ফরিদপুর মুসলিম মিশনের শত শত এতিম শিশুর অভিভাবকের নিজেরই ছিল না থাকার জায়গা

ওকে নিউজ স্পেশাল জনপ্রতিনিধি ধর্ম প্রচ্ছদ শিক্ষা সফলতার গল্প হ্যালোআড্ডা

সাদিয়া মাহ্‌জাবীন ইমাম
ফরিদপুর থেকে ফিরে: সবুজ রঙের পাঞ্জাবি গায়ে হেলেদুলে হেঁটে যাচ্ছিল এক শিশু। অপরিচিত মানুষ দেখেই দৌড় দিল। গতিরোধ করে কারণ জিজ্ঞেস করলে মুখে হাসি ছড়িয়ে জানাল, ‘একসঙ্গে দুইটা কলা খাইতেছি, তাই একটু শরম লাগছে।’ ছোট মানুষ, তাই এখনো মাপা খাবারের হিসাবটা ও করতে শেখেনি। সাত বছরের ইয়াছিনের বাড়ি ফরিদপুরের শোভারামপুরে। পাশেই রঘুনন্দনপুরে অবস্থিত ফরিদপুর মুসলিম মিশনের একজন ছোট্ট নিবাসী ও।

ফরিদপুর মুসলিম মিশনের বয়স এখন ৪০ বছর। মূলত এটি এতিমখানা। এখানে রয়েছে স্কুল, মক্তব, কলেজ, কারিগরি প্রশিক্ষণ কেন্দ্র, মসজিদ, গেস্টহাউস, খেলার মাঠ আর শিক্ষার্থীদের নিবাস নিয়ে বিশাল এক কম্পাউন্ড। এখানে এতিম ও দুস্থ শিশুর সংখ্যা ছয় শর বেশি। এর মধ্যে মেয়েদের সংখ্যা প্রায় আড়াই শ। কারও মা-বাবা দুজনই নেই। কারও হয়তো একজন আছে কিন্তু এক বেলার খাবার জোগাড়ও কঠিন।

তবে প্রতিষ্ঠানের সুনামে ফরিদপুরের আশপাশের জেলা থেকে এখানকার শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে পড়তে আসে শিক্ষার্থীরা। তারাও এখানকার আবাসিক। বর্তমানে এমন শিক্ষার্থীর সংখ্যা ৯০ জন। গত ২৮ নভেম্বর বিকেলে সেখানে ঢুকে দেখা গেল ইয়াছিনের মতো শিশুরা ছোটাছুটি করছে মাঠে। তখন ওদের খেলার সময়। তবে মেয়েরা অনুপস্থিত। তাদের খুঁজতে কম্পাউন্ডের বাঁ দিকে এগোতেই মুখোমুখি হতে হলো লাঠি হাতে দাঁড়ানো হারুন আলীর সঙ্গে। কৃষ্ণনগরের বাসিন্দা হারুন আলী ১৬ বছর ধরে আছেন এখানে। লাঠির প্রয়োগ কখনো হয় কি না, জানতে চাইলে জিব কেটে বললেন, ‘ছোটগুলা যে কী পরিমাণ দুষ্টামি করে, নিজে দশ মিনিট পাহারা দিলেই বুঝবেন। একটা আরেকটার ঘাড়ের ওপর উইঠা যায়। ভিন্ন ভিন্ন জায়গা থেকে আসা অনেক রকম পরিবারের বাচ্চা তো! লাঠিটা হাতে থাকলে একটু ভয় পায়। কিন্তু এতিম বাচ্চাদের গায়ে হাত দিলে আল্লাহ মাফ করবে না, চাকরিও থাকবে না।’

‘কিছুই করতে পারি নাই।

শুধু সাঁঝবাতির সলতেটা এগিয়ে দেওয়ার চেষ্টাটুকু করি।

যেমন আমার জীবনে কয়েকজন মানুষ করেছেন, তাই ভেসে যাইনি।’

এম এ সামাদ, ফরিদপুর মুসলিম মিশনের সম্পাদক

হারুন আলীর কাছ থেকে বালিকা নিবাসে প্রবেশের অনুমতি চাওয়া হলো। মেয়েদের খেলার মাঠ পুকুর পাড়ে বালিকা নিবাসের ভেতর দিকে। সেখানে এক পাশে কিছু শখের গাছ বড় হচ্ছে। নানা রঙের পোশাক ঝুলছে টানা টানা দড়িতে। শতাধিক মেয়ের তখন শরীরচর্চা চলছে। সত্যি সত্যি অন্যদের কাঁধ বেয়ে বেয়ে ওপর দিকে উঠে যাচ্ছে ১০ বছরের নাজমা। ওদেরই একজন জানাল, এখন মানুষ দিয়ে স্মৃতিসৌধ বানানো হচ্ছে। পদ্মার ঢেউ, শাপলা ফুল এসব আকৃতি বানানো আগেই শিখেছে। এ বছর ২৬ মার্চ বিজয় দিবসে ফরিদপুর স্টেডিয়ামে অনুষ্ঠিত কুচকাওয়াজ প্রতিযোগিতায় এই জেলার ৭০টি প্রতিষ্ঠানের মধ্যে প্রথম হয়েছে ফরিদপুর মুসলিম মিশনের মেয়ে দল। যাদের অধিকাংশই এতিম শিশু, কিশোরী। গোটা বাংলাদেশের কাছে ওরা পরিচিত করিয়ে দিচ্ছে তাদের আশ্রয় পাওয়ার প্রতিষ্ঠানটিকে। এ বছরের গ্রীষ্মকালীন জাতীয় স্কুল প্রতিযোগিতায় বাটারফ্লাই সাঁতার পর্বে জেলায় প্রথম এবং ঢাকা বিভাগের মধ্যে দ্বিতীয় হয়েছে এখানকার সপ্তম শ্রেণির ছাত্র মো. মাহফুজ ভূঁইয়া। এ বছর জাতীয় হকি অনূর্ধ্ব ১৭-তে খেলছে ফরিদপুর মুসলিম মিশনের ৮ ছাত্র। কাবাডিতে জেলা চ্যাম্পিয়ন এই প্রতিষ্ঠান। কথা হলো তাদের শরীরচর্চার শিক্ষক মো. জিন্নাহর সঙ্গে। তিনি গর্বের সঙ্গে বললেন, ‘লৌহ গোলক ও বর্ষা নিক্ষেপ প্রতিযোগিতায় জাতীয় পর্যায় থেকে প্রথম স্থান অর্জন করেছিল আমাদের ছাত্র নজরুল ইসলাম। লক্ষ্য এখন জাতীয় পর্যায়ের বিভিন্ন ইভেন্টে ছাত্রদের অংশগ্রহণ করানো।’

মাত্র ৩৩ হাজার টাকা নিয়ে ১৯৮৪ সালে যাত্রা শুরু করা ফরিদপুর মুসলিম মিশনের বর্তমান বার্ষিক বাজেট প্রায় সোয়া চার কোটি টাকা। দাতব্য এই প্রতিষ্ঠানকে সমাজসেবা অধিদপ্তর থেকে প্রতি অর্থবছর সাড়ে সাত লাখ টাকার মতো অনুদান দেওয়া হয়। বিশাল এই আয়োজনের যাত্রায় আছেন এ শহরের অনেক গুণী ও সফল মানুষ। তবে মূল কান্ডারিটা যাঁর হাতে, তিনি প্রতিষ্ঠানের সম্পাদক অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপক এম এ সামাদ। প্রতিষ্ঠাকাল থেকে তিনি সম্পাদক হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। অশীতিপর মানুষটির দিনে অন্তত ১৪ ঘণ্টা কাজ না করলে মনে হয়, বাকি রয়ে গেল অনেক কাজ। এত অনুপ্রেরণার উৎস জানতে চাইলে সামান্য হেসে একটি বাক্য বললেন ‘জীবন’।

বর্ষীয়ান হয়েও তরুণের মতো কর্মঠ মানুষটির নিজের জীবন তাকে জানিয়েছে, কিছু করা মানে অন্যের মুখে আনন্দ দেখা। তবে তাঁর ভাষায়, ‘কিছুই করতে পারি নাই। শুধু সাঁঝবাতির সলতেটা এগিয়ে দেওয়ার চেষ্টাটুকু করি। যেমন আমার জীবনে কয়েকজন মানুষ করেছেন, তাই ভেসে যাইনি।’

গত ছয় দশকে ফরিদপুর শহরে তৈরি হওয়া সেবামূলক প্রতিটি প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে রয়েছে অর্থনীতির সাবেক এই অধ্যাপক এম এ সামাদের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা। সমাজসেবায় বিশেষ অবদানের জন্য ১৯৯৬ সালে পেয়েছেন জাতীয় স্বর্ণপদক।

ফরিদপুর জেলায় তিন প্রজন্মের সবার কাছে তিনি ‘স্যার’। তবে নিজের জীবনের শুরুর গল্পটা আরেক রকম। তাঁর অভাবী বাবার একার আয়ে বছরের পর বছর ধরে এক বেলা খাবার খেয়ে টিকে থাকার সংগ্রাম সেটা। স্কুল থেকে ফিরে ভীষণ খিদে পেয়ে যেত ছোট্ট সামাদের। তাঁর মা নিজের বরাদ্দের সকালবেলার পান্তা ভাত একমুঠো রেখে দিতে চেষ্টা করতেন সন্তানের জন্য। কোনো কোনো দিন তা-ও থাকত না। পেট ভরে পানি খেয়ে পড়তে বসতেন। মনে আশা থাকত রাতে ভাত জুটবে। কোনো দিন তাদের বাড়িতে দুপুরে গরম ভাতা রান্না হয়নি। ওই বয়সে কবে তিন বেলা ভাত খেয়েছেন তিনি মনে করতে পারেন না। কিন্তু একটা ব্যাপার বুঝেছিলেন, একমাত্র পড়ালেখা করলেই সম্ভব এই অবস্থার পরিবর্তন। আর একা কখনো ভালো থাকতে পারে না মানুষ।

গ্রামের স্কুলে অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত পড়ে সামাদ চলে এলেন ফরিদপুর শহরে। থাকা, খাওয়া কোনো কিছুর জায়গা নেই। ছাত্র পড়িয়ে, শিক্ষকদের সহযোগিতা নিয়ে শুরু হলো নিজের জীবন জয়ের যাত্রা। জীবনের প্রথম আয়ের ১০০ টাকা থেকে ৮০ টাকা দিয়ে নিজের উদ্যোগে প্রকাশ করেছিলেন সুফি মোতাহার হোসেনের লেখা সনেটের বই। প্রকাশের পাঁচ-ছয় মাস পরে ১৯৬৫ সালে বইটির লেখক পেয়েছিলেন আদমজী সাহিত্য পুরস্কার। তখন সামাদ ফরিদপুর রাজেন্দ্র কলেজের শিক্ষার্থী। সুফি মোতাহার হোসেন ছিলেন তাঁর স্কুলজীবনের শিক্ষক।

ফরিদপুর সাহিত্য পরিষদ, ড. জাহেদ মেমোরিয়াল শিশু হাসপাতাল, ফরিদপুর ডায়াবেটিক সমিতি, ফরিদপুর হার্ট ফাউন্ডেশন, ফরিদপুর মিউজিয়ামের মতো অনেক প্রতিষ্ঠান তৈরির অন্যতম উদ্যোক্তা এম এ সামাদ। ফরিদপুর মুসলিম মিশনের প্রতিষ্ঠাকাল থেকে সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করে বর্ষীয়ান মানুষটি বিনা পারিশ্রমিকে ৫ বছর পড়িয়েছেন প্রতিষ্ঠানের এতিম শিশুদের। মুসলিম মিশন এতিমখানার সাফল্যের গল্প পাওয়া যায় মিশন কলেজের ছাত্রদের কাছ থেকে। এখানে বাংলা ও মাদ্রাসা দুই বিভাগেই এইচএসসি পর্যন্ত পড়ালেখার ব্যবস্থা আছে।

ফরিদপুরের আশপাশের জেলা রাজবাড়ী, কুষ্টিয়া, মাগুরা, গোপালগঞ্জ, মাদারীপুর, শরীয়তপুর থেকে শিক্ষার্থীরা আবাসিক ছাত্র হিসেবে এখানে পড়তে আসে বলে জানালেন মুসলিম মিশনের অধ্যক্ষ আবদুল্লাহ আল মামুন। তবে সে ক্ষেত্রে মাসোহারা দিতে হয়। ৪০তম বিসিএসে শিক্ষা ক্যাডারে (হিসাববিজ্ঞান) দ্বিতীয় স্থান অর্জনকারী রাজবাড়ীর মতিয়ার রহমান এইচএসসি পাস করেছিলেন মুসলিম মিশন কলেজ থেকে। সম্প্রতি দুর্নীতি দমন কমিশন দুদকের সহকারী পরিচালক হিসেবে নিয়োগ পেয়েছেন এই কলেজের প্রাক্তন শিক্ষার্থী মাগুরার হাবিবুর রহমান। এখান থেকে এসএসসি পাস করে যাওয়া পাবনার তমিউজউদ্দিন ব্যবসা প্রশাসনে স্নাতক ডিগ্রি নিয়েছেন সাইপ্রাস থেকে। এখানকার ছাত্র মিজানুর রহমান এখন লন্ডনের আলটার ইউনিভার্সিটিতে ডেটা অ্যানালাইটিকস নিয়ে এমএস করছেন। মুঠোফোন কথা হলো তাঁদের সঙ্গে। পুরোনো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের প্রসঙ্গ আসতেই আবেগাপ্লুত হলেন সবাই। ফরিদপুর মুসলিম মিশনের প্রাক্তন ছাত্ররা প্রথম আলোকে বললেন, তাঁদের জীবনের লক্ষ্য নির্ধারণ করে দিয়েছে এ প্রতিষ্ঠান। এত সংখ্যক এতিম শিশুর সঙ্গে একসঙ্গে থাকা, খাওয়া ও পড়ালেখার ফলে যে মানবিক দৃষ্টিভঙ্গি তৈরি হয়, তা অন্য শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে পাওয়া সম্ভব না।

পোলট্রি খামার, মাছ চাষ, ছাদ কৃষি, কাঠের কাজ, পোশাক তৈরির মতো কিছু খাত থেকে আসে প্রতিষ্ঠানের কয়েক লাখ টাকা। বাকি টাকাটা মানুষের সহযোগিতার অর্থ। সে অর্থ জোগাড় খুব কষ্টসাধ্য। প্রতিবছর বাড়ছে প্রতিষ্ঠানে এতিম ও দুস্থ শিশুর সংখ্যা।

তবে পড়ালেখার বা খাবারের মানের সঙ্গে কখনো আপস করতে চান না​ দায়িত্বরত ব্যক্তিরা। এতিমখানার অভ্যন্তরীণ তত্ত্বাবধায়ক মো. ওমর ফারুক প্রথম আলোকে বললেন, সপ্তাহের ২১ বেলার খাবারের মধ্যে ২ বার মুরগির মাংস, ২ বার মাছ, ৫ বার ডিম খেতে দেওয়া হয় ভাতের সঙ্গে। অন্য বেলাগুলোতে ভর্তা, সবজি, ডাল দিয়ে চলে। ভাত, ডাল যার যা লাগে তাই নিতে পারে। একই ব্যবস্থা অর্থ দিয়ে থাকা ছাত্রদের জন্যও।

মাত্র ২৫ জন এতিম শিশু নিয়ে শুরু হয়েছিল মুসলিম মিশন। চার দশকে এটি পরিণত হয়েছে বিশাল এক প্রতিষ্ঠানে। এম এ সামাদ প্রতিদিন বিকেলে ফরিদপুর শহর থেকে চলে আসেন ৫ কিলোমিটার দূরে শহরের বাইরে রঘুনন্দনপুরে অবস্থিত মুসলিম মিশনে। বিকেল-সন্ধ্যা কাটিয়ে এশার নামাজের পর আবার বসেন শহরে অবস্থিত মুসলিম মিশনের প্রশাসনিক কার্যালয়ে।

২৮ নভেম্বর বিকেলে দেখা গেল মুসলিম মিশনের খেলার মাঠে স্পর্শ করেছে বিশ্বকাপের উন্মাদনা। ছাত্ররা ব্রাজিল আর আর্জেন্টিনার জার্সি গায়ে ফুটবল খেলছে। দূর থেকে সেই দৃশ্য দেখছেন এম এ সামাদ। একপর্যায়ে হয়তো নিজের মনটাও আর্দ্র হয়ে উঠল। নিজের গল্পটা তো এই ছাত্রদের চেয়েও বেশি করুণ ছিল! তখন এমন কোনো এতিমখানাও এ শহরে ছিল না যে অন্তত দুস্থ হিসেবে ঠাঁই পাবেন। তিনি শখ করে সেদিন নামলেন মাঠে, ছাত্রদের সঙ্গে ফুটবল খেললেন। ম্যাচ শেষে ছাত্ররা ফিসফিস করে বলছিল, জীবনের সবচেয়ে কঠিন ম্যাচ ছিল এটা। এর চেয়ে নাকি ফুটবল তারকা মেসির সঙ্গে খেলা সহজ ছিল। লাথি দিয়ে স্যারের পায়ে বল পাঠানো যায়, এ কথা তারা কখনো ভাবতেও পারে না।

ফরিদপুর মুসলিম মিশন কীভাবে কুঁড়ি থেকে এত বড় গাছ হলো, জানতে চাইলে তিনি বললেন, ‘স্বপ্নটা সাহস করে দেখতে হয়। এরপর স্বপ্নই পরিচালিত করে মানুষকে। কখনো হাল ছাড়িনি, এটুকুই শক্তি। এতিম শিশু সমাজের আমানত।’

সুত্র: প্রথম আলো

আরো পড়ুন : গোমস্তাপুরের যত খবর

Share The News

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *