ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থানে ৫ই আগস্ট পতন হয় হাসিনা সরকারের। ওইদিন সকালে আন্দোলন চলাকালে মিরপুর-১০ নম্বরে ছাত্রলীগ-যুবলীগের হামলায় আহত হন মো. আশরাফুল। ধারালো অস্ত্র দিয়ে মাথায় কুপিয়ে জখম করা হয় তাকে। এরপর চার মাস পেরিয়ে গেলেও আর কথা বলতে পারেনি আশরাফুল। বিদেশে তার উন্নত চিকিৎসার জন্য আকুতি জানিয়েছে পরিবারটি।
সরজমিন রাজধানীর ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব নিউরোসায়েন্স অ্যান্ড হাসপাতালে গণঅভ্যুত্থানে আহত ব্যক্তির খোঁজ নিয়ে দেখা যায়, হাসপাতালটির এইচডিইউ তথা হাই ডিপেন্ডেন্সি ইউনিটের ৬ নাম্বার বেডে কম্বল গায়ে জড়িয়ে নির্বাক শুয়ে আছেন মো. আশরাফুল। গলার মধ্যে নল ঢুকিয়ে তাকে নিয়মিত দেয়া হচ্ছে তরল খাবার। ওই ইউনিটের দায়িত্বে থাকা নার্স বলেন, আশরাফুল নড়াচড়া করতে পারেন না। মাঝে মধ্যে শোয়া অবস্থায় হাত-পা নাড়ান তিনি। ডাকলেও কোনো সাড়া দেন না।
আশরাফুলের স্ত্রী জেসমিন আক্তারের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, মিরপুর-১৪ নাম্বারে একটি ভাড়া বাসায় মেসে থাকতেন আশরাফুল। পেশায় ছিলেন সিএনজি চালক। সেখান থেকে তিনি মিরপুর-১০ নাম্বারে ছাত্র-জনতার আন্দোলনে যুক্ত হন। ৫ই আগস্ট সকালে দুর্বৃত্তদের ধারালো অস্ত্রের দ্বারা মাথায় আঘাতপ্রাপ্ত হন তিনি। এরপর আশরাফুলকে নেয়া হয় ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে। দুইদিন পরে ৭ই আগস্ট তার উন্নত চিকিৎসার জন্য নেয়া হয় সিরাজ-খালেদা মেমোরিয়াল ক্যান্টনমেন্ট বোর্ড জেনারেল হাসপাতালে। আশরাফুলের শারীরিক অবস্থার কোনো উন্নতি না হলে ১২দিন পর তাকে নেয়া হয় কুর্মিটোলা জেনারেল হাসপাতালে। তবে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ তাকে ভর্তি করাতে সম্মত হয়নি। উপায় না পেয়ে আশরাফুলকে ১৯শে আগস্ট ভর্তি করা হয় নিউরোসায়েন্স হাসপাতালে। চার মাস পেরিয়ে গেলেও আশরাফুলের অবস্থার কোনো উন্নতি ঘটেনি।
তার স্ত্রী জেসমিন আকুতি জানিয়ে বলেন, আমরা চাচ্ছি, উন্নত চিকিৎসা করার জন্য যেন তাকে বাহিরে নেয়া হয়। গত মাসে তাকে দেখতে উপদেষ্টা আসিফ ও স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের সচিব এসেছিলেন। এই হাসপাতালের দ্বীন মোহাম্মদ স্যার ও মাহফুজ স্যারকে বলেছি আগে তাদের একটা আগ্রহ ছিল, এখন তেমন কোনো আগ্রহ দেখছি না। উনারা বিষয়টি গুরুত্ব দিচ্ছেন না। তাকে যদি বাহিরে নিয়ে গিয়ে চিকিৎসা করানো যেত, তাহলে আমার হাজবেন্ড স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসতো। বাকিদের উন্নত চিকিৎসার জন্য বিদেশে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। আমিই শুধু এখানে আছি। এই বিষয়ে তিনি স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ে আবেদন করেছেন বলে জানান।
আশরাফুল পরিবারের একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তি উল্লেখ করে তার স্ত্রী জেসমিন বলেন, আশরাফুল ভাড়া করে সিএনজিসহ বিভিন্ন ধরনের গাড়ি চালাতো। আমার ৫ বছরের মেয়ে আছে, ওর খালার বাসায় সাভারে রেখেছি। ছেলের বয়স ৩ বছর। ওকে কিশোরগঞ্জ গ্রামের বাড়িতে দাদীর কাছে রেখে আসছি। এখনো পর্যন্ত সংসারের দায়িত্ব কেউ নেয়নি। তবে কিছু ফাউন্ডেশন, প্রধান উপদেষ্টা ড. ইউনূস এবং ছাত্রদলের কাছ থেকে কিছু টাকা পেয়েছি। যখন আসছিলাম তখনই এটা দেয়া হয়েছে। পরে আর কিছু পাইনি। সেটা দিয়ে সংসার ও খাবারের খরচ চলছে। এখন পর্যন্ত ১ লাখ ৮০ হাজার টাকা অনুদান পেয়েছেন বলে উল্লেখ করেন জেসমিন।
আশরাফুলের ওষুধের বিল নিউরোসায়েন্স হাসপাতাল বহন করছে উল্লেখ করে জেসমিন বলেন, কোনো ওষুধ লাগলে ওয়ার্ড থেকে সেটার একটা স্লিপ দিয়ে যায়। এরপর আমি বাইরে থেকে সেটা কিনে আনি। সেই ওষুধের রিসিপ্ট হাসপাতালে জমা দিলে টাকা দিয়ে দেয়। এ ছাড়া আমার খাবার হাসপাতালের ক্যান্টিন থেকেই দেয়া হয়। তবে সিরাজ-খালেদা হাসপাতালে সকল চিকিৎসার খরচ আমাকেই বহন করা লাগছে। বাচ্চাদের রেখে হাসপাতালেই দিন-রাত থাকতে হচ্ছে আমাকে। আর কতোদিন এভাবে থাকবো? আশরাফুলের উন্নত চিকিৎসার জন্য বিদেশে নিয়ে যাওয়ার কোনো উদ্যোগ নেয়া হচ্ছে না।
আরো পড়ুন : নেত্র নিউজের অনুসন্ধানে রাকিবের মৃত্যু