নির্বাচনের পর পাকিস্তানের রাজনৈতিক পক্ষগুলো সমীকরণের পর সমীকরণ আর সুযোগ-সুবিধা ও পদ-পদবির টোপ দেওয়ার প্রতিযোগিতায় লিপ্ত হয়েছে। এমনকি কারারুদ্ধ সাবেক প্রধানমন্ত্রী পিটিআই দলের প্রধান ইমরান খান সমর্থিত স্বতন্ত্র প্রার্থীদের ভিতরও ‘টোপের লোভ’ পেয়ে বসেছে। ফলে প্রায় ডজনখানেক প্রার্থী এরই মধ্যে ইমরানের পক্ষ ছেড়ে নওয়াজ শরিফের পক্ষে চলে গেছেন। অন্যদিকে নওয়াজ শরিফের পাকিস্তান মুসলিম লিগ-নওয়াজ (পিএমএল-এন) এবং বিলাওয়াল ভুট্টোর পাকিস্তান পিপলস পার্টি (পিপিপি) সমঝোতার পথে অনেক দূর এগিয়েছে বলে সর্বশেষ খবরে জানা গেছে। তারা একটি পালাক্রমের সরকার গঠনে প্রায় একমত। অর্থাৎ পাঁচ বছর মেয়াদকালের নতুন সরকারে তারা আড়াই বছর করে একে-অপরে সরকার চালানোর বিষয় নিয়ে মতৈক্যে পৌঁছার চেষ্টা করছে। সূত্র : জিও নিউজ, ডন, রয়টার্স, আলজাজিরা, এনডিটিভি
প্রাপ্ত খবর অনুযায়ী, পাকিস্তানের সাধারণ নির্বাচনে কোনো রাজনৈতিক দল একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা পায়নি। ফলে দেশটির জন্য জোট সরকার গঠন অনিবার্য হয়ে উঠেছে। জোট সরকার গঠন নিয়ে নওয়াজ শরিফ ও বিলাওয়াল ভুট্টোর দল সবচেয়ে বেশি এগিয়ে আছে। তারা ক্ষমতার ভাগাভাগিতে সমঝোতার চেষ্টা করছে। তবে কোনো পক্ষই এ বিষয়ে স্পষ্ট করে কিছু বলছে না।
পর্যবেক্ষকদের ভাষ্য অনুযায়ী, পাকিস্তানের পরবর্তী প্রধানমন্ত্রী যিনিই হন না কেন, আগামী দিনগুলোয় জাতীয় পরিষদে ১৬৯ জন সদস্যের সংখ্যাগরিষ্ঠতা দেখাতে হবে তাকে। পাকিস্তানের নির্বাচন কমিশনের ফল অনুসারে, সাবেক প্রধানমন্ত্রী নওয়াজ শরিফের দল পিএমএল-এন এবারের নির্বাচনে ৭৫টি আসনে জয় পেয়েছে। অন্যদিকে বিলাওয়াল ভুট্টো জারদারির দল পিপিপি পেয়েছে ৫৪টি আসন। অর্থাৎ এই দুই-এ মিলে আসন সংখ্যা হচ্ছে ১২৯। সংখ্যাগরিষ্ঠতার জন্য তাদের প্রয়োজন আরও ৪০ আসন। এ কারণে তারা সুযোগ-সুবিধা ও পদ-পদবির টোপ দিয়ে স্বতন্ত্র এবং অন্য দলগুলোকে সঙ্গে আনার জোর চেষ্টা চালানো হচ্ছে। এরই মধ্যে ধারণা পাওয়া গেছে, নওয়াজ-বিলাওয়াল জোট সরকারে যুক্ত হতে পারে মুত্তাহিদা কওমি মুভমেন্ট-পাকিস্তান (এমকিউএম-পি), জেইউআইএফসহ আরও কয়েকটি রাজনৈতিক দল। জোট গড়ার ক্ষেত্রে বিলাওয়ালকে সরকারপ্রধানের পদে বসানোর কৌশল বেছে নিয়েছে পিপিপি। এ নিয়েই দলটি পিএমএল-এনের সঙ্গে আলাপ-আলোচনা চালিয়ে যাচ্ছে। প্রাপ্ত খবর অনুযায়ী, পাওয়ার শেয়ারিং ফর্মুলা বা ক্ষমতা ভাগাভাগি সূত্রের অধীনে ক্ষমতায় বসা নিয়ে আলোচনা করছে উভয় দল। এই সূত্রের আওতায় পাঁচ বছরের মেয়াদের অর্ধেক সময়ের জন্য পিপিপি এবং বাকি অর্ধেক সময়ের জন্য পিএমএল-এন তাদের দল থেকে প্রধানমন্ত্রী নিয়োগ দেবেন। এই সম্ভাবনা নিয়েই মূলত আলোচনা চলছে। এ আলোচনার সঙ্গে জড়িত একটি সূত্রের মতে, ৮ ফেব্রুয়ারির নির্বাচনের পর কেন্দ্র ও প্রদেশে জোট সরকার গঠনের প্রচেষ্টার অংশ হিসেবে গত রবিবার লাহোরে প্রথমবারের মতো আলোচনায় বসেন পিপিপি ও পিএমএল-এন নেতারা। এ সময়ই অর্ধেক মেয়াদের জন্য প্রধানমন্ত্রী নিয়োগের ধারণাটি প্রথমবার আলোচনা করা হয়েছিল। বিলাওয়াল হাউসে অনুষ্ঠিত বৈঠকে উভয় পক্ষই সাধারণ নির্বাচনের পর দেশটিতে রাজনৈতিক স্থিতিশীলতার জন্য সহযোগিতা করতে নীতিগতভাবে সম্মত হয়। বৈঠকে পিপিপির সাবেক প্রেসিডেন্ট আসিফ আলী জারদারি, পিপিপির চেয়ারম্যান বিলাওয়াল ভুট্টো জারদারি এবং পিএমএল-এনের পক্ষ থেকে সাবেক প্রধানমন্ত্রী শাহবাজ শরিফ উপস্থিত ছিলেন। বৈঠকে উভয় দলের নেতারাই দেশটির রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট এবং উন্নতির জন্য সহযোগিতামূলক প্রচেষ্টার গুরুত্ব নিয়ে আলোচনা করেন।
জানা গেছে, এ সময় পিএমএল-এন নেতারা প্রধানমন্ত্রীর আকর্ষণীয় পদের দাবি জানালে পিপিপির সাবেক প্রেসিডেন্ট আসিফ আলী জারদারি বলেন, তাদের দলের কেন্দ্রীয় নির্বাহী কমিটি (সিইসি) এরই মধ্যে বিলাওয়ালকে প্রধানমন্ত্রী পদের জন্য মনোনীত করেছে। দেশটির তিনবারের সাবেক প্রধানমন্ত্রী নওয়াজ শরিফের শীর্ষ এক সহযোগী নাম প্রকাশ না করার শর্তে বার্তা সংস্থা ডিপিএকে বলেছেন, ‘আমরা ক্ষমতা ভাগাভাগির একেবারে কাছাকাছি পৌঁছেছি। এ সপ্তাহটি গুরুত্বপূর্ণ।’
পর্যবেক্ষকরা বলছেন, এর বিপরীতে ইমরান খানের পক্ষে নির্বাচন করা স্বতন্ত্র প্রার্থীদের বিজয়ী আসন ১০১টি। পার্লামেন্টে এখন যদি তারা একক ব্লকে বা ছোট কোনো দলে যুক্ত হন, তাহলে সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জনে জোর পদক্ষেপ নিতে পারেন। সংরক্ষিত আসন বরাদ্দ পেতে পারেন। এমনকি প্রধানমন্ত্রী পদেও প্রার্থী দাঁড় করাতে পারেন। এ ছাড়া জোট গড়ার জন্য অন্যান্য রাজনৈতিক দলের সঙ্গেও আলোচনা করতে পারে স্বতন্ত্রদের দল বা জোট। এর ফলে প্রকারান্তরে ইমরান-সমর্থিতদের পাকিস্তানের ক্ষমতার কেন্দ্রে আবারও দেখা যাবে। এই পরিস্থিতি ইমরানের মুক্তির পথ খুলে যাবে। যদিও আইনি বাধা থাকায় ইমরান নিজে সরকারপ্রধান হওয়ার লড়াইয়ে আপাতত শামিল হতে পারবেন না।
প্রাপ্ত খবর অনুযায়ী, কারাবন্দি ইমরান খানের রাজনৈতিক দল পাকিস্তান তেহরিক-ই-ইনসাফ (পিটিআই) সমর্থিত প্রার্থী, যারা স্বতন্ত্র হিসেবে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেছেন, তাদের অন্য দলে যোগ দিতে আইনি কোনো বাধা নেই। ফলে প্রতিপক্ষের নানা টোপের প্রতি আকৃষ্ট হয়ে অনেকেরই পিটিআই থেকে বেরিয়ে যাওয়ার আশঙ্কা তৈরি হয়েছে। এরই মধ্যে ডজনখানেক বিজয়ী প্রার্থী এ পথে হেঁটেছেনও। যদিও দেশটির সংবাদমাধ্যম এআরওয়াই নিউজের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, রবিবার পর্যন্ত অন্তত ছয়জন স্বতন্ত্র প্রার্থী নওয়াজ শরিফের দল পিএমএল-এনে যোগ দিয়েছেন। তাদের মধ্যে পিটিআইয়ের সমর্থন নিয়ে লাহোরের একটি আসন থেকে জয়ী শহরটির সাবেক ডেপুটি মেয়র ওয়াসিম কাদির প্রথম এদিন স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে নওয়াজের দলে যোগ দেন। এরপর স্বতন্ত্র হিসেবে পিএমএল-এনে যোগ দিয়েছেন নির্বাচনে জয়ী রাজা খুররাম নওয়াজ, ব্যারিস্টার আকেল, পীর জহুর হুসেইন কুরেশি, সরদার শমসের মাজারি ও ব্যারিস্টার মিয়া খান বুগতি। বিভিন্ন সূত্র জানাচ্ছে, জোট সরকার গঠন করা নিয়ে পিএমএল-এন ও পিপিপির মাঝে এখনো সমঝোতা না হওয়ায় পিটিআই-সমর্থিত অন্তত ১৫ থেকে ২০ জন স্বতন্ত্র প্রার্থীকে দলে ভেড়ানোর জন্য যোগাযোগ করে যাচ্ছে পিএমএল-এন।
আরো পড়ুন : জোটবদ্ধ থাকার ২০তম বর্ষে এসে বিলুপ্তির মুখে ১৪ দলীয় জোট