পটুয়াখালী সংবাদদাতা: রাশিদা বেগম। বয়স পঞ্চাশের ওপরে। রোগাক্রান্ত শরীর নিয়ে চলছে তার জীবন-সংগ্রাম। ছোট্ট একটি ডিঙি নৌকা নিয়ে এখনো নদীতে ছুটে বেড়ান পেটের তাগিদে। মাছ ধরে জীবিকা নির্বাহ করেন। যা আয় হয়, তা দিয়েই চলে রাশিদার দুই ছেলে ও এক মেয়েসহ পাঁচ সদস্যের সংসার। কৈশোর বয়স থেকেই কোমল হাতে তুলে নিয়েছেন বইঠা। যে বয়সে সহপাঠীদের সঙ্গে রাশিদার হইহুল্লোড় আর গোল্লাছুট-কানামাছি খেলার কথা ছিল, সেই বয়সে সংসারের বোঝা বইতে হয়েছে। এখনো চলছে সেই সংগ্রাম। তার এ সংগ্রামী জীবনের সঙ্গী উজ্জল সরদার। বয়সে ভাটা পড়েছে তারও। তবু দুই জনে মিলে মাছ ধরছেন বুড়াগৌরাঙ্গ নদে। রাশিদা-উজ্জল এই দম্পতির ঠিকানা বলতে শুধুই ছাউনি ঘেরা নৌকা। সারা দিনের কর্মযজ্ঞ শেষে আশ্রয়ের খোঁজে আসেন পটুয়াখালীর রাঙ্গাবালী উপজেলার চর মোন্তাজ ইউনিয়নের স্লুইস খালে।
সরেজমিনে দেখা যায়, বুড়াগৌরাঙ্গ নদে ঢেউয়ের তালে তালে দুলছে একঝাঁক নৌকার বহর। কাছে গিয়ে দেখা যায়, নৌকার সামনে বসে আছে রাশিদা নামের এক মাঝি। কথা হয় তার সঙ্গে। নদীতে থাকার গল্প জানতে চাইলে সব ক্লান্তি ছাপিয়ে হেসে ওঠেন রাশিদা। বললেন তার জীবন কাহিনি। তার বয়স যখন ৮-১০ বছর তখন তাদের ভিটেবাড়ি হারায় নদীভাঙনে। সহায়-সম্পদ হারিয়ে নিস্ব হয়ে গেছি। এরপরে ঠাঁই মেলে নৌকায়। সে বয়সেই বাবামায়ের সঙ্গে নৌকায় করে মাছ ধরতে ধরতে ছাড়তে হয় জন্মভূমি। ঠাঁই মেলে রাঙ্গাবালীর চর মোন্তাজের স্লুইস খালে। শুধু আমিই নই। আমাদের মতো ৮৬ পরিবার এখানে আশ্রয় পেয়েছে। ভিটেমাটি হারানোর কথা বলতেই কান্নায় ভেঙে পড়েন ষাটোর্ধ্ব আম্বিয়া। তিনি অশ্রুভেজা চোখে বলেন, ‘বাবারে এক সময় ঘরবাড়ি, জায়গাজমিও ছিল। নদীভাঙনে আমাগো সব নিয়া নেছে। এরপর স্বামীরে নিয়া এইহানে (এখানে) ৩০ বছর আগে আইছি। পেটের জ্বালা মিটাইতে মাছ ধরা শুরু করছি।’ এ বয়সে পরিশ্রম করতে কষ্ট হয় কি না, জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘আমাগো জীবনটা এরকমই। বইয়া (বসে) থাকলে খামু কী? কে খাওয়াইবে আমাগো?।’
স্থানীয়দের তথ্য মতে, প্রথম পাঁচটি নৌকা নিয়ে তারা এখানে এসেছিল স্লুইস খালে। বর্তমানে ঐ এলাকায় ৮৬টি পরিবারের বসবাস রয়েছে। নদীতে থাকায় তারা এখানে ‘মান্তা সম্প্রদায়’ হিসাবে পরিচিতি লাভ করে। মান্তা বহরে শিশু রয়েছে এক শতাধিক। এসব পরিবারে কর্মঠ নারী সদস্যরা। তাদের ওপর নির্ভর করেই চলে সংসার।
তবে বংশপরম্পরায় জলেভেসে চলা মান্তা সম্প্রদায়ের মধ্যে পরিবর্তনের হাওয়া লেগেছে। শিক্ষার আলো যাদের কাছে ছিল বিলাসিতা, সেই মান্তারা পড়ালেখা শিখছে। প্রশাসনের তথ্যানুযায়ী, তাদের অনেকেই ভোটাধিকারের সুযোগ ও সরকারি বিভিন্ন সহায়তা পাচ্ছেন। ইতিমধ্যে ২৯টি পরিবার মাথা গোঁজার ঠাঁই পেয়েছে। চরমোন্তাজ ইউপি চেয়ারম্যন একে সামসুদ্দিন বলেন, ‘মান্তা সম্প্রদায়ের জীবনমান উন্নয়নে আমরা অনেকেই কাজ করে আসছি। আর এখনো সেই কাজ অব্যাহত রয়েছে।’
উপজেলা পরিষদ চেয়ারম্যান ডা. জহির উদ্দিন আহমেদ বলেন, ‘মান্তা সম্প্রদায়ের লোকজন সরকারি সুযোগ-সুবিধার আওতায় এসেছে। ইতিমধ্যে মুজিববর্ষের ঘরসহ স্থায়ী ঠিকানা পেয়েছে ২৯ জন। ৩০টি ঘরের কাজ চলমান এবং মান্তা শিশুদের শিক্ষার আওতায় আনতে স্কুলনির্মাণেরও পরিকল্পনা রয়েছে।’
আরো পড়ুন : এবার হিরো আলমকে অভিনন্দন জানালেন তথ্যমন্ত্রী