দাউ দাউ করে আগুন জ্বলছে। কু-লি পাকিয়ে আকাশে উড়ছে কালো ধোঁয়া। মিজানুর রহমান তাকিয়ে তাকিয়ে দেখছেন করুণ সেই দৃশ্য। আর অঝর নয়নে কাঁদছেন। এই ধোঁয়ার সঙ্গে উড়ে যাচ্ছে তার তিলে তিলে গড়া দোকানগুলো। নিউ রাজু গার্মেন্টস নামের ৭টি দোকানের স্বত্বাধিকারী তিনি। সবগুলোই পুড়ে ছাই। তার দোকানে ১৫ জন কর্মচারী কাজ করতেন। তারা সবাই হতভম্ব। কেউ ঠিকমতো কথা বলতে পারছেন না।
বঙ্গ মার্কেটের ধ্বংসলীলা দেখে নির্বাক তারা। মিজানুর জানান, বঙ্গ কমপ্লেক্সের নিচতলায় ছিল এক সিরিয়ালে ৪টা দোকান। বাকিগুলো ছিল দোতলায়। সব পুড়ে ছাই হয়েছে।
মিজানুরের গ্রামের বাড়ি লক্ষ্মীপুর জেলার রামগঞ্জ থানায়। ১৯৯৭ সাল থেকে বঙ্গ মার্কেটে ব্যবসা করেন। তখন একটা দোকান দিয়ে ব্যবসা শুরু করেছিলেন। ধীরে ধীরে ৭টা দোকান দেন সেখানে। মিজানের দোকানগুলোতে সবধরনের জামাকাপড় বিক্রি হতো। থ্রি কোয়ার্টার প্যান্ট, টাউজার, শর্টপ্যান্ট, বক্সার, গেঞ্জিও ছিল। দোকান থেকে কিছুই বের করতে পারেননি তারা। ব্যবসার হিসাবের খাতাপত্রও পুড়ে গেছে। ক্ষতি হয়েছে কোটি কোটি টাকা। মিজানুর বলেন, দোকান থেকে একটা সুতাও বের করতে পারি নাই। ৭ থেকে ৮ কোটি টাকার মাল ছিল দোকানগুলেতো। এরমধ্যে বিভিন্ন পার্টির কাছ থেকে ২ কোটি টাকার বেশি ঋণ আছে আমার। ঈদের মৌসুমের জন্য মাল ওঠাতে আত্মীয়স্বজনদের থেকেও ঋণ এনেছি।
মিজানুর ভোরে তার ভাই নুর নবীর ফোন পেয়ে ছুটে আসেন মার্কেটে। তখন ৬টার মতো বাজে। ঘটনার বর্ণনা দিয়ে তিনি বলেন, এসে দেখি আগুন তখন বেশি ছিল না। দুইটা ফায়ার সার্ভিসের টিম ছিল। একটা ফায়ার সার্ভিস পুলিশ হেডকোয়ার্টারে পানি মারছিলো। পুলিশ হেডকোয়ার্টার বাঁচানোর জন্য তারা সেখানে পানি মারছিল। আরেকটা বঙ্গ ও গুলিস্তান মার্কেটের গলি দিয়ে পানি মারছিল। কিন্তু সেটাতে কোনো স্পিড ছিল না। মিজানুর বলেন, তার কিছুক্ষণের মধ্যেই মার্কেটের ৩য় তলার অনেকগুলো শো-রুমের এসি বিস্ফোরণ হয়। সঙ্গে সঙ্গে পুরো মার্কেটে আগুন ছড়িয়ে যায়। তখন ওই দুই ফায়ার সার্ভিস দল আর নিয়ন্ত্রণ করতে পারে নাই।
আগুনের দাবানলে দোকান পুড়তে দেখেছেন ইফতি। এক ব্যবসায়ীকে জড়িয়ে ধরে কান্না করছিলেন। বঙ্গ মার্কেটে ৫টা দোকান ছিল তার। দোকানের নাম প্রিয়া শাড়ি হাউস। সবগুলোই শাড়ির দোকান। ঈদ উপলক্ষে নতুন শাড়ি উঠিয়েছিলেন দোকানে। আগুনে পুড়ে ছাই হয়েছে সব। ইফতি বলেন, মোট ৪০-৪৫ লাখ টাকার মতো ঋণ ছিল আমার। মানুষের থেকেও এক কোটি টাকার মতো পেতাম। আগুনের খবর পেয়ে ৭টার দিকে এসে দেখি আমার কিছুই নাই। একটা কাগজও বের করতে পারি নাই। আমাদের সবকিছু এটা দিয়েই। সাড়ে ৪ হাজার দোকান বিশিষ্ট একটা মার্কেট কয়লা হয়ে গেছে।
ইফতি জানান, তার দাদার আমল থেকে বঙ্গ মার্কেটে ব্যবসা শুরু করেন। তার চাচারাও দোকান করে এই বঙ্গ বাজারে। এই মার্কেটের সব মহাজনের একাধিক দোকান। সব পুড়ে ছাই। কিছুই নাই। ইফতির ৭টি দোকানে ১৫ জন কর্মচারীও ছিল। তিনি বলেন, এই ক্ষতি একমাত্র পূরণ করতে পারবো আল্লায়। এক দোকান চালাইতে ৪-৫ জন কর্মচারী দরকার। তাহলে কতোগুলো পরিবারের ক্ষতি হলো। এই পরিবারগুলোর কী হবে।
২০০৮ সাল থেকে বঙ্গ মার্কেটে ব্যবসা করেন আরিফ হোসেন। বঙ্গ মার্কেট, মহানগর শপিং কমপ্লেক্স আর এনেক্সো টাওয়ারে একাধিক দোকান ছিল তার। সব মিলে ৮টি দোকান। কর্মচারী ছিল ১৬ জন। মোট সাড়ে ৩ কোটি টাকার মাল ছিল দোকানগুলোতে। আরিফ জানান, ২ ব্যাংক থেকে ৫০ লাখ টাকা ঋণ নিয়েছিলেন। এরমধ্যে মাত্র এক কিস্তি দিয়েছেন ৪ লাখ ২৫ হাজার টাকার। তিনি বলেন, অন্যান্য বছরে এই সময়ে এবারের চেয়ে ৫০ ভাগ মাল বেশি বিক্রি হতো। কিন্তু এবার তাও হয় নাই। সব মাল গোডাউনে ছিল। দোকানে ছিল। সব শেষ হয়ে গেছে। ১৯৯৬ সালে একবার এমন হইছে। এরপর আর দেখি নাই এমন।
আরিফ বলেন, সকাল ৬টায় এসে দেখি আদর্শ মাকের্টে আগুন লাগছে। এদিকে লাগে নাই। তখন মালামাল বের করতে পারি নাই। মার্কেট কমিটি তালা খুলে নাই। সকালে ফায়ার সার্ভিস শুরুতে অবহেলা করেছে। তাদের অফিসের সামনেই মার্কেট। আগুন তো হুট করে লাগে নাই। তারা আগে পুলিশ হেডকোয়ার্টার বাঁচাইছে। মার্কেট পুরে শেষ।
জান্নান এন্ড জিন নামের ৩টা দোকান ছিল মোজাম্মেল হকের। সেখানে ৭০-৮০ লাখ টাকার মালামাল ছিল। সব মেয়েদের কাপড়। লেডিস গেঞ্জি আর ওয়ান পিসের দোকান। তিনি বলেন, মার্কেট থেকে এক লোক ফোন দিছে। আসার পর আদর্শ মার্কেটে আগুন দেখছি। পরে বঙ্গতে লেগেছিল। কোনো মাল বের করতে পারি নাই। যাও একটু বের করছি রাস্তায় তাও মার্কেট ধসে পড়ে পুড়ে গেছে। আমার ব্যাংক ঋণ ছিল ৩০ লাখ টাকার বেশি। মাসে কিস্তি দিতাম ১ লাখ ১৯ হাজার টাকা।
বঙ্গ মার্কেটের নিচতলায় অঙ্গবিলাস নামের একটি দোকান তৌহিদুল ইসলামের। ওয়ান পিস টপস বিক্রি করতেন। চার-পাঁচ লাখ টাকার মালামাল ছিল তার দোকানে। সকালে খবর পেয়ে ৭টার দিকে এসে দেখেন বঙ্গ মার্কেটের দোতলার কাঠের মার্কেটের বেশির ভাগই পুড়ে গেছে। তিনি বলেন, কিছুই বের করতে পারি নাই। ফায়ার সার্ভিসের তৎপরতা শুরুতে কম ছিল। মার্কেটের পূর্বপাশে ও উত্তরপাশে শুরুর দিকে ২-৩টা গাড়ি দিয়ে পানি দিছে। পরে যেভাবে কাজ করছে তার শুরু থেকে করলে আগুন এত ছড়াতো না।
পানিতে ভেজা শিশুদের গেঞ্জি শুকানোর চেষ্টা করছিলেন তাওহিদ। দোকানের অর্ধেক পণ্য বের করতে পেরেছিলেন তারা। তাওহিদ বলেন, দোকানে ৮-১০ লাখ টাকার মাল ছিল। অর্ধেক বের করতে পারছি। এগুলোও সব ভিজে গেছে। কিছু পুড়ে গেছে।
আরো পড়ুন : খুনের মামলা থেকে বাঁচতে সাধারন মানুষের কাছ থেকে কোটি টাকা চাঁদা শাহিন তৌহিদুলের