প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, বিশ্বব্যাপী দুর্ভিক্ষের পদধ্বনি শোনা যাচ্ছে। ইনশাআল্লাহ বাংলাদেশে দুর্ভিক্ষ হবে না। তার জন্য আমাদের এখন থেকে প্রস্তুতি নিতে হবে। দৃঢ় কণ্ঠে তিনি বলেন, দেশের অর্থনীতি এখনও যথেষ্ট শক্তিশালী। অনেকে বলেছিল, শ্রীলঙ্কা হবে, এই হবে, সেই হবে- তাদের মুখে ছাই পড়েছে। সেটি হয়নি, ইনশাআল্লাহ হবেও না।
আওয়ামী লীগ সভাপতি বলেছেন, জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বলেছিলেন, এই বাঙালিকে কেউ দাবায়ে রাখতে পারবে না। আমিও বিশ্বাস করি, কেউ দাবায়ে রাখতে পারবে না। ওরা (বিএনপি-জামায়াত) যত কথাই বলুক, বিভ্রান্ত হওয়ার কিছু নেই। আমরা এগিয়ে যাচ্ছি, এগিয়ে যাব। বাংলাদেশকে আমরা জাতির পিতার স্বপ্নের উন্নত-সমৃদ্ধ সোনার বাংলা হিসেবেই গড়ে তুলব।
শুক্রবার রাজধানীর ঐতিহাসিক সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে যুবলীগ আয়োজিত যুব মহাসমাবেশে প্রধান অতিথির বক্তব্যে এসব কথা বলেন শেখ হাসিনা। তিনি বলেন, রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধে প্রতিটি পণ্যের দাম বেড়েছে। তাই আমাদের পরনির্ভরশীল থাকলে চলবে না। আত্মনির্ভরশীল হতে হবে। সবাইকে আহ্বান করছি, উৎপাদন বাড়াতে হবে। এক ইঞ্চি জমিও যেন অনাবাদি না থাকে।
বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার শিক্ষাগত যোগ্যতার দিকে ইঙ্গিত করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘আমি কারও গিবত গাইতে আসিনি। কিন্তু এইট পাস আর ম্যাট্রিক ফেল দিয়ে দেশ চললে সেই দেশের উন্নয়ন হয় না। দেশপ্রেম থাকলে, দেশের মানুষের প্রতি কর্তব্যবোধ থাকলে এটি করা যায়। আমরা তা করে দেখিয়ে দিয়েছি। দেশের এই অগ্রযাত্রা কেউ রুখতে পারবে না।’
দুর্নীতি, সন্ত্রাস ও মাদক থেকে দূরে থাকার জন্য যুবলীগ নেতাকর্মীকে নির্দেশ দিয়ে শেখ হাসিনা বলেন, প্রত্যেক নেতাকর্মীকে দেশ ও মানুষের সেবা করতে হবে। নিজের গ্রামে যান, নিজের জমি চাষ করুন। অন্যের জমিতেও যাতে উৎপাদন হয়, কোনো জমি যেন অনাবাদি না থাকে, সেটি নিশ্চিত করতে হবে। যে কোনো চাষ, সবজি ও গাছপালা লাগাতে হবে। সন্ত্রাস, মাদক ও দুর্নীতিকে রুখতে হবে।
আওয়ামী লীগের অন্যতম সহযোগী সংগঠন যুবলীগ প্রতিষ্ঠার সুবর্ণজয়ন্তী উপলক্ষে আয়োজিত শুক্রবারের এই যুব মহাসমাবেশ যুব-জনতার সমুদ্রে পরিণত হয়েছিল। সারাদেশের লাখ লাখ যুবলীগ নেতাকর্মী রংবেরঙের টি-শার্ট ও টুপি পরে জমায়েত হন সেখানে। আগের দিন গভীর রাত থেকেই বাস, মাইক্রোবাস, ট্রাক ও পিকআপে বিভিন্ন জেলা-উপজেলার নেতাকর্মী ঢাকায় আসা শুরু করেন। সকাল থেকেই বিভিন্ন যানবাহনের পাশাপাশি খণ্ড খণ্ড মিছিল আর ব্যানার-প্ল্যাকার্ড নিয়ে নেতাকর্মীরা সমাবেশস্থলে উপস্থিত হন। তাঁদের মুহুর্মুহু স্লোগান, লাঠিখেলা আর ব্যান্ডপার্টি ও ভুভুজেলাসহ বিভিন্ন বাদ্যযন্ত্রের বাজনায় উৎসবমুখর পরিবেশ তৈরি হয়। বেলা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে নেতাকর্মীর উপস্থিতিতে গোটা উদ্যান কানায় কানায় পূর্ণ হয়ে যায়। দুপুরের আগেই সোহরাওয়ার্দী উদ্যানসহ আশপাশের সড়ক ও এলাকাগুলো জনারণ্যে পরিণত হয়।
মহাসমাবেশ উপলক্ষে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানকে রংবেরঙের বেলুন, ব্যানার ও ফেস্টুুন দিয়ে বর্ণাঢ্য সাজে সাজিয়ে তোলা হয়েছিল। ছিল জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও যুবলীগের প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান শেখ ফজলুল হক মনির প্রতিকৃতিও। উদ্যানের লেকের পূর্ব প্রান্তে নির্মাণ করা হয়েছিল দৃষ্টিনন্দন সুবিশাল মঞ্চ ও প্যান্ডেল। সমাবেশস্থলসহ মহানগরীর প্রধান প্রধান সড়কের পাশে জাতীয় পতাকা ও যুবলীগের পতাকা দিয়ে সাজানো হয়েছিল। ক্যাসিনোকাণ্ডে গ্রেপ্তার ও বর্তমানে জামিনে মুক্ত যুবলীগের বহিস্কৃত নেতা ইসমাইল চৌধুরী সম্রাট এবং টুপি-গেঞ্জি পরা সম্রাটের কর্মী-সমর্থকের শোডাউনও ছিল চোখে পড়ার মতো।
দুপুর আড়াইটায় সমাবেশস্থলে পৌঁছেই প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা জাতীয় সংগীতের সঙ্গে জাতীয় পতাকা উত্তোলন এবং বেলুন-পায়রা উড়িয়ে মহাসমাবেশ ও সুবর্ণজয়ন্তী উপলক্ষে যুবলীগের বছরব্যাপী অনুষ্ঠানমালার উদ্বোধন করেন। এ সময় তাঁর সঙ্গে ছিলেন যুবলীগ চেয়ারম্যান শেখ ফজলে শামস্ পরশ ও সাধারণ সম্পাদক মাইনুল হোসেন খান নিখিল।
আওয়ামী লীগ সভাপতি বলেন, অনেকে আমাদের অনেক সমালোচনা করছে। তারা নাকি দেশের উন্নয়ন চোখে দেখে না। এই যে এত উন্নয়ন, ডিজিটাল বাংলাদেশ আর মোবাইল ফোন, ইন্টারনেট এগুলো কে করেছে? চোখ থাকতেও যদি অন্ধ হয়, উন্নয়ন চোখে না দেখে- তাহলে কিছু করার নেই।
বিএনপির সমালোচনা করে তিনি বলেন, তাদের নেতা কে? খালেদা জিয়া এতিমের টাকা আত্মসাৎ করে দুর্নীতি মামলায় সাজাপ্রাপ্ত আসামি। তার পরিবর্তে যাকে আনা হয়েছে, সেই তারেক জিয়া আরেক ধাপ ওপরে। তারেক জিয়া মানি লন্ডারিং মামলায় সাত বছরের সাজাপ্রাপ্ত আসামি। ১০ ট্রাক অস্ত্র চোরাচালান মামলা আর ২১ আগস্টের গ্রেনেড হামলা মামলায়ও সাজাপ্রাপ্ত আসামি। যাদের নেতাই খুন, মানি লন্ডারিং ও দুর্নীতি মামলার আসামি, তাদের মুখে আওয়ামী লীগের সমালোচনা মানায় না।
বৈশ্বিক মন্দায় সাম্প্রতিক অর্থনৈতিক সংকট মোকাবিলার প্রসঙ্গ তুলে ধরে সরকারপ্রধান বলেন, বিএনপির ক্ষমতার সময় দেশে ২ দশমিক ৬ বিলিয়ন ডলার রিজার্ভ ছিল। আওয়ামী লীগ সরকার ৪৮ বিলিয়ন পর্যন্ত নিয়ে গিয়েছিল। দুই বছরের করোনার সময় মানুষকে বিনামূল্যে কভিড টিকা দিয়েছি, বিনিয়োগ করেছি, বিমান কিনেছি, পায়রা বন্দর নিজস্ব অর্থায়নে করেছি। এভাবে রিজার্ভ থেকে খরচ করতে হয়েছে। তবে ঘরের টাকা ঘরে থাকছে। দেশের জনগণের উন্নয়নে এই টাকা ব্যবহার করছি।
টানা তিন মেয়াদে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ সরকারের সময় দেশের আর্থ-সামাজিক খাতে নানামুখী অগ্রগতি ও অর্জনের কথা তুলে ধরে প্রধানমন্ত্রী বলেন, আজ ঘরে ঘরে আমরা বিদ্যুৎ দিয়েছি। রাস্তাঘাট পুল ব্রিজের উন্নতি করে সারাদেশে যোগাযোগ ব্যবস্থার অভূতপূর্ব সাফল্য এসেছে। ১০০টি সেতু একসঙ্গে উদ্বোধন করা হয়েছে। আমি জানি না, ইতিহাসে কেউ করেছে কিনা? আমরা সেটিও করতে পেরেছি। কাজেই বাংলাদেশ পারে।
মহাসমাবেশে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক এবং সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের বলেন, বিএনপি যদি আরেকবার ক্ষমতায় আসে, সব গিলে খাবে। বিদেশি ঋণ, গণতন্ত্র ও নির্বাচন গিলে খাবে। সুযোগ পেলে বাংলাদেশ পর্যন্ত গিলে খাবে।
বিএনপিকে উদ্দেশ করে তিনি বলেন, খেলা হবে, হবে খেলা। দুর্নীতি, দুঃশাসন, লুটপাট আর বিএনপির বিরুদ্ধে খেলা হবে। আগুন সন্ত্রাস, ভোট চুরি, ভুয়া ভোটার তালিকার বিরুদ্ধেও খেলা হবে। তৈরি হয়ে যান। প্রস্তুত হয়ে যান। জবাব দেব। সফল মহাসমাবেশের আয়োজন করায় যুবলীগকে শুভেচ্ছা জানিয়ে ওবায়দুল কাদের বলেন, যুবলীগ কথা দিয়ে কথা রাখে। তার প্রমাণ, এটা যুব সমাবেশ নয়, যুব-জনতার মহাসমুদ্র।
আওয়ামী লীগের উপদেষ্টা পরিষদের সদস্য ও যুবলীগের সাবেক চেয়ারম্যান আমির হোসেন আমু সবাইকে সতর্ক থাকার আহ্বান জানিয়ে বলেন, বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে এখনও ষড়যন্ত্র হচ্ছে। ষড়যন্ত্রকারীরা বলছে- ধাক্কা দিলেই নাকি সরকার পড়ে যাবে! এরা আহাম্মকের স্বর্গে বাস করছে। এমন কোনো শক্তি নেই শেখ হাসিনার সরকারকে উৎখাত করতে পারে।
আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য ও যুবলীগের আরেক সাবেক চেয়ারম্যান শেখ ফজলুল করিম সেলিম বলেন, আওয়ামী লীগ পালিয়ে যাওয়ার দল নয়। বিএনপির তারেক, ফালু, হারিছরা দেশ থেকে পালিয়ে গেছে। বিএনপি রাজনৈতিক দল নয়। তারা পাকিস্তানের এজেন্ট।
আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর আরেক সদস্য ও যুবলীগের সাবেক চেয়ারম্যান অ্যাডভোকেট জাহাঙ্গীর কবির নানক বলেন, দেশের যে কোনো সংকট মোকাবিলায় শেখ হাসিনার নেতৃত্বে যুবলীগ নেতাকর্মীরা ঐক্যবদ্ধ রয়েছেন, প্রস্তুত রয়েছেন। ঐক্যবদ্ধভাবেই তারা বিএনপি-জামায়াতের ষড়যন্ত্রের দাঁতভাঙা জবাব দেবে।
সভাপতির বক্তব্যে যুবলীগের চেয়ারম্যান শেখ ফজলে শামস্ পরশ বলেন, বিএনপির সময় বাংলাদেশকে বলা হতো ‘ব্রিডিং গ্রাউন্ড অব টেররিজম’। আর শেখ হাসিনার নেতৃত্বে বাংলাদেশকে এখন বলা হচ্ছে ‘নেপট এশিয়ান টাইগার’। উন্নয়নের পুরোটাই নেতৃত্বের দূরদর্শিতার ওপর নির্ভর করে এবং শেখ হাসিনা তাঁর প্রমাণ রেখে চলেছেন।
মহাসমাবেশে স্বাগত বক্তব্য ও মূল পর্ব পরিচালনা করেন যুবলীগের সাধারণ সম্পাদক মাইনুল হোসেন খান নিখিল। প্রথম পর্বের পরিচালনায় ছিলেন যুবলীগের প্রচার ও প্রকাশনা সম্পাদক জয়দেব নন্দী এবং উপ-প্রচার ও প্রকাশনা সম্পাদক আদিত্য নন্দী।
মহাসমাবেশকে ঘিরে কয়েক স্তরের কঠোর নিরাপত্তা ব্যবস্থা নেয় আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। রাজধানীর কয়েকটি সড়কে যানবাহন চলাচল বন্ধ অথবা সীমিত রেখে নেতাকর্মীকে মহাসমাবেশে আসার রুট বেঁধে দেওয়া হয়েছিল। এতে সাপ্তাহিক ছুটির দিনেও কয়েকটি সড়কে তীব্র যানজট সৃষ্টি হওয়ায় মানুষকে দুর্ভোগে পড়তে হয়।
আরো পড়ুন : আর্জেন্টিনার বিশ্বকাপ দলে দিবালা-ডি মারিয়া যোগ দিলেন মেসির সঙ্গে