‘শুধু নির্ভয় দিলে হবে? আপনারা দশদিনের জন্য আমাদের পাহারা দিবেন, তারপর কী হবে? আমাদের ছোট ছেলে-মেয়েদের যদি তুলে নিয়ে যায় তখন কী হবে?’ পুলিশ এবং সাংবাদিকদের উদ্দেশ্যে সত্তরোর্ধ্ব এক নারী এসব প্রশ্ন ছুড়ে দেন। সন্তানদের অপহরণ করা হবে মর্মে বগুড়ার কাহালুর বিষ্ণুপুর গ্রামের প্রায় ৫০০ বাড়ির দরজায় রাতের আঁধারে টাকা দাবি করে দুর্বৃত্তরা নোটিশ লাগিয়েছে গত শনিবার রাতে। ওই ঘটনায় আতঙ্ক কাটেনি অভিভাবকদের। সন্তানদের একা স্কুলে যেতে দিচ্ছে না কেউই। ভয়ে অনেকটা জড়োসড়ো হয়ে আছে। পুরো জেলাজুড়ে সেই আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ছে ক্রমান্বয়ে। তারা বিষয়টিকে হালকাভাবে দেখছেন না। দুর্বৃত্তদের নোটিশে বলা হয়েছে, আগামী ৬ তারিখের মধ্যে ল্যাস্পপোস্টের সঙ্গে রাখা বাক্সে সাদাকাগজে নাম ঠিকানা সহ টাকা পিনআপ করে রেখে আসতে হবে। যদি কেউ টাকা না দেয় তাহলে ৭ তারিখ থেকে ছোট বাচ্চাদের তুলে নিয়ে যাওয়ার মিশন শুরু করবে দুর্বৃত্তরা। ঘটনার সঙ্গে নিষিদ্ধ ঘোষিত পূর্ব-বাংলা সর্বহারা পার্টির সম্পৃক্ততা থাকতে পারে বলে ধারণা করছেন অনেকে।
তবে ঘটনার দুইদিন পার হলেও বগুড়ার পুলিশ ঘটনার ক্লু উদ্ধার করতে পারেনি। এদিকে গেল সোমবার আতঙ্কিত এলাকা পরিদর্শন করেছেন বগুড়ার পুলিশ সুপার সুদীপ কুমার চক্রবর্তী। তিনি গ্রামবাসীকে আতঙ্কিত না হতে অনুরোধ করে বলেছেন, পুলিশ সবসময় আপনাদের পাশে আছে, থাকবে। অপরাধীরা যেই হোক অচিরেই তাদের আটক করা হবে এবং রহস্য উন্মোচন করা হবে।
সরজমিন বিষ্ণুপুর গ্রামে দেখা গেছে প্রায় মানুষ তাদের ছোট সন্তানদের নিয়ে চিন্তায় আছেন। দুর্বৃত্তরা আগামী ৬ তারিখ টাকা প্রদানের শেষদিন উল্লেখ করেছে। এরপর কী হবে সেটাই উদ্বেগের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে গ্রামবাসীর কাছে। কথা হয় বিষ্ণুপুর গ্রামের নয়ন প্রামাণিক, রেজাউল ইসলাম সহ আরও অনেকের সঙ্গে। তারা বলেন, আমরা খুব ভয়ে আছি। ৬ তারিখের মধ্যে টাকা না দিলে ছেলে-মেয়েদের তুলে নিয়ে যাবে। আমাদের ছোট সন্তানদের একা স্কুলে পাঠাতে পারছি না। বাড়ির লোকজন সকালে তাদের স্কুলে রেখে আসে আবার ছুটি হলে নিয়ে আসে। এভাবে কতোদিন আমরা বাচ্চাদের পাহারা দিবো।
এদিকে বগুড়ায় রাতের আঁধারে পোস্টার লাগিয়ে চাঁদাবাজি, চিঠি পাঠিয়ে ডাকাতি করার কিংবা কাউকে হত্যা করা নতুন নয়। এর আগে বহুবার এমন ঘটনা ঘটেছে। ২০১৬ সালের ৮ই জানুয়ারি রাত ১১টার দিকে বগুড়া, সিরাজগঞ্জ ও নাটোর জেলার মিলনস্থল শেরপুরের ভবানীপুর বাজার এলাকায় নিষিদ্ধ ঘোষিত চরমপন্থি দল পূর্ব-বাংলা সর্বহারা পার্টির সশস্ত্র সদস্যরা মিছিল ও পোস্টারিং করেছে। একইসঙ্গে তিন রাউন্ড ফাঁকা গুলি ছুড়ে নিজেদের সশস্ত্র উপস্থিতি জানান দিয়েছিল তারা। ওই সময় প্রত্যক্ষদর্শীরা বলেছিল মুখোশ পরিহিত ৪০-৫০ জনের মতো সশস্ত্র যুবক-যুবতী ভবানীপুর বাজারে এসে অবস্থান নেয়। এরমধ্যে মেয়ে ছিল ৭-৮ জনের মতো। তারা বাজার এলাকায় অবস্থিত বিভিন্ন ব্যবসা প্রতিষ্ঠান, বৈদ্যুতিক খুঁটি ও বিল্ডিংয়ের পিলারে পূর্ব-বাংলার সর্বহারা পার্টির পক্ষে হাতে লেখা রঙ-বেরঙেয়ের পোস্টার সাঁটিয়ে দেয়। পাশাপাশি তারা পার্টির গণরাজনৈতিক প্রচারপত্র দরজা ও সাটারের নিচ দিয়ে কক্ষে কক্ষে ঢুকিয়ে দেয়। প্রায় ঘণ্টা ধরে বাজারে অবস্থান নিয়ে সশস্ত্র দলটি এ ধরনের তৎপরতা চালায়।
এরআগে ১৯৯৯ সালে নওগাঁ জেলার আত্রাই উপজেলার মনিহারি ইউনিয়ন পরিষদের সাবেক চেয়ারম্যান আব্দুস ছাত্তারকে বগুড়ার নন্দীগ্রামের পণ্ডিতপুকুর বাজারে প্রকাশ্যে হত্যা করে সর্বহারা সদস্যরা। এ ছাড়া ২০০১ সালের দিকে ভাটরা ইউনিয়নে বিভিন্ন জায়গায় নিষিদ্ধ ঘোষিত পূর্ব-বাংলা সর্বহারা পার্টির নামে পোস্টার সাঁটানো হয়। তারপর থেকে আর প্রকাশ্যে দেখা যায়নি। কাহালুর বিষ্ণুপুর গ্রামের ঘটনার সঙ্গে পূর্ব-বাংলা সর্বহারা পার্টির কার্যক্রমের অনেকটা মিল আছে। এজন্য বিষয়টিকে ছোট করে দেখার অবকাশ নেই। বিষয়টি নিয়ে কথা হয় সুশাসনের জন্য নাগরিক বগুড়া জেলা কমিটির সাধারণ সম্পাদক হুমায়ুন ইসলাম তুহিনের সঙ্গে। তিনি বলেন, এক রাতে মানুষের চোখ ফাঁকি দিয়ে ৫০০ বাড়ির দরজায় নোটিশ লাগোনো এক দুইজন ব্যক্তির দ্বারা সম্ভব নয়। একটি সঙ্ঘবদ্ধ দল কাজটি করেছে। কোন সংগঠন কী উদ্দেশ্যে এমন আতঙ্ক ছড়ানোর কাজ করেছে তা পুলিশকেই পরিষ্কার করতে হবে সংশ্লিষ্টদের গ্রেপ্তারের মাধ্যমে।
তবে ঘটনার দুইদিন পার হলেও বগুড়ার পুলিশ ঘটনার ক্লু উদ্ধার করতে পারেনি। ওই ঘটনার সর্বশেষ তথ্য জানতে মঙ্গলবার বগুড়ার অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (অপরাধ) মো. আব্দুর রশিদের সঙ্গে কথা বললে তিনি জানান, আমরা এখনো ক্লু উদ্ধার করতে পারিনি। আমাদের টিম কাজ করছে। নতুন কোনো তথ্য পেলে সঙ্গে সঙ্গে জানানো হবে।