মহামারি করোনার পর রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের প্রভাবে সৃষ্ট ডলার সংকট দেশের অর্থনীতিতে মারাত্মক নেতিবাচক প্রভাব ফেলেছে। বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ধরে রাখতে আমদানি নিয়ন্ত্রণ করছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। এতে শিল্পের কাঁচামাল আমদানি কমেছে। ডলারের বিপরীতে টাকার অবমূল্যায়নে পণ্যের দাম বাড়ায় বিক্রি নেমেছে অর্ধেকে। সব মিলিয়ে ২০২২ সাল ভালো যায়নি ব্যবসায়ীদের। উদ্যোক্তারা বলছেন, ডলার সংকট যত তীব্র হয়েছে, কাঁচামাল আমদানিতে ঋণপত্র খোলার হার তত কমেছে। ফলে শিল্পের কাঁচামাল আমদানি কমেছে। এ সংকট কাটাতে হলে প্রবাসী ও রপ্তানি আয় বাড়াতে হবে। হুন্ডি ব্যবসা ও অর্থ পাচারের বিরুদ্ধে কঠোর পদক্ষেপ নেওয়া হলে এ চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করা কঠিন নয় বলে মনে করেন ব্যবসায়ীরা। ডলার সংকটের কারণে ২০২১ সালের মাঝামাঝি থেকে আমদানির ওপর বেশ কিছু কড়াকড়ি আরোপ করে বাংলাদেশ ব্যাংক। একই সঙ্গে পর্যাপ্ত ডলার না থাকায় অনেক ব্যাংক আমদানিতে এলসি বা ঋণপত্র খুলতে পারছে না। এতে সবচেয়ে বেশি বিপদে পড়েছেন আমদানিকারকরা। কারণ খাদ্যদ্রব্য থেকে শুরু করে যন্ত্রপাতি- বেশির ভাগ পণ্যই আমদানি করা হয়। এসব শিল্পের কাঁচামাল আমদানি করতে গিয়েও এলসি জটিলতার মুখোমুখি হচ্ছেন কারখানার মালিকরা। সেই সঙ্গে জ্বালানি তেলের দাম বাড়ায় পরিবহন ও অন্যান্য খরচ বেড়েছে। বছরের শুরুর দিকে শিল্পে গ্যাসের দাম বাড়ার পর বেড়েছে কারখানায় উৎপাদন খরচ। এসব কারণে সংকটে পড়েছে দেশি অনেক উৎপাদক প্রতিষ্ঠান। ফলে একদিকে দেশি বাজারে বেড়েছে পণ্যের দাম, অন্যদিকে কাঁচামাল আমদানি নিয়ে জটিলতায় উৎপাদন অব্যাহত রাখাও কঠিন হয়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্যানুযায়ী, চলতি ২০২৩-২৪ অর্থবছরে এখন পর্যন্ত আমদানির ঋণপত্র খোলা কমেছে ১৮ শতাংশ। আর ঋণপত্র নিষ্পত্তি কমেছে ২২ শতাংশ। জুলাই-আগস্ট সময়ে ১ হাজার ৫২ কোটি ডলারের ঋণপত্র খোলা হয়েছে। গত বছরের একই সময়ে ১ হাজার ২৮৫ কোটি ডলারের ঋণপত্র খোলা হয়েছিল। অন্যদিকে গত দুই মাসে ১ হাজার ১৭৭ কোটি ডলারের ঋণপত্র নিষ্পত্তি হয়েছে। গত বছরের একই সময়ে ১ হাজার ৫১৪ কোটি ডলারের ঋণপত্র নিষ্পত্তি হয়েছিল। যদিও ডলার সংকটের মধ্যে শিল্পের কাঁচামাল ও জ্বালানি আমদানি স্বাভাবিক রাখতে সরকার এবং বাংলাদেশ ব্যাংকের সঙ্গে একাধিক বৈঠকও করেছেন ব্যবসায়ীরা। তবে আশানুরূপ সাড়া মেলেনি। তাই ডলার সংকট সমাধান এবং মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে বাংলাদেশ ব্যাংককে আরও কার্যকর ভূমিকা পালনের আহ্বান জানিয়েছেন ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠন এফবিসিসিআই সভাপতি মাহবুবুল আলম। পাশাপাশি শিল্পকারখানায় উৎপাদনব্যবস্থা অব্যাহত রাখতে নিরবচ্ছিন্ন জ্বালানি সরবরাহ নিশ্চিত করতে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের প্রতিও আহ্বান জানান তিনি। জানা গেছে, গত বছর রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ শুরুর পর দেশে ডলার সংকট দেখা দেয়। এরপর ডলারের দাম বেড়েছে প্রায় ২৭ শতাংশ। ফলে কৃষি যন্ত্রপাতি আমদানি কমেছে, এসবের দামও বেড়ে গেছে প্রায় ৩০ শতাংশ। এর প্রভাব পড়ছে পুরো কৃষি খাতে। এদিকে দাম বেড়ে বিক্রি কমেছে গাড়ির ইঞ্জিনের যন্ত্রাংশ থেকে শুরু করে কৃষি ও নির্মাণ কাজের যন্ত্রপাতি, প্লাস্টিক পণ্যের ছাঁচ, নাট-বল্টু, বেয়ারিংয়ের। ঢাকার কেরানীগঞ্জে এসব যন্ত্রাংশ প্রস্তুতকারকরা বলেছেন, রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ লাগার পরই কাঁচামালের দাম হুহু করে বাড়তে শুরু করে, তা এখনো অব্যাহত আছে। তা ছাড়া ডলারের দাম বাড়ায় খরচ আরও বেড়েছে। কাঁচামালের দাম বাড়ানোর কারণে যন্ত্রাংশের দাম বেড়ে যাওয়ায় এখন বিক্রি কমে গেছে। গাড়ি ব্যবসায়ীরা জানিয়েছেন, গাড়ি বিক্রি কমেছে প্রায় ৪০ থেকে ৫০ শতাংশ। আমদানি কমেছে প্রায় ৩৫ শতাংশ। গাড়ির বিক্রয় কেন্দ্রগুলোয় ক্রেতার উপস্থিতি কমেছে প্রায় ৩০ শতাংশ। চাহিদা অনুযায়ী মৌসুমভিত্তিক প্রায় ৪০ ধরনের কৃষিযন্ত্র তৈরি করেন চুয়াডাঙ্গার জনতা ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের স্বত্বাধিকারী মো. ওলি উল্লাহ। তিনি বলেন, ‘আগে ১০ শতাংশ বা তার কম মার্জিনে ঋণপত্র খুলতাম। এখন শতভাগ মার্জিন দিয়েও ঋণপত্র খুলতে পারছি না। কাঁচামাল আসতে দু-তিন মাস লাগে। এ পুরো সময় ব্যাংকে টাকা ফেলে রাখতে হচ্ছে। এতে আমাদের মতো ছোট ব্যবসায়ীদের চলতি মূলধন আটকে যাচ্ছে।’ এ বিষয়ে এফবিসিসিআইয়ের সাবেক সভাপতি মো. জসিম উদ্দিন বলেন, ‘ডলারের ওপর চাপ কমাতে পণ্য আমদানির ক্ষেত্রে ব্যবসায়ীদের আরও সচেতন ভূমিকা পালন করতে হবে। অপ্রয়োজনীয় ও বিলাসী পণ্য আমদানির হার আরও কমিয়ে আনতে হবে।’ এ অর্থনৈতিক সংকট উত্তরণে পণ্য আমদানির ক্ষেত্রে কাটছাঁটের কোনো বিকল্প নেই বলেও মন্তব্য করেন তিনি।
জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) তথ্যে দেখা যায়, চলতি ২০২৩-২৪ অর্থবছরের প্রথম প্রান্তিক জুলাই-সেপ্টেম্বরে রপ্তানিমুখী তৈরি পোশাক, বস্ত্র, সিমেন্ট, প্লাস্টিক, প্রাণিখাদ্য, জাহাজ নির্মাণ, সমুদ্রগামী জাহাজ, ওষুধ, রাসায়নিক কাঁচামাল আমদানি ৩ থেকে ৫৭ শতাংশ পর্যন্ত কমেছে। উদ্যোক্তারা বলছেন, বিদেশি ক্রেতাদের ক্রয়াদেশ কমে যাওয়ায় রপ্তানিমুখী বিভিন্ন খাতের কাঁচামাল আমদানি কমেছে। তৈরি পোশাক প্রস্তুত ও রপ্তানিকারক মালিকদের সংগঠন বিজিএমইএ’র সহসভাপতি শহিদউল্লাহ আজিম বলেন, ‘তৈরি পোশাকের ক্রয়াদেশ কম থাকায় কাঁচামাল আমদানি কমেছে। অধিকাংশ কারখানা ৬০-৭৫ শতাংশ উৎপাদন সক্ষমতায় চলছে। দীর্ঘদিন ধরে ওভারটাইম নেই।’ চলমান সংকট মোকাবিলায় ডলারের দাম পুরোপুরি বাজারের ওপর ছেড়ে দেওয়ার পরামর্শ দিয়েছেন বিশ্বব্যাংকের ঢাকা কার্যালয়ের সাবেক মুখ্য অর্থনীতিবিদ জাহিদ হোসেন। তিনি বলেন, ‘২০০৩ সালে বাংলাদেশ বাজারভিত্তিক ডলারের দাম কার্যকর শুরু করে। এরপর বিশ্বে নানা অর্থনৈতিক সংকট হলেও দেশে ডলারের বাজারের বড় ধরনের কোনো অস্থিরতা আমরা দেখিনি। তাই ডলারের দাম বাজারের ওপর ছেড়ে দিয়ে আমরা দেখতে পারি সমস্যার সমাধানে কাজ করে কি না।’
আরো পড়ুন : ইউক্রেনের হামলায় রাশিয়ার দুই শিশুসহ ১৪ বেসামরিক নাগরিক নিহত