মানবতার কবি, প্রেমের কবি, বিদ্রোহের কবি কাজী নজরুল ইসলাম। তিনি আমাদের জাতীয় কবি। ১৯৭২ সালের ২৪ মে কবিকে কলকাতা থেকে একটি নতুন, স্বাধীন দেশ বাংলাদেশে নিয়ে আসা হয়। ঢাকায় আনার পর তাঁকে জাতীয় কবির মর্যাদায় ভূষিত করা হয়। এ মর্যাদার পেছনে রয়েছে নজরুলের লেখায় বাঙালি জাতি গঠনের মৌলিক তাগিদ এবং শান্তি-সম্প্রীতির জন্য ঐক্য ও সাম্যের প্রতি কবির আজীবনের সাধনা।
জাতীয় কবি হিসেবে কাজী নজরুল ইসলামের ঢাকায় পদার্পণের সুবর্ণজয়ন্তী উপলক্ষে শিক্ষাবিদ ও নজরুল গবেষক মোহিত উল আলম বলেন, আজ থেকে ঠিক ৫০ বছর আগে কবি নজরুল স্বাধীন বাংলাদেশে আসেন। বঙ্গবন্ধুর বহু মৌলিক কাজের মধ্যে অন্যতম হলো কবি নজরুলকে বাংলাদেশে নিয়ে আসার সিদ্ধান্ত। তখন কবির ছিল ৭৩তম জন্মবার্ষিকী। কিন্তু ১৯৪২ সাল থেকে তিনি জাগতিক চেতনালুপ্ত ছিলেন। বাংলাদেশের জাতীয় কবি হিসেবে তাঁর সম্মান ও স্বীকৃতি পাওয়া যথার্থ। নজরুল যেমন দুঃখী মানুষের কষ্ট দেখে ফুঁসে উঠেছিলেন; বঙ্গবন্ধু তেমনি দুঃখী মানুষের মুখে হাসি ফোটাতে চেয়েছিলেন। এই একই উদ্দেশ্যে যেহেতু দু’জনের জীবন ধাবিত ছিল; এটি প্রায় একটি ঐতিহাসিক নিশ্চয়তা হয়ে পড়ে- বঙ্গবন্ধু বাংলাদেশ নামে যে রাষ্ট্রকে স্বাধীন করলেন, সেটারই জাতীয় কবি হবেন নজরুল। বঙ্গবন্ধুকে রাজনীতির কবি বলা হয়, তেমনি নজরুলকে কবিতার রাজনীতিক বলা যায়। তিনি বলেন, স্বাধীনতার ৫০ বছর পূর্ণ হওয়ার পর এবার আমরা জাতীয় কবির ঢাকায় আসার সুবর্ণজয়ন্তী উদযাপন করছি। এটি আমাদের জন্য অত্যন্ত গর্বের বিষয়।
১৯৭২ সালের ফেব্রুয়ারির প্রথম সপ্তাহে কলকাতায় যান সদ্য স্বাধীন বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ মুজিবুর রহমান। ওই সফরে তিনি কবি কাজী নজরুল ইসলামকে ঢাকায় নেওয়ার এক অবিস্মরণীয় পদক্ষেপ নিয়েছিলেন। ভারতে রাষ্ট্রীয় অতিথির মর্যাদায় শেখ মুজিব ছিলেন কলকাতার রাজভবনে, যা পশ্চিমবঙ্গের রাজ্যপালের বাসভবন। তৎকালীন রাজ্যপাল এ এল ডায়াসকে তিনি প্রথমে এ কথাটা জানান।
পশ্চিমবঙ্গের নজরুল গবেষক ও প্রাবন্ধিক বাঁধন সেনগুপ্ত ওই ঘটনার বর্ণনা দিয়ে বলেন, ‘শেখ মুজিব রাজ্যপালকে বললেন, দেখুন- আপনাদের কাছে আমার একটা অনুরোধ আছে। এই শহরেই থাকেন কাজী নজরুল ইসলাম। তিনি যেমন আপনাদের কবি, তেমনি আমাদেরও কবি। আমাদের ভাষা এক, সংস্কৃতিও এক। কবি নিজেও আগে বহুবার ঢাকায় এসেছেন। এবার আমরা চাই কবিকে ঢাকায় নিয়ে গিয়ে ধুমধাম করে তাঁর জন্মদিন পালন করতে।’
‘এ এল ডায়াস সব শুনেটুনে বললেন, অতি উত্তম প্রস্তাব। এমন তো হতেই পারে- আমরা না হয় পালা করে কবির জন্মদিন পালন করলাম; একবার ঢাকায় আর পরেরবার কলকাতায়! তবে দিল্লিই পারবে এই অনুমতি দিতে। ফলে আপনি বরং সরাসরি মিসেস গান্ধীর সঙ্গেই কথা বলুন। পরদিনই মুজিব ঠিক সেটাই করলেন।’
শুধু প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর সঙ্গে কথা বলাই নয়; এরই মধ্যে রাজভবনে কাজী নজরুল ইসলামের পরিবারের সদস্যদের সঙ্গেও দেখা করলেন শেখ মুজিব। কবির দুই পুত্র কাজী সব্যসাচী ও কাজী অনিরুদ্ধকেও তিনি জানিয়ে রাখলেন- বাংলাদেশ সসম্মানে নজরুলকে নিয়ে গিয়ে সংবর্ধনা দিতে চায়।
এর পরই শুরু হয় এক নজিরবিহীন কূটনৈতিক তৎপরতা। তিন দশক ধরে বোধশক্তিহীন, নির্বাক এক কবিকে ঢাকায় পাঠানো নিয়ে চলতে থাকে কূটনৈতিক চিঠি চালাচালি, শলা-পরামর্শ। ফেব্রুয়ারি থেকে মে মাস পর্যন্ত নজরুলকে বাংলাদেশে পাঠানো নিয়ে দুই দেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী আবদুস সামাদ আজাদ ও শরণ সিংয়ের মধ্যেও বেশ কয়েক দফা পত্রবিনিময় হয়।
প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী আবার মতামত চাইলেন পশ্চিমবঙ্গের তখনকার মুখ্যমন্ত্রী ও তাঁর অত্যন্ত আস্থাভাজন কংগ্রেস নেতা সিদ্ধার্থশঙ্কর রায়ের। কবি নিজে সিদ্ধান্ত নেওয়ার অবস্থায় নেই। ফলে দূত পাঠিয়ে প্রধানমন্ত্রী কথা বললেন কবির পরিবারের সদস্যদের সঙ্গেও। বাংলাদেশে ভারতের সাবেক রাষ্ট্রদূত বীণা সিক্রি এ প্রসঙ্গে সম্প্রতি বিবিসিকে বলেন, ‘শেষ পর্যন্ত মৈত্রী আর বন্ধুত্বেরই জয় হলো। দুটো দেশের মধ্যে যে পারস্পরিক প্রীতি ও শ্রদ্ধার সম্পর্ক, সেটার ভিত্তিতেই শেখ মুজিবুর রহমানের অনুরোধ ভারত মেনে নিল। তবে এটাও ঠিক- দিল্লি ভেবেছিল, কবির এই যাত্রাটা হবে সাময়িক। তিনি আবার কিছুদিন পর ফিরে আসবেন। কাজী নজরুল ইসলাম বা তাঁর পরিবারের সদস্যদের বাংলাদেশের নাগরিকত্ব দেওয়া হবে বা তাঁকে একদিন সেখানে জাতীয় কবির মর্যাদায় ভূষিত করা হবে- এগুলো কিন্তু তখন জানা ছিল না, আর ভাবাও হয়নি।’
ভারতের প্রবীণ রাজনীতিবিদ ও সাবেক কেন্দ্রীয় মন্ত্রী সৌগত রায়ের মতে, প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর সিদ্ধান্তটাই ছিল এখানে আসল ব্যাপার। তিনি বলেন, ‘ইন্দিরার সম্মতিটাই ছিল মূলকথা। তিনি চেয়েছিলেন বলেই নজরুলকে ঢাকায় পাঠানো গিয়েছিল- এর মধ্যে কোনো ভুল নেই। বাকি ফ্যাক্টরগুলো গৌণ।’
ঠিক ৫০ বছর আগে ক্রিস্টোফার রোডের ফ্ল্যাট থেকে অ্যাম্বাসাডর গাড়িতে রওনা দিয়ে কাজী নজরুল ইসলাম যখন ঢাকার বিমানে ওঠেন, কলকাতায় সেদিন কোনো উত্তাপ ছিল না। এর বিপরীতে ঢাকা ছিল আবেগে উদ্বেলিত। সদ্য স্বাধীন একটা দেশের কূতনৈতিক জয়ই বলতে হবে এটি। বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীর নিরবচ্ছিন্ন উদ্যোগ আর কূটনৈতিক তৎপরতার পর অবশেষে ১৯৭২ সালের ২৪ মে একটি বিশেষ ফ্লাইটে চড়ে কলকাতা থেকে সপরিবারে ঢাকায় এসে পৌঁছেন বাংলার জনমানসের কবি কাজী নজরুল ইসলাম। তিনি কথা বলতে পারতেন না। চিন্তাশক্তিও অচল। অথচ তাঁর বিদ্রোহ ও সাম্যের চেতনাই যেন আপ্নুত করেছিল বাংলার এপাড়ের জনমানুষকে।
১৯৭৬ সালে নজরুলের স্বাস্থ্যের অবনতি হতে শুরু করে। জীবনের শেষ দিনগুলো কাটে ঢাকার পিজি হাসপাতালে। ১৯৭৬ সালের ২৯ আগস্ট তাঁর মৃত্যু হয়। নজরুল তাঁর একটি গানে লিখেছেন- ‘মসজিদেরই পাশে আমায় কবর দিও ভাই/ যেন গোরের থেকে মুয়াজ্জিনের আজান শুনতে পাই।’ কবির এই ইচ্ছার বিষয়টি বিবেচনা করে কবিকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় মসজিদের পাশে সমাধিস্থ করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয় এবং সে অনুযায়ী তাঁর সমাধি রচিত হয়।
আরো পড়ুন : স্পিনারদের স্বর্গরাজ্য মিরপুরে যা অভাবিত