নজিরবিহীন অর্থনৈতিক সংকটে পরা শ্রীলঙ্কা যেভাবে ঘুরে দাঁড়াল

অর্থনীতি আন্তর্জাতিক ওকে নিউজ স্পেশাল জনপ্রতিনিধি প্রচ্ছদ রাজনীতি সফলতার গল্প হ্যালোআড্ডা

অর্থনৈতিক রিপোর্টার : শ্রীলঙ্কায় নজিরবিহীন অর্থনৈতিক সংকটের মুখে পতন ঘটে রাজাপাকসে সরকারের। আকাশছোঁয়া মুদ্রাস্ফীতি, পরিকল্পনাহীন ও অপ্রয়োজনীয় বিলাসবহুল প্রকল্প, ঋণের জট, রিজার্ভ সংকটসহ সরকারের দুর্বল অর্থনৈতিক ব্যবস্থার কারণে এই বিপর্যয় ঘটে। দেশটি ৪ হাজার ৬০০ কোটি ডলার বৈদেশিক ঋণ প্রদান করতে না পেরে দেউলিয়া হয়ে যায়। তবে মাত্র দেড় বছরে ভয়াবহ অর্থনৈতিক বিপর্যয়ের জেরে প্রায় দেউলিয়া হতে বসা দ্বীপরাষ্ট্র শ্রীলঙ্কার সার্বিক পরিস্থিতি এখন অনেকটাই স্থিতিশীল। এ ছাড়া খাদ্য ও জ্বালানি সংকট কাটিয়ে ওঠার পাশাপাশি দেশটির বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভও এখন ঊর্ধ্বমুখী।

এদিকে বৈদেশিক ঋণে জর্জরিত দেশটি ২০২১ সালের সেপ্টেম্বরে বাংলাদেশের রিজার্ভ থেকে কারেন্সি সোয়াপ পদ্ধতির আওতায় যে ২০০ মিলিয়ন ডলার ঋণ নিয়েছিল, তার পুরোটাই গত সপ্তাহে সুদসহ পরিশোধ করেছে শ্রীলঙ্কা। অন্যান্য দেশ ও দাতা সংস্থার কাছ থেকে নেয়া ঋণও একটু একটু করে পরিশোধ করে দিচ্ছে তারা। এখন বিশ্লেষকদের প্রশ্ন, প্রায় ধ্বংসস্তূপ থেকে উঠে দাঁড়িয়ে যেভাবে প্রত্যাবর্তন করলো শ্রীলঙ্কা, তার পেছনের কারণ ও নীতিগুলো কী ছিল? তাদের মতে, সরকার ও কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কিছু নীতি পরিস্থিতির উন্নতিতে ভূমিকা রেখেছে। ফলে দেশটির অর্থনীতির গুরুত্বপূর্ণ অবলম্বন পর্যটন খাতে সুদিন ফিরছে, রেমিট্যান্স বাড়ছে, শিল্প উৎপাদন বাড়ছে এবং কৃষি উৎপাদনও ভালো হচ্ছে। এ ছাড়া সরকার ব্যয় কমিয়ে রাজস্ব বাড়িয়েছে এবং সংস্কার কার্যক্রম জোরদার করে করজাল বিস্তৃত করেছে।

পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক আহসান এইচ মনসুর বলেন, শ্রীলঙ্কা কঠোর ব্যবস্থা নিয়েছে। পরিস্থিতি সামাল দিতে সরকার শুরু থেকেই ব্যয় কমানোর চেষ্টা করে ও রাজস্ব আয় বাড়ানোর উদ্যোগ নেয়।

জোর দেয়া হয় বিদেশে দক্ষ কর্মী পাঠানোর ওপর। এ ছাড়া ব্যয় সাশ্রয়ে চলতি বছরেও সব মন্ত্রণালয়ের বাজেট ৬ শতাংশ করে কমিয়েছে রনিল বিক্রমাসিংহের সরকার। দেশটির সামরিক বাহিনীর সদস্য সংখ্যা কমিয়ে অর্ধেকে আনার পরিকল্পনাও করা হয়। তিনি বলেন, তারা পর্যটন নির্ভর দেশ। পর্যটকরা এখন ফেরত এসেছে। সার আমদানির ফলে তাদের কৃষি খাত ঘুরে দাঁড়াচ্ছে।

বিবিসি বাংলা জানায়, গত বছর বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ তলানিতে নেম যাওয়ায় দেশটি কয়েক মাস খাদ্য, জ্বালানি ও ওষুধের সংকটে ভোগে। বিদ্যুৎহীন হয়ে যায় পুরো দেশ। ওই সময়ে দেশটিতে অর্থনৈতিক সংকটের পথ ধরে মানুষ রাস্তায় নেমে আসে। ব্যাপক বিক্ষোভে তখন প্রেসিডেন্ট গোতাবায়া রাজাপাকসের পতন হয়। কিন্তু গত এক বছরে দেশটিতে সংকট অনেকটাই কেটে যাচ্ছে। যেখানে গত বছরের সেপ্টেম্বরে দেশটিতে মূল্যস্ফীতি ছিল ৬৯.৮ শতাংশ, গত জুলাই মাসে তা কমে হয়েছে ৬.৩ শতাংশ এবং গত আগস্টে তা আরও কমে হলো ৪ শতাংশ। শ্রীলঙ্কার কেন্দ্রীয় ব্যাংক আশা করছে মূল্যস্ফীতি আরও কমে আসবে। দেশটির কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, গত জুলাই মাসে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ৩ কোটি ৮০ লাখ ডলার বেড়ে হয়েছে ৩৭৬ কোটি ২০ লাখ ডলার।

এদিকে আগের বছরের তুলনায় এ বছর পর্যটন খাত থেকে শ্রীলঙ্কার আয় বেড়েছে ২৫ শতাংশের বেশি। আর রেমিট্যান্স বেড়েছে প্রায় ৭৬ শতাংশ। তবে এই এক বছরে সবচেয়ে বড় অগ্রগতি হয়েছে শ্রীলঙ্কার শিল্প উৎপাদনের ক্ষেত্রে। চলতি বছরের প্রথম তিন মাসে উৎপাদন বেড়েছে প্রায় ৭ শতাংশ। কৃষি খাতও ভালো করতে শুরু করেছে। বিশেষ করে চা ও রাবার রপ্তানি বেড়েছে।

গত মার্চ মাসে দেশটি আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) কাছ থেকে ২৯০ কোটি ডলার বেইল আউট ঋণ পেয়েছে। আইএমএফ বলছে, টেকসই উন্নয়নের সম্ভাবনা আমরা দেখতে পাচ্ছি।

এ সাফল্যের পেছনে শ্রীলঙ্কার কেন্দ্রীয় ব্যাংকের গভর্নর পি নন্দলাল বীরাসিংহে। তার নেতৃত্বে সেন্ট্রাল ব্যাংক অব শ্রীলঙ্কার (সিবিএসএল) নেয়া পদক্ষেপগুলোই দেশটিকে কার্যকরভাবে সমৃদ্ধির পথে ফিরিয়ে এনেছে বলে অনেকে মনে করেন।

বাংলাদেশ ব্যাংকের এক শীর্ষ কর্মকর্তা জানান, দুই বছর আগে মুদ্রা বিনিময় চুক্তির মাধ্যমে বাংলাদেশ থেকে নেয়া ২০০ মিলিয়ন ডলার ঋণের পুরোটাই পরিশোধ করেছে শ্রীলঙ্কা। শ্রীলঙ্কা শেষ কিস্তির ৫০ মিলিয়ন ডলার ও ঋণের সুদ বাবদ ৪.৫ মিলিয়ন ডলার পরিশোধ করেছে। ২০২১ সালে শ্রীলঙ্কাকে তিন কিস্তিতে ঋণ দিয়েছিল বাংলাদেশ। ওই বছরের ১৯শে আগস্ট প্রথম কিস্তিতে ৫০ মিলিয়ন ডলার, এর ১১ দিন পর দ্বিতীয় কিস্তিতে ১০০ মিলিয়ন ডলার এবং সেপ্টেম্বরে আরও ৫০ মিলিয়ন ডলার দিয়েছিল। এর আগে গত ২রা সেপ্টেম্বর বাংলাদেশকে ১০০ মিলিয়ন ডলার ফেরত দিয়েছিল শ্রীলঙ্কা। তার আগে ১৭ই আগস্ট প্রথম কিস্তিতে ৫০ মিলিয়ন ডলার পরিশোধ করেছিল দেশটি।

অর্থনীতি বিশ্লেষক মামুন রশীদ বলেন, শ্রীলঙ্কার ভয়াবহ অর্থনৈতিক সংকট শুরুর পর সরকার সংশোধনমূলক বেশ কয়েকটি পদক্ষেপ গ্রহণ করেছিল। দেশটি দ্বিপক্ষীয় ঋণদাতা অর্থাৎ ভারত ও চীনের সঙ্গে তার ঋণ পুনর্গঠনের সিদ্ধান্ত নেয়। বিশ্বব্যাংক ও আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের কাছে ঋণ পায়। সুদের হার এবং মুদ্রাস্ফীতি স্থিতিশীলের সিদ্ধান্ত নেয়। দেশটি বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ মজুত স্থিতিশীল করার পদক্ষেপ নেয়। পাশাপাশি রাজস্ব আহরণ বাড়ানোর পদক্ষেপও নেয়। এরপর থেকে শ্রীলঙ্কার অর্থনৈতিক সূচকগুলো পুনরুদ্ধার শুরু হয়।

অর্থনীতিবিদরা বলেন, নতুন গভর্নর আসার পর সরকার তাকে স্বাধীনভাবে দুটি কাজ করার সুযোগ দেয়। মূলত যে দুটি খাতে তিনি হাত দেন তাহলো, নীতি সুদহার বৃদ্ধি ও মুদ্রার একক বিনিময় হার নিশ্চিত করা। অন্যান্য দেশের মতো শ্রীলঙ্কায়ও মুদ্রার অনানুষ্ঠানিক বাজার আছে, সেখানকার কারসাজির কারণেও মুদ্রার বিনিময় হারে প্রভাব পড়ে, মূল্যস্ফীতি বাড়ে। তবে মুদ্রার বিনিময় হারের ওঠানামা করলেও নীতি সুদহার বৃদ্ধির মধ্যদিয়ে মূল্যস্ফীতির রাশ টেনে ধরা গেছে।

চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের সাবেক অধ্যাপক মইনুল ইসলাম বলেন, শ্রীলঙ্কা বৈদেশিক ঋণের ভারে এতটাই নুয়ে পড়েছিল যে তারা আর আমদানি ব্যয় মেটাতে পারছিল না। ফলে তীব্র সংকট দেখা দিয়েছিল খাদ্য, ওষুধসহ নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের। এত অল্প সময়ে ঘুরে দাঁড়ানোর পেছনে দুর্নীতি, পুঁজি লুণ্ঠন কিংবা ব্যবসায়ীদের সিন্ডিকেট দমনের মতো চেষ্টা তাদের করতে হয়নি।

আরো পড়ুন : টালবাহানা না করে অবিলম্বে পদত্যাগ করুন, না হয় ফয়সালা হবে রাজপথে

Share The News

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *