ধান-চাল উৎপাদনে অন্যতম উদ্বৃত্ত এলাকা রংপুর। শস্যভান্ডার বলে পরিচিত এই অঞ্চলে উৎপাদিত খাদ্যশস্য নিজেদের চাহিদা মেটানোর পর অন্য অঞ্চলেও সরবরাহ করা হয়। তবে গত আমন ও বোরো মৌসুমে ধান সংগ্রহ অভিযান সফল হয়নি রংপুর বিভাগের আট জেলায়। আমন মৌসুমে চাল সংগ্রহের লক্ষ্যমাত্রা ছাড়িয়ে গেলেও ধানে ব্যর্থ খাদ্য বিভাগ। বোরো মৌসুমে ধান ক্রয়ের লক্ষ্যমাত্রা কিছুটা বাড়লেও চালে শতভাগ পূরণ হয়নি। আর গম সংগ্রহ অভিযানের অবস্থা আরও নাজুক। তবে খাদ্য বিভাগ বলছে, যথেষ্ট পরিমাণে চালের মজুত রয়েছে।
রংপুর বিভাগীয় খাদ্য নিয়ন্ত্রকের কার্যালয় সূত্রে জানা যায়, পঞ্চগড়, ঠাকুরগাঁও, দিনাজপুর, নীলফামারী, রংপুর, লালমনিরহাট, কুড়িগ্রাম ও গাইবান্ধায় সরকারিভাবে আমন ধান সংগ্রহের লক্ষ্যমাত্রা ছিল ৬২ হাজার ৬৫৬ টন। ২০২১ সালের ৭ নভেম্বর থেকে চলতি বছর ২৮ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত নির্ধারিত সময়ে অর্জিত হয়েছে ১৫ হাজার ১২৭ দশমিক ৬৮০ টন। এর মধ্যে সবচেয়ে কম সংগ্রহ রংপুর জেলায়। এখানে ১০ হাজার ১৪৯ টন লক্ষ্যমাত্রার বিপরীতে অর্জিত মাত্র ৩২ টন। গাইবান্ধায় সবচেয়ে বেশি ধান সংগ্রহ হলেও শতভাগ পূরণ হয়নি। এখানে ৭ হাজার ৪৪৬ টন লক্ষ্যমাত্রার বিপরীতে অর্জিত হয়েছে ৫ হাজার ৩১ টন। অন্যদিকে এসব জেলায় সিদ্ধ চাল সংগ্রহের লক্ষ্যমাত্রা ছিল ১ লাখ ২৩ হাজার ৮৩৯ টন। এর বিপরীতে অর্জিত হয়েছে ১ লাখ ৮৩ হাজার ৮৭০ টন।
আমন মৌসুমে চাল সংগ্রহে সফল হলেও ধান সংগ্রহে ব্যর্থতা নিয়েই চলতি বছর ২৮ মে থেকে বোরো সংগ্রহ অভিযানে নামে খাদ্য বিভাগ। ৩১ আগস্ট পর্যন্ত বোরো ধান সংগ্রহের লক্ষ্যমাত্রা ছিল ১ লাখ ৮৯৮ টন। সেখানে অর্জিত হয়েছে ৭৮ হাজার ৪৫২ টন। গড় সফলতা ভালো হলেও নীলফামারী জেলায় ধান সংগ্রহে অর্জন ছিল কম। সেখানে ৬ হাজার ৮২২ টন ধান সংগ্রহের লক্ষ্যমাত্রার বিপরীতে অর্জন ২ হাজার ১৪১ টন। রংপুরে ১২ হাজার ১৯৯ টন ধান ক্রয়ের লক্ষ্যমাত্রার বিপরীতে সংগ্রহ ৬ হাজার ২৫ টন। বিভাগের আট জেলার মধ্যে শতভাগ ধান সংগ্রহের তালিকায় রয়েছে মাত্র দুটি জেলা গাইবান্ধা ও পঞ্চগড়।
এ ছাড়া দিনাজপুর ও ঠাকুরগাঁও জেলায় লক্ষ্যমাত্রার ৯৩ শতাংশ, কুড়িগ্রামে ৬২ শতাংশ ও লালমনিরহাটে ৫২ শতাংশ অর্জন হয়েছে। একই সময়ে এসব জেলায় সিদ্ধ চাল ক্রয়ের লক্ষ্যমাত্রার প্রায় পুরোটা সফল বলে সংশ্লিষ্ট সূত্র জানিয়েছে। এ ক্ষেত্রে প্রাথমিক লক্ষ্যমাত্রার পাশাপাশি অতিরিক্ত লক্ষ্যমাত্রাও নেওয়া হয়।
নির্ধারিত ৩১ আগস্টের মধ্যে সিদ্ধ চালের মোট লক্ষ্যমাত্রা ছিল ৩ লাখ ১৯ হাজার ৮০৩ টন। সেখানে অর্জিত হয়েছে ২ লাখ ৯৭ হাজার ৫৩ টন। সেইসঙ্গে আতপ চালও অর্জিত হয়েছে ৯৭ শতাংশ। গত আমন ও বোরো মৌসুমে ২৭ টাকা কেজি দরে ধান এবং ৪০ টাকা কেজি দরে চাল কিনেছে সরকার। বোরো মৌসুমে আতপ চাল কিনেছে ৩৯ টাকা কেজি দরে।
তবে ধান-চাল সংগ্রহে সফলতা যাই হোক, গম সংগ্রহ অভিযান পুরোপুরি ব্যর্থ। চলতি বছরের ১ এপ্রিল থেকে ৩০ জুন পর্যন্ত এ বিভাগে গম সংগ্রহের লক্ষ্যমাত্রা ছিল ৪৪ হাজার ৩৯৯ টন। এর বিপরীতে কুড়িগ্রাম, নীলফামারী, ঠাকুরগাঁও ও পঞ্চগড় জেলা থেকে খাদ্য বিভাগ গম কিনতে পেরেছে মাত্র ১৯ টন।
যদিও কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের রংপুর আঞ্চলিক কার্যালয় সূত্রে জানা যায়, রংপুর কৃষি অঞ্চলের পাঁচ জেলা লালমনিরহাট, কুড়িগ্রাম, গাইবান্ধা, নীলফামারী ও রংপুরে ২০২১-২২ অর্থবছরে ১৮ হাজার ২৮৫ হেক্টর জমিতে গম উৎপাদন হয়েছে ৬৩ হাজার ৮৩০ টন। এ ছাড়া একই অর্থবছরে ওই পাঁচ জেলায় আউশ, রোপা আমন এবং বোরো মৌসুমে চাল উৎপাদন হয়েছে ৪১ লাখ ৫৩ হাজার ১৯৯ টন।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, ধানের মৌসুমে কৃষকদের কাছ থেকে ন্যায্যমূল্যে ধান কেনার জন্য একটি কমিটি গঠন করা হয়। ওই কমিটি লটারি করে বিজয়ী কৃষকের কাছ থেকে ধান ক্রয় করে।
সংশ্লিষ্টরা জানায়, ধান চাষ করেছেন এমন কৃষকের তালিকা থাকে কৃষি অফিসে। তাদের মধ্যে যারা কৃষিতে ভর্তুকি পান, তাদের নাম যায় ক্রয় কমিটির কাছে। সেখান থেকে লটারির মাধ্যমে কৃষক বাছাই করে উপজেলা খাদ্যগুদামে তালিকা টানিয়ে দেওয়া হয়।
রংপুর সিটির চব্বিশ হাজারীর কৃষক মোন্নাফ আলী বলেন, কোন দিন, কীভাবে লটারি হয় বা হয়েছে, তা কৃষকরা জানেন না। কৃষকদের অভিযোগ, ধান সংগ্রহের জন্য কৃষক বাছাইয়ের প্রক্রিয়া স্বচ্ছ নয়। প্রকৃত কৃষকরা গুদামে ধান দিতে পারছেন না।
রংপুর কৃষক সংগ্রাম পরিষদের আহ্বায়ক পলাশ কান্তি নাগ বলেন, নানা অজুহাত দাঁড় করিয়ে সরাসরি কৃষকের বদলে দালালদের মাধ্যমে ধান কেনা হয়। এতে প্রকৃত কৃষকরা বঞ্চিত হচ্ছেন।
রংপুর বিভাগীয় খাদ্য নিয়ন্ত্রকের কার্যালয় সূত্রে জানা যায়, বর্তমানে জেলা ও উপজেলার বিভিন্ন গুদামে ২ লাখ ৭৭ হাজার ৫০০ টন চাল, ৩ হাজার ৫০০ টন ধান এবং ৩ হাজার ৮০০ টন গম মজুত রয়েছে। বোরো মৌসুমে বাজারদরের সঙ্গে সরকার নির্ধারিত দরের তেমন একটা হেরফের ছিল না। এ ছাড়া শুরু থেকেই বিভিন্ন কর্মপরিকল্পনা গ্রহণ করায় ধান-চাল সংগ্রহ অভিযান অনেকটাই সফল বলে দাবি তাদের।
রংপুর আঞ্চলিক খাদ্য নিয়ন্ত্রক আশরাফুল আলম জানান, কৃষি বিভাগ থেকে উৎপাদিত ফসলের তথ্য সমন্বয় করে ক্রয়ের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়। যে পরিমাণ চাল মজুত রয়েছে, তা দিয়ে এ অঞ্চলে সরকারি চাহিদা অনায়াসে কয়েক মাস পূরণ করা সম্ভব। আবারও আমন মৌসুমে ধান-চাল ক্রয় অভিযান শুরু হলে মজুতের পরিমাণ বাড়বে।
তবে গম সংগ্রহে ব্যর্থতার দায় স্বীকার করে তিনি বলেন, ‘বিগত সময়ে এ অঞ্চলে গম সংগ্রহ সফল হলেও এবার বাজারে দাম বেশি থাকায় কৃষকরা আগ্রহী হননি। আগামীতে সরকার গম ক্রয়ের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করলে তা পূরণ করা হবে।’
আরো পড়ুন : মোমবাতি, টর্চের আলোয় চলছে শেবাচিম হাসপাতালের চিকিৎসা