদেশ মহাহিসাব নিরীক্ষক ও নিয়ন্ত্রক (সিএজি) কার্যালয়। গত ১৩ অর্থবছরে দ্বিপক্ষীয়-ত্রিপক্ষীয়, পিএ কমিটির সভা, বিভাগীয় ও দুদকের মামলার মাধ্যমে বিপুল অঙ্কের এ টাকা উদ্ধার করা হয়। এসব অর্থ ব্যাংকিং খাত, জ্বালানি খাত, সামাজিক নিরাপত্তা খাত, বিদ্যুৎ, টেলিকম, সরকারি চাকরিজীবী ও রাজস্ব খাতসহ বিভিন্ন উৎস থেকে উদ্ধার করা হয়।
ফেরত আনা অর্থ রাষ্ট্রীয় কোষাগারে জমা হয়েছে। যুগান্তরের নিজস্ব অনুসন্ধানে এ তথ্য পাওয়া গেছে।
জানা গেছে, উদ্ধারকৃত অর্থ একই সময়ে (১৩ বছর) সরকারি ব্যয়ের অনিয়ম সংক্রান্ত অডিট আপত্তির আর্থিক পরিমাণের ৩৩ শতাংশ। এ সময়ে অডিট আপত্তি পড়েছে ১ লাখ ৪২ হাজার কোটি টাকার বেশি। সর্বশেষ ২০২২ সালের অডিট আপত্তির ৪৪ শতাংশের সমান। ওই বছর জাতীয় সংসদে ১ লাখ ৬ হাজার ৪৭৯ কোটি টাকার অডিট রিপোর্ট উত্থাপন করা হয়।
উদ্ধারকৃত অর্থের পরিমাণ কম হওয়ার কারণ জানার জন্য সাবেক কম্পট্রোলার অ্যান্ড অডিটর জেনারেল মাসুদ আহমেদের সঙ্গে রোববার যুগান্তরের কথা হয়। তিনি বলেন, অডিট আপত্তির অর্থ উদ্ধারের জন্য অভিযুক্ত ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানকে পূর্ণ আত্মপক্ষ সমর্থনের সুযোগ দিয়ে শেষ পর্যন্ত মামলা করা হয়। ওই মামলার রায় অভিযুক্তের বিপক্ষে গেলেই শুধু অডিট আপত্তির টাকা দিতে রাজি হয়। এর আগ পর্যন্ত সহজে দিতে রাজি হয় না।
এ ছাড়া একজন চাকরিজীবীর বিরুদ্ধে অডিট আপত্তি হলে সে পেনশনে না যাওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হয়। এজন্য টাকা আদায়ে বিলম্ব হয়। তিনি আরও বলেন, অনেক ক্ষেত্রে তদন্ত শেষে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ বিভাগীয় মামলা করেন। এসব মামলা নিষ্পত্তি হতে সময় লেগে যায়। তিনি আরও বলেন, প্রতিবছরই বাজেটের আকার বাড়ছে। ফলে অডিট আপত্তির অঙ্কও সে হারে বাড়ছে। এখন আদায় বাড়াতে হলে সিএজি কার্যালয়ে লোকবল বাড়াতে হবে। পর্যাপ্ত লোকবলের অভাবে সরকারের সবগুলো উইংয়ে কাজ করা সম্ভব হচ্ছে না।
সূত্র মতে, বর্তমান সরকারি মোট ব্যয়ের মাত্র ৭ শতাংশের ওপর অডিট করা সম্ভব হচ্ছে। বাকি ৯৩ শতাংশ ব্যয় অডিটের বাইরে থাকছে। এর একমাত্র কারণ সিএজির লোকবলসহ সক্ষমতার অভাব। আন্তর্জাতিক মানদণ্ড হচ্ছে, সরকারি মোট ব্যয়ের ২০ শতাংশের ওপর অডিট করা। এটি করতে পারলে অনিয়মের প্রকৃত তথ্য বোঝা যাবে এমনটি মন্তব্য করেছেন সিএজি কার্যালয়ের ঊর্ধ্বতন এক কর্মকর্তা।
সাধারণ নিয়ম অনুযায়ী সরকার ঘোষিত বাজেটের অর্থ প্রতিবছর বিভিন্ন মন্ত্রণালয়, বিভাগ ও সংস্থা ব্যয় করে থাকে। এ ক্ষেত্রে অনিয়ম ও দুর্নীতি শনাক্ত করে নিরীক্ষার মাধ্যমে সিএজি কার্যালয়। অনিয়ম ধরার পর সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় বিভাগ ও সংস্থার সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় বৈঠক করে সিএজি। ওই বৈঠকে সমাধান না হলে সিএজি, সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় ও অভিযুক্ত ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের মধ্যে ত্রিপক্ষীয় বৈঠক হয়।
সেখানেও সমাধান না হলে এটি অডিট রিপোর্ট আকারে পাঠানো হয় রাষ্ট্রপতির কাছে। এরপর সেগুলো জাতীয় সংসদে উত্থাপন করা হয়। সেখান থেকে নিষ্পত্তির জন্য চলে যায় সরকারি হিসাব সম্পর্কিত স্থায়ী কমিটির (পিএ) কাছে। সেখানে আলোচনায় আপত্তি যদি নিষ্পত্তি না হয় সেক্ষেত্রে বিভাগীয় মামলা হয়।
আর যেসব ঘটনা সরাসরি দুর্নীতি ঘটে উদাহরণস্বরূপ যেমন-দরপত্র ছাড়াই কোনো কার্যাদেশ দেওয়া, ভ্যাট ফাঁকি এসব ঘটনার ক্ষেত্রে তা পাঠানো হয় দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) কাছে। দুদক সংশ্লিষ্ট অপরাধীর বিরুদ্ধে মামলা করে। এরপর আদালতের রায় নিয়ে টাকা আদায় করা হয়। তবে মামলা আসার আগে অন্যান্য স্তরে আপত্তিগুলো নিষ্পত্তি হয়ে থাকে। সেখান থেকে উদ্ধারের টাকাও কোষাগারে জমা হয়।
এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে সরকারি হিসাব সম্পর্কিত স্থায়ী কমিটির (পিএসি) সভাপতি রুস্তম আলী ফরাজী যুগান্তরকে বলেন, অডিট রিপোর্টগুলো পিএ কমিটিতে আসার পর পর্যালোচনা হয়। কমিটির বৈঠকে অডিট আপত্তি সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের সচিবদের ডাকা হয়। এতে অনেক অনিয়মের অর্থ উদ্ধার সম্ভব হয়। অর্থ আদায়ের আরও একটি বড় সমস্যা হচ্ছে অনেক কর্মকর্তা-কর্মচারী অবসর জীবনে চলে যান। যদিও আর্থিক অনিয়মের সঙ্গে তারা জড়িত। তবে আমি যদি দেখি আপত্তি সঠিক তবে সেখানে যে কেউ হোক টাকা আদায় করে থাকি। পাশাপাশি দায়ীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকেও নির্দেশ দেওয়া হয়।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, ২০০৯-২০১১ পর্যন্ত এই দুই অর্থবছরে বিভিন্ন মন্ত্রণালয়, বিভাগ ও সংস্থার কাছ থেকে অডিট আপত্তিজনিত প্রায় ২২৫৯ কোটি টাকা উদ্ধার করা হয়। একইভাবে ২০১১-২০১৩ পর্যন্ত এই দুই অর্থবছরে অর্থ ফেরত আনা হয়েছে ২৬৫৬ কোটি টাকা। পরবর্তী ২০১৩-২০১৫ অর্থবছরে টাকা ফেরত আনার অঙ্ক ২৮৪৩ কোটি টাকা। এছাড়া ২০১৫-২০১৭ অর্থবছর পর্যন্ত টাকা আদায়ের পরিমাণ ২৪১৯ কোটি টাকা।
এর পরবর্তী বছরগুলোতে অর্থ আদায়ের পরিমাণ দ্বিগুণের বেশি আদায় হয়। সিএজির সূত্র মতে, ২০১৭-২০১৯ এই দুই অর্থবছরে আদায়ের অঙ্ক ১৮ হাজার ৫০ কোটি টাকা। আর ২০১৯-২০২১ অর্থবছরে ১৬ হাজার ১৬৪ কোটি টাকা এবং ২০২১-২২ অর্থবছরে আদায় হয়েছে ২ হাজার ৬৩৭ কোটি টাকা।
অর্থ উদ্ধার প্রসঙ্গে জানতে চাইলে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল অব বাংলাদেশ (টিআইবি) নির্বাহী পরিচালক ইফতেখারুজ্জামান যুগান্তরকে বলেন, প্রতিবছর যে অঙ্কের অডিট আপত্তি হয় সে তুলনায় অর্থ আদায় বা ফেরত আনার অঙ্ক কম। কেন এটি হচ্ছে তা খতিয়ে দেখা দরকার।
তিনি প্রশ্ন রেখে বলেন, অডিট আপত্তিগুলো প্রতিবেদনে উঠে আসার পর পরবর্তী পদক্ষেপ নিতে পারছে না সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ। অডিট আপত্তির ব্যাপারে প্রতিকারমূলক বড় ধরনের পদক্ষেপ নেই। তিনি আরও বলেন, যে অর্থ উদ্ধার করেছে সেটি প্রশংসনীয় উদ্যোগ। আমরা পর্যবেক্ষণ করে দেখছি অনিয়ম সংক্রান্ত বিষয়গুলো চিহ্নিত করছে সিএজি অফিস। যে কারণে অর্থ উদ্ধারের মতো ইতিবাচক ঘটনা ঘটছে।
তিনি আরও বলেন, শুধু সিএজি অফিসের দায়িত্ব এখানেই শেষ নয়। মন্ত্রণালয়গুলোর উচিত এসবের বিরুদ্ধে আইনগত যথাযথ ব্যবস্থা নেওয়া। অনিয়মের ক্ষতিগ্রস্ত অর্থ আরও উদ্ধার করা। এর সঙ্গে জড়িতদের জবাবদিহিতা ও শাস্তি নিশ্চিত করা।
উদ্ধারকৃত অর্থের মধ্যে উল্লেখ্য ঘটনা হচ্ছে স্থানীয় সরকার ও পল্লী উন্নয়ন মন্ত্রণালয় প্রায় ৪৭ কোটি টাকা ও ব্যাংকিং খাত থেকে ২৮ কোটি টাকা আদায় হয়েছে। একইভাবে ২০১৮-১৯ অর্থবছরে স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয় থেকে প্রায় ১১ কোটি টাকা, জ্বালানি মন্ত্রণালয় থেকে ৪৮ কোটি টাকা, স্থানীয় সরকার বিভাগ থেকে ৩৩ কোটি টাকা ও পানিসম্পদ মন্ত্রণালয় থেকে আদায় হয় ১৩ কোটি টাকা।
আরও জানা গেছে, ২০১৭-১৮ অর্থবছরে জ্বালানি খাত থেকে ৬৩৯ কোটি টাকা আদায় করা হয়। একই বছরে ব্যাংকিং খাত থেকে ৩৯ কোটি টাকা, টেলিকম খাত থেকে ১৫ কোটি টাকা, বিদ্যুৎ খাত থেকে ১৬ কোটি টাকা আদায় করা হয়।
২০১৬-১৭ অর্থবছরে শুধু টেলিকম খাত থেকে আদায় করা হয় ১৬২৯ কোটি টাকা, স্থানীয় সরকার বিভাগ থেকে ৩৮ কোটি টাকা আদায় করা হয়। সংশ্লিষ্টরা মনে করছেন, সিভিল সার্ভিসের অসংখ্য কর্মকর্তা ঘন ঘন বদলি, পদোন্নতি ও নতুন কর্মকর্তাদের আগমনের কারণে আর্থিক ব্যবস্থাপনার ধারাবাহিকতা ক্ষুণ্ন হয়। ফলে সংশ্লিষ্ট রেকর্ডপত্র যথাযথভাবে হস্তান্তর হয় না। এ সংক্রান্ত বিষয় কার্যকরভাবে মনিটরিং হয় না। এসব কারণেই অনিয়মের সংখ্যা বাড়ছে।
আরো পড়ুন : আন্দোলন জোরদারে বিএনপির ইউনিয়ন পর্যায়ে পদযাত্রা কেন্দ্রীয় নেতারা