টানা প্রায় ১৫ বছর একই মতাদর্শের সরকার ক্ষমতায় থাকা সত্ত্বেও বিনিয়োগের খরা কাটেনি। ফলে দেশি-বিদেশি বিনিয়োগ যে হারে আকর্ষণের পরিকল্পনা ছিল তা বাস্তবায়িত হয়নি। বরং দেশি-বিদেশি উভয় প্রকার বিনিয়োগই কমেছে। শুধু বিদেশি বিনিয়োগই এক বছরের ব্যবধানে কমেছে ৭ শতাংশ। সম্প্রতি বাংলাদেশ ব্যাংক ও বিনিয়োগ উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের প্রকাশিত বিনিয়োগসংক্রান্ত একাধিক প্রতিবেদন বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, বিনিয়োগের বাধা চিহ্নিত করা হয়েছে কিন্তু বাধাগুলো দূর করে ও বিনিয়োগ আকর্ষণে কার্যকর তেমন কোনো উদ্যোগ নেওয়া সম্ভব হয়নি। তাই বিনিয়োগ কাক্সিক্ষত হারে বাড়েনি। বিনিয়োগের যে তিনটি প্রধান বাধা চিহ্নিত করা হয়েছে তা হলো- ডলারের বাজারে অস্থিরতা, বিনিয়োগকারীদের আস্থাহীনতা ও রাজনৈতিক অনিশ্চয়তা। এ ছাড়া রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের ফলে যে বৈশ্বিক অনিশ্চয়তা তৈরি হয়েছে তাকেও বিনিয়োগের অন্যতম বাধা হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। এসব বাধা দূর করতে কার্যকর উদ্যোগ নেওয়া সম্ভব না হওয়ায় দেশে বিনিয়োগ পরিস্থিতির তেমন কোনো উন্নতি হয়নি।
এ প্রসঙ্গে বিশ্বব্যাংক ঢাকা অফিসের সাবেক প্রধান অর্থনীতিবিদ ড. জাহিদ হোসেন বলেন, ‘একটি গ্যাস কিংবা বিদ্যুতের সংযোগ পেতে মাসের পর মাস অপেক্ষা করতে হয়। অনেক রাস্তাঘাট, এক্সপ্রেসওয়ে, টানেল, ইকোনমিক জোন প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে কিন্তু এসব প্রতিষ্ঠানের জন্য যেসব সুযোগসুবিধা প্রয়োজন সেগুলো থেকে আমরা এখনো অনেক দূরে। এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে ডলারের দরে ঊর্ধ্বগতি ও রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা। ফলে বিনিয়োগ বাড়ার চেয়ে উল্টো কমেছে।’ বাংলাদেশ ব্যাংক সূত্র জানান, ২০২২-২৩ অর্থবছরে দেশে সরাসরি বিদেশি বিনিয়োগ কমেছে ৭ শতাংশ। চলতি বছর ৩ দশমিক ২ বিলিয়ন ডলার বিদেশি বিনিয়োগ এসেছে। অর্থনীতিবিদরা বলছেন, অতিসম্প্রতি বৈদেশিক মুদ্রার বিপরীতে টাকার মান অনেক পড়ে যাওয়ায় অর্থনীতিতে চাপ বেড়েছে। এতে বিনিয়োগকারীরা আগ্রহ হারিয়ে ফেলেছেন। ফলে এ সময়ে ইক্যুইটি বিনিয়োগ উল্লেখযোগ্যভাবে কমে গেছে। ড. জাহিদ হোসেন এ অবস্থাকে দেশের অর্থনীতির জন্য আরেকটি খারাপ খবর বলে মনে করেন।
বাংলাদেশ ব্যাংক বলছে, এ অর্থবছরে ইক্যুইটি বিনিয়োগ ৪০ দশমিক ৯১ শতাংশ হ্রাস পেয়েছে। বিডা মনে করে সারা দেশে যে ১০০ ইকোনমিক জোন প্রতিষ্ঠার কাজ চলছে তার বাস্তবায়ন সম্পন্ন হলে দেশে বিনিয়োগের ক্ষেত্র প্রস্তুত হবে। ইতোমধ্যে মিরসরাইয়ে বঙ্গবন্ধু শিল্পসিটির অবকাঠামো নির্মাণ প্রায় সম্পন্ন হয়েছে। সেখানে দেশি-বিদেশি মিলিয়ে অর্ধশতাধিক কোম্পানি বিনিয়োগ করেছে। অনেকে উৎপাদনেও চলে গেছে। তবে গ্যাস-বিদ্যুৎসহ আরও যেসব সেবা সংস্থা রয়েছে সেগুলোর নানা রকম জটিলতার কারণে কাক্সিক্ষত হারে বিনিয়োগ আসছে না। কেননা বিনিয়োগ উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (বিডা) ও বাংলাদেশ ইকোনমিক জোন অথরিটিতে (বেজায়) ওয়ানস্টপ সার্ভিস চালু করা হলেও সেটা খুব একটা কার্যকর নয় বলে মনে করেন ব্যবসায়ী ও উদ্যোক্তারা। এদিকে দীর্ঘদিন ধরে চলে আসা ডলার সংকট তীব্র থেকে তীব্রতর হয়েছে। টাকার মানও কমেছে ৩০ শতাংশের বেশি। সরকারের আয় কমে গেছে। এ কারণে সরকারকে ঋণের জন্য ব্যাংকের ওপর নির্ভর করতে হচ্ছে। ফলে বেসরকারি খাতেও ঋণ প্রবৃদ্ধি কমেছে। সব মিলিয়ে সংকট উত্তরণের পথে নেই দেশের অর্থনীতি। অর্থনীতিতে চাঞ্চল্য নেই। আবার সামনে নির্বাচনকালীন অনিশ্চয়তা। ফলে গতি ফিরে পাচ্ছে না অর্থনীতি। এতে সামগ্রিকভাবে বিনিয়োগের সুষ্ঠু পরিবেশ নিশ্চিত করা সম্ভব হয়নি বলে মনে করেন সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা ড. হোসেন জিল্লুর রহমান।
অবশ্য বিডার আরেক প্রতিবেদনে জানানো হয়, দেশে বিনিয়োগের স্থিতি বেড়েছিল আগের বছর। ২০২২ সালে সারা বিশ্বে প্রত্যক্ষ বিদেশি বিনিয়োগ (এফডিআই) কমলেও বাংলাদেশে সামান্য বেড়েছিল। গত বছর দেশে এফডিআই প্রবাহ ২০ শতাংশ বেড়ে দাঁড়ায় ৩৪৮ কোটি ডলারে, যা এখন স্থানীয় মুদ্রায় ৩৭ হাজার ৭৫৮ কোটি টাকার মতো (প্রতি ডলার ১০৮ টাকা ৫০ পয়সা ধরে)। দেশে ১৯৯০ সালের পর এটি দ্বিতীয় সর্বোচ্চ এফডিআই। গত ৩৩ বছরের মধ্যে ২০১৮ সালে সর্বোচ্চ ৩৬১ কোটি ডলারের এফডিআই আসে। চলতি বছর এসে সেই প্রবাহ ধরে রাখা সম্ভব হয়নি। ২০২৩-২৪ অর্থবছরে এটা কমেছে ৭ শতাংশ।
এদিকে সংসদ নির্বাচন কেন্দ্র করে রাজনৈতিক অনিশ্চয়তা তৈরি হওয়ায় বিদেশি বিনিয়োগকারী তো নয়ই, দেশি বিনিয়োগকারীরাও বিনিয়োগে আগ্রহ দেখাচ্ছেন না। সবাই পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করছেন। বিশ্লেষকরা মনে করেন, নির্বাচনের পর পরিস্থিতি স্বাভাবিক হলে বিনিয়োগ বাড়তে পারে।
আরো পড়ুন : চলছে আচরণবিধি লঙ্ঘনের হিড়িক, অসহায় নির্বাচন কমিশন