১০ পয়েন্টে সক্রিয় পাচারকারী সিন্ডিকেট ♦ সুবিধা নিচ্ছেন আইন প্রয়োগকারী সংস্থার দুর্নীতিগ্রস্ত সদস্যরা ♦ সীমান্তবর্তী ৮ কিমি এলাকায় অভিযান নিয়ে জটিলতা কাটছে না
পাচারের রুট চিহ্নিত। সবাই সবকিছু জানে তবু কোনোভাবেই থামছে না ভয়ংকর মানব পাচার। সীমান্তবর্তী চার জেলার ১০ পয়েন্ট দিয়েই দীর্ঘদিন ধরে চলছে পাচারের মতো জঘন্যতম কর্মকান্ড। অপেক্ষাকৃত নিরাপদ হওয়ায় নারী-শিশু পাচারের জন্য এসব পয়েন্টই বেছে নিচ্ছেন পাচারকারীরা। অন্যদিকে সীমান্ত এলাকায় অভিযান নিয়ে মাঝেমধ্যেই বিবাদে জড়ায় আইন প্রয়োগকারী সংস্থাগুলো। আর সে সুযোগ নিচ্ছেন পাচারকারীরা। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্য ছাড়াও ক্ষমতাসীন দলের কিছু নেতা ও জনপ্রতিনিধি পাচারকারীদের সঙ্গে জড়িত। পুলিশ সদর দফতরের বরাত দিয়ে বেসরকারি সংস্থা ব্র্যাকের অভিবাসন কর্মসূচি জানায়, ২০০৮ থেকে ২০২১ সালের মার্চ পর্যন্ত পাচারের ঘটনায় দেশে ও দেশের বাইরে ৬ হাজার ৭৩৫টি মামলা হয়েছে। মামলাগুলোয় ভুক্তভোগীর সংখ্যা উল্লেখ করা হয়েছে ১২ হাজার ৩২৪। গত ১২ বছরে ভারতে পাচার হওয়া ২ হাজার ৫০ জনকে যথাযথ আইনি প্রক্রিয়ার মাধ্যমে দেশে ফিরিয়ে আনা হয়েছে। তবে কয়েকদিন ধরে পুলিশ সদর দফতরে মানব পাচার মামলার পরিসংখ্যান চাওয়া হয়। বৃহস্পতিবার পর্যন্ত তা পাওয়া যায়নি। জানা গেছে, সীমান্তবর্তী জেলা যশোরের বেনাপোল, পুতখালী, সাদিপুর, শিকারপুর, ভীবা, সাতক্ষীরার কৈজারী-বৈকারী, ভোমরা, কলারোয়ার কাকডাঙ্গা, ঝিনাইদহের মহেশপুর-যাদবপুর দিয়ে দীর্ঘদিন ধরে নারী-শিশু পাচার করে আসছেন পাচারকারীরা। তারা যশোর ও সাতক্ষীরার সীমান্তবর্তী এলাকায় বেশি তৎপর। তবে সারা দেশে তাদের ৫ শতাধিক সদস্য সক্রিয় রয়েছেন।
ঝিনাইদহের মহেশপুর উপজেলায় অবৈধভাবে সীমান্ত পার হতে সহায়তা করে একটি চক্র। স্থানীয়ভাবে তাদের ‘ধুর’ বলা হয়। এ চক্রের সদস্য কমপক্ষে ৩০ জন। পাচারকারীরা মাতিলা গ্রামকে মানব পাচারের কেন্দ্রে পরিণত করেছেন। তারা রাজকোল, পুলিয়া, রাউংঘাট ও ভোভোদাশপুরের মতো সীমান্ত ব্যবহার করে মানব পাচার করছেন।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, সম্প্রতি সাতক্ষীরার কলারোয়া শুনাই নদীর তীর থেকে নারী পাচারের সময় হাতেনাতে গ্রেফতার হওয়া কবীর হোসেন আদ্যোপান্ত বর্ণনা করেছেন। রিমান্ড শুনানিতে আদালতেও বিষয়টি উপস্থাপন করেছেন তিনি। তবে তাকে গ্রেফতারে অংশ নেওয়া ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের এক সদস্য বলছিলেন, কাকডাঙ্গা সীমান্তে অভিযানের সময় বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ (বিজিবি) সদস্যরা বাধা দেন। তাদের ভাষ্য ছিল, ৮ কিমি পর্যন্ত অভিযান করতে হলে বিজিবির অনুমতি নিতে হবে। একপর্যায়ে অভিযান পরিচালনাকারী সদস্যদের ‘বিওপি’-তে দীর্ঘ সময় বসিয়ে রাখা হয়। এ সুযোগে পালিয়ে যান টার্গেট পাচারকারীরা।
স্থানীয় পাচারকারীদের কাছ থেকে পাওয়া তথ্য ও তদন্তে জানা গেছে, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্য ছাড়াও ক্ষমতাসীন দলের কিছু নেতা ও জনপ্রতিনিধি পাচারকারীদের সঙ্গে জড়িত। পুলিশের অভিযানে বাধা দেওয়ার বিষয়ে জানতে চাইলে বিজিবি-৩৩ ব্যাটালিয়নের অধিনায়ক লে. কর্নেল আশরাফুল হক বলেন, ‘সীমান্ত থেকে ৮ কিলোমিটার পর্যন্ত অভিযান করতে হলে বিজিবিকে আগে থেকে অবহিত করতে হয়। এ অভিযানের আগে হয়তো অভিযানকারী টিম স্থানীয় থানাকে অবহিত করেছিল। তবে স্থানীয় থানা আমাদের অবহিত করেনি।’ পুলিশের সাবেক মহাপরিদর্শক এ কে এম শহীদুল হক বলেন, ‘৮ কিলোমিটার বা ৫ মাইলের সীমান্ত এলাকায় বিজিবি অভিযান পরিচালনা করতে পারে। কিন্তু পুলিশ যে কোনো প্রান্তে অভিযান পরিচালনা করতে পারে।’ পুলিশের খুলনা রেঞ্জের উপমহাপরিদর্শক (ডিআইজি) মইনুল হক বলেন, ‘সীমান্তে মানব পাচার নিয়ে মাঝেমধ্যেই সচেতনতামূলক কার্যক্রম চালায় পুলিশ। একই সঙ্গে পাচারকারীদের চিহ্নিত করে আইনের আওতায় আনার জন্য কাজ অব্যাহত রয়েছে। তবে ঘটে যাওয়া ঘটনাগুলোর তদন্ত করে সিআইডি। কারণ তারা ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম নিয়ে কাজ করে।’
পাচার নিয়ে দীর্ঘদিন ধরে কাজ করছেন বেসরকারি সংস্থা রাইটস্ যশোরের তথ্য অনুসন্ধান কর্মকর্তা তৌফিকুজ্জামান। এ বিষয়ে তিনি বলেন, ‘পাচারের শিকার ৫০ শতাংশ ভুক্তভোগীকে ফিরিয়ে আনা সম্ভব হয়। তবে বেশির ভাগই পাচারের সময় ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনী কিংবা আইন প্রয়োগকারী সংস্থার সদস্যদের কাছে আটক হয়েছিল।’
এদিকে জাতীয় মহিলা আইনজীবী সমিতির প্রোগ্রাম ম্যানেজার দীপ্তি বল বলেন, ‘দেড় মাস আগে টাঙ্গাইলের একটি ১৪ বছরের মেয়ে পাচারের শিকার হয়েছে। সে একটি দধি কারখানায় কাজ করত। ৩৪ বছরের এক ব্যক্তির প্রেমের ফাঁদে পড়ে। পরে উন্নত জীবনের স্বপ্ন দেখিয়ে সেই মেয়েটিকে পাচার করে দেওয়া হয়। তবে বাংলাদেশ সীমান্ত পার হওয়ার পরই সে ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনী বিএসএফে ধরা পড়ে। ১৮ ঘণ্টা পার হয়ে যাওয়ার পর ওই কিশোরীকে ভারতীয় পুলিশে হস্তান্তর করে বিএসএফ।’
পাচারের জন্য তিন দফায় টাকা লেনদেন : নারী-শিশু পাচারে জড়িত গ্রেফতার এবং ফিরে আসা ভুক্তভোগীদের দেওয়া তথ্যে জানা গেছে, কোনো মেয়েকে ভারতে যাওয়ার জন্য রাজি করালে পাচারকারী চক্রের সেই সদস্য পান ১৫ হাজার টাকা। পরে তাকে সীমান্তে নিয়ে যাওয়ার জন্য যারা থাকেন, তারা পান প্রতি জনের জন্য ১০ হাজার টাকা। সীমান্তে যার অধীনে রাখা হয় তিনি পান ১০ থেকে ১৫ হাজার টাকা। যে বাড়িতে মেয়েটিকে রাখা হয় তিনি পান ৩ হাজার টাকা।