চারদিকে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে শত শত লাশ। টানা ২৪ ঘণ্টা ধরে মানুষের ছিন্নভিন্ন শরীরের বিভিন্ন অংশ কুড়াচ্ছেন উদ্ধারকারীরা। লাশের পরিচয় তো দূরে থাক, নারী না পুরুষ তা বুঝাই দুষ্কর। শুধু আকারে ছোট বলে শিশুদের মরদেহগুলো আলাদা করে শনাক্ত করা যাচ্ছে। ইসরাইলি হামলায় গাজার আল-আহলি হাসপাতাল পরিণত হয়েছে এমনই ভয়ানক এক মৃত্যুপুরীতে। এই রিপোর্ট লেখা পর্যন্ত পাঁচ শতাধিক নিরীহ ফিলিস্তিনির নির্মম মৃত্যু হয়েছে এই হামলায়। এখনো বহু মানুষ ধ্বংসস্তূপের নিচে চাপা পড়ে আছে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে। ভিকটিমদের বেশির ভাগই নারী ও শিশু। গাজার স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, হামলার ভয়াবহতা এতটাই বেশি যে, মরদেহের পরিচয় উদ্ধারই কঠিন হয়ে যাচ্ছে।
গাজার উপর ইসরাইলের আগ্রাসন চলছে যুগের পর যুগ ধরে। এরমধ্যে গত প্রায় দুই সপ্তাহ ধরে গাজায় অব্যাহতভাবে বিমান হামলা চালিয়ে যাচ্ছে দেশটি।
এতে তিন হাজারের বেশি ফিলিস্তিনি নিহত হয়েছেন। তবে মঙ্গলবার রাতে আল-আহলি হাসপাতালের ওই হামলা নৃশংসতার সব নজির ছাড়িয়ে গেছে। চোখের পলকে পাঁচ শতাধিক মানুষের প্রাণ কেড়ে নিয়েছে ইসরাইলি বোমা। ইসরাইলের বোমা বৃষ্টি থেকে বাঁচতে অনেক ফিলিস্তিনিই ওই হাসপাতালে আশ্রয় নিয়েছিলেন। তাদের আশা ছিল যে, অন্তত হাসপাতালকে ছাড় দেবে তেল আবিব। কিন্তু গোটা মানবজাতিকে স্তব্ধ করে দিয়ে ভয়ঙ্করতম এই যুদ্ধাপরাধ সংঘটিত করলো ইসরাইল।
এ হামলাকে মানবতাবিরোধী অপরাধ বলে আখ্যায়িত করেছে রাশিয়া। যদিও হামলার পর যথারীতি এর দায় ফিলিস্তিনিদের ওপরই চাপানোর চেষ্টা করছে ইসরাইল। দেশটির সামরিক বাহিনী থেকে প্রধানমন্ত্রী বারবার দাবি করছেন যে, ফিলিস্তিনি যোদ্ধাদের রকেটই গিয়ে ওই হাসপাতালে পড়েছে। বরাবরের মতোই এক্ষেত্রেও পশ্চিমা মিত্রদের সমর্থন পেয়েছে ইসরাইল। এমন হামলার জন্য ইসরাইলের নিন্দা জানানোর পরিবর্তে উল্টো তাদের দাবিকেই সমর্থন দিয়েছে পশ্চিমা দেশগুলো। মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন ইসরাইল সফরে গিয়ে বলেছেন, এ হামলার জন্য ইসরাইল নয়, ‘অন্য পক্ষই’ দায়ী। একই সুর দেখা গেছে, অন্য পশ্চিমা দেশগুলোর গলায়ও। হাসপাতালে বোমা হামলায় ক্ষোভ এবং গভীর বেদনা প্রকাশ করেছেন জো বাইডেন। এ বিষয়ে আরও বিস্তারিত তথ্য সংগ্রহের জন্য নিরাপত্তা উপদেষ্টাদের নির্দেশ দিয়েছেন তিনি।
এদিকে গাজার হাসপাতালে হামলার পর ক্ষোভে ফেটে পড়েছে গোটা মুসলিম বিশ্ব। এর প্রতিক্রিয়ায় যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের সঙ্গে নির্ধারিত একটি বৈঠক বাতিল করেছে জর্ডান। একে গণহত্যা ও যুদ্ধাপরাধ বলে অভিহিত করেছেন জর্ডানের বাদশাহ দ্বিতীয় আবদুল্লাহ। ওই হামলার পর মধ্যপ্রাচ্য ও অন্য দেশগুলোতে স্বতঃস্ফূর্ত প্রতিবাদ বিক্ষোভ দেখা দিয়েছে। বিশ্বজুড়ে ইসরাইলি দূতাবাসের বাইরে প্রতিবাদ বিক্ষোভ করার আহ্বান জানিয়েছে প্যালেস্টাইন ইসলামিক জিহাদ (পিআইজে)। ফিলিস্তিনের ভূখণ্ড দখল এবং জনগণের বিরুদ্ধে গণহত্যার প্রতিবাদে তারা এ আহ্বান জানায়। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে দেয়া পোস্টে তাদের মুখপাত্র বলেছেন, আরব ও বিশ্বের ইসলামী জনগণ এবং বিশ্বের মুক্ত মানুষের প্রতি আমাদের বার্তা হলো- সবারই গণপ্রতিবাদ বিক্ষোভে অংশ নেয়া দায়িত্ব। শুধু রাজপথে নয়, দখলদারদের দূতাবাসের সামনে বিক্ষোভ করতে হবে। এটাকে অস্বীকার করার জন্য কোনো অজুহাত থাকতে পারে না।
গাজার হাসপাতালে নিহতদের জন্য বুধবার একদিনের রাষ্ট্রীয় শোক পালনের ঘোষণা দিয়েছে ইরান। হাসপাতালে ইসরাইলের ওই যুদ্ধাপরাধের কঠোর নিন্দা ও প্রতিবাদ জানিয়েছেন ইরানের প্রেসিডেন্ট ইব্রাহিম রাইসি। তিনি বলেছেন, মার্কিন ও ইসরাইলি বোমার আগুন শিগগিরই ইহুদিবাদীদের গ্রাস করবে। প্রতিক্রিয়া জানিয়েছে সৌদি আরবসহ অন্য আরব দেশগুলোও। মঙ্গলবার ওই হামলার পর একে নৃশংস হামলা বলে সরাসরি প্রত্যাখ্যান করেছে সৌদি আরব। পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় বলেছে, এ হামলার মধ্যদিয়ে আন্তর্জাতিক আইন, নীতি এমনকি আন্তর্জাতিক মানবাধিকার বিষয়ক আইনও লঙ্ঘন করা হয়েছে।
বুধবার রাশিয়ার পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় বলেছে, গাজায় হাসপাতালের উপর হামলা হতাশাজনক এক অপরাধ। এক্ষেত্রে ইসরাইলকে স্যাটেলাইটের ছবি সরবরাহ করে প্রমাণ করতে হবে যে, তারা এই হামলায় জড়িত নয়। রাশিয়ার পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র মারিয়া জাখারোভা রেডিও স্পুটনিককে বলেন, এই হামলা মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধ। হামলার নিন্দা জানিয়েছেন মিশরের প্রেসিডেন্ট আবদেল ফাত্তাহ আল সিসি। তিনি মঙ্গলবার বিবৃতিতে বলেছেন, গাজায় হাসপাতালের উপর ইসরাইলের বোমা হামলার সর্বোচ্চ নিন্দা প্রকাশ করি। এটা সুস্পষ্টভাবে আন্তর্জাতিক আইনের লঙ্ঘন।
জাতিসংঘের মহাসচিব অ্যান্তনিও গুতেরাঁ হামলাকে ভয়ার্ত বা আতঙ্কজনক বলে উল্লেখ করেছেন। তিনি এক্সে এক বার্তা লিখেছেন, হতাহতদের পরিবারের প্রতি আমার সমবেদনা। আন্তর্জাতিক আইনের অধীনে হাসপাতাল এবং হাসপাতাল সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা সুরক্ষিত থাকবে। ইসরাইলের কড়া নিন্দা জানিয়েছে সংযুক্ত আরব আমিরাত। দেশটির পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় বিবৃতিতে বলেছে, প্রাণহানিতে গভীর বেদনা প্রকাশ করছে আমিরাত। হতাহতদের পরিবারের প্রতি সমবেদনা। যারা আহত হয়েছেন তাদের দ্রুত সুস্থতা কামনা করে আমিরাত। এতে অবিলম্বে শত্রুতা বন্ধ করার আহ্বান জানিয়ে বলা হয়, নিশ্চিত করতে হবে বেসামরিক লোকজন এবং প্রতিষ্ঠানগুলোকে টার্গেট করা হচ্ছে না। আরও প্রাণহানি রোধে অবিলম্বে একটি যুদ্ধবিরতিতে আসতে প্রচেষ্টা তীব্র করার জন্য তারা আন্তর্জাতিক সমপ্রদায়ের প্রতি আহ্বান জানায়।
নিন্দা জানিয়েছে কুয়েতও। দেশটি বলেছে, গাজায় আল আহলি হাসপাতালে বর্বর বোমা হামলা চালিয়েছে দখলদার বাহিনী। এতে কয়েক শত নিরীহ মানুষ মারা গেছেন। এর কড়া নিন্দা জানায় কুয়েত। দেশটির পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় বিবৃতিতে বলে, দখলদার বাহিনী আন্তর্জাতিক মানবাধিকার বিষয়ক আইন লঙ্ঘন করে হাসপাতাল ও সরকারি স্থাপনাকে টার্গেট করছে। হামলার নিন্দা জানিয়ে ওআইসি প্রধান হিসেন তাহা এই হামলাকে যুদ্ধাপরাধ ও মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধ বলে বর্ণনা করেছেন। ইসরাইলের অপরাধ, সন্ত্রাসী চর্চা এবং ফিলিস্তিনি জনগণের বিরুদ্ধে নৃশংস হামলার জন্য ইসরাইলকে জবাবদিহিতায় আনার আহ্বান জানান।
আরো পড়ুন : সিঙ্গাপুরে রাষ্ট্রপতির সফল ওপেন হার্ট সার্জারি সম্পন্ন