জেমস সাইফারের ‘পলিটিক্যাল ইকোনমি অব সিস্টেমেটিক ইউএস মিলিটারিজম’ পড়ার আগে আরও কিছু জ্ঞান থাকলে ফিলিস্তিনি সমস্যা বুঝতে সুবিধা হবে। এই জ্ঞান মার্ক্সীয় দর্শনে পাওয়া যাবে। ‘পুঁজি পুঁজির মালিককে আরও পুঁজি আহরণে তাড়িত করে’—কার্ল মার্ক্সের এই তত্ত্বের মধ্যেই নিহিত আছে মার্কিনদের ক্রমবর্ধমান অস্ত্র ব্যবসার রহস্য।
যুক্তরাষ্ট্রে ব্যক্তিমালিকানায় পুঁজির অভাবনীয় বিকাশ ঘটেছে। বিশ্বের সর্ববৃহৎ ২০টি বহুজাতিক কোম্পানির ১৬টির মালিক মার্কিনরা। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের কিছুকাল আগে থেকেই অস্ত্র তৈরি ও অস্ত্রের ব্যবসায় যুক্তরাষ্ট্র সাফল্যের স্বাক্ষর রাখে। অস্ত্র ব্যবসায় পুঁজির বিনিয়োগ অনেক বেশি লাভজনক বলেই পুঁজিপতিরা এই খাতেই বিনিয়োগ করছেন। অস্ত্র ব্যবসার এই সাফল্য মার্কিন আধিপত্যের ভিত্তি মজবুত করেছে।
জেমস সাইফার তাঁর নিবন্ধে লিখেছেন, ‘প্রথম ও দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে এবং তার পর থেকে যুক্তরাষ্ট্র দেশে দেশে যুদ্ধ উসকে দিয়ে মূলধন গঠন করে ব্যাপকভাবে লাভবান হয়েছে।’ এ কথার সত্যতা পাই যখন দেখি, ইউরোপ ও এশিয়া থেকে যুদ্ধাস্ত্রের অর্ডার পেতে শুরু করার পর থেকে ইতিহাসখ্যাত মহামন্দা কাটিয়ে উঠতে সক্ষম হয় যুক্তরাষ্ট্র। ফলে ১৯৪০ সালের জুন থেকে সামরিক খাতের ব্যয়ও বেড়ে যায় বছরে ৬০০ শতাংশ, যা ১৯৪৩-৪৪ সাল নাগাদ জিডিপির ৪২ শতাংশে দাঁড়ায়। অনেকেই আমেরিকান ইকোনমিকে মিলিটারি ইকোনমি বলে থাকেন।
১৯৩৯–৪৪ সাল নাগাদ, সামরিক খাত ১৫ মিলিয়ন শ্রমিক নিয়োগ করেছে, প্রকৃত জিডিপিতে ৫৪ শতাংশের উল্লম্ফন ঘটেছে এবং বেকারত্বের হার নেমে গিয়েছিল মাত্র ১ দশমিক ৪-এ, যা ইতিহাসে সর্বনিম্ন। ঐতিহাসিকভাবে মার্কিন অর্থনীতির এই অবস্থাকে বর্ণনা করা হয়েছে ‘গানজ অ্যান্ড বাটার’ অভিধায়। প্রযুক্তির ক্ষেত্রেও তারা অভাবনীয় উদ্ভাবনী লাভ করল। উল্লেখিত সময়ের মধ্যে অন্তত ২০টা প্রযুক্তিগত উদ্ভাবনী তারা আয়ত্ত করে। এই ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপটে মার্কিন অর্থনীতিবিদদের একটি দল তৈরি হলো, যারা মিলিটারি কেইনসিয়ানিস্ট হিসেবে পরিচিতি পেল। তাদের দেওয়া ব্যবস্থাপত্র অনুযায়ী, বিরাট মিলিটারি বাজেট ব্যাপকভাবে মূলধন ও কর্মসংস্থান সৃষ্টি করল এবং প্রযুক্তিগত উদ্ভাবনে অভাবনীয় উল্লম্ফন ঘটাল।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ–পরবর্তী সময়ে মার্কিন অর্থনীতিতে আবার স্থবিরতা দেখা দেয়। এ ক্ষেত্রে সোভিয়েত ইউনিয়ন থেকে সামরিক হুমকি মার্কিন অর্থনীতির জন্য আশীর্বাদ হয়ে দেখা দেয়। তখন বিবেচনামূলক রাজস্বনীতির আলোকে, নাকি ‘সামাজিক কেইনসিয়ানিজমের’ নীতির আলোকে স্থবিরতা দূর করার চেষ্টা করা হবে—এ দুইয়ের বিতর্কের সমাধান হয় ১৯৫০ সালে প্রণীত এন এইচ সি-৬৮ শীর্ষক গোপন জাতীয় নিরাপত্তা পরিকল্পনা বাস্তবায়নের মাধ্যমে, যা উল্লেখিত ‘গানজ অ্যান্ড বাটার’ অ্যাপ্রোচ তথা কর্মপন্থা।
আমেরিকার কাউন্সিল অব ইকোনমিক অ্যাডভাইজারজ-এর চেয়ারম্যান লিওন কেইসারলিং ‘সামাজিক কেইনসিয়ানিজমের’ নীতিবাদ দিয়ে ব্যাপক সামরিক ব্যয় বাড়ানোর প্রস্তাব করলেন। প্রস্তাব বাস্তবায়নের সঙ্গে সঙ্গে পেন্টাগনের অস্ত্র বিক্রির চুক্তি ১৯৫০ সালের ১৪ দশমিক ৮ বিলিয়ন মার্কিন ডলার থেকে বেড়ে ১৯৫১ সালে ৫১ দশমিক ১ বিলিয়ন মার্কিন ডলার হয়, যা জিডিপির ১৫ দশমিক ১ শতাংশ। জিডিপির এই বিশাল উল্লম্ফন ঘটেছে পেন্টাগনের অস্ত্র বিক্রির কারণে।
পুঁজিপতিরা এভাবে বিপুল সম্পদের মালিক হলেন। এই বিপুল সম্পদের মালিক হওয়ার পেছনে আরেকটি হাতিয়ার হলো শ্রমশোষণ। একটি উদাহরণ দিই। ১৯৭৯ থেকে ২০১৯ কালপর্বে শ্রমিকদের উৎপাদনক্ষমতা বেড়েছে বার্ষিক ১ দশমিক ৩৩ শতাংশ হারে, কিন্তু শ্রমিকের মজুরি বেড়েছে মাত্র শূন্য দশমিক ৩৪ শতাংশ। এ জন্যই যুক্তরাষ্ট্র একই সঙ্গে সবচেয়ে ধনীর দেশ ও সবচেয়ে গরিব মানুষের দেশ।
১৯৮০-এর প্রথমার্ধ পর্যন্ত মার্কিনরা রাষ্ট্রীয় তহবিলে চালিত ‘ব্লু-স্কাই’খ্যাত মিলিটারি রিসার্চ ও ডেভেলপমেন্টের ব্যাপক উন্নতি ঘটায়। আমূল পরিবর্তন হয় উৎপাদন কাঠামোতে। সমরাস্ত্র তৈরি প্রাধান্য পায় এবং রাষ্ট্রের উদ্যোগে ও রাষ্ট্রের তহবিলে চালিত সামরিক খাতই মার্কিন অর্থনীতিতে প্রবৃদ্ধির ভিত্তি হয়ে ওঠে। সামরিক ব্যয় অন্যান্য খাতে বিনিয়োগের তুলনায় অনুপাতের চেয়ে বেশি হারে লাভ হয় এবং অন্য যেকোনো বিনিয়োগের চেয়ে সমরাস্ত্রে বিনিয়োগ জিডিপির ওপর বেশি প্রভাব ফেলে—এটাই হলো তথাকথিত ‘মিলিটারি কেইনসিয়ানিজম’ তত্ত্বের ভিত্তি। ফলে মার্কিন নীতিনির্ধারকদের মধ্যে কেইনসের তত্ত্বের প্রভাব হ্রাস পায় (পূর্ণ কর্মসংস্থান এবং সংগঠিত শ্রমের সহায়কনীতি কেইনসীয় তত্ত্বে একটি দিক)। তারা কেইনসীয় তত্ত্ব পরিহার করে নয়া উদারনীতিবাদের দিকে ঝোঁকে। অর্থাৎ তারা আরও বেশি ধনতান্ত্রিক ও বাজারনির্ভর নীতি গ্রহণ করে।
তবু রিগান আমলে কেইনসীয় তত্ত্ব পরিহারের মধ্যেও যুক্তরাষ্ট্র মিলিটারি কেইনসিয়ানিজম অব্যাহত রেখেছিল। ২০০১ সালের প্রথম দিকে ‘ডটকম বুদ্বুদ’ একটি মন্দা শুরু করার পর, ১১ সেপ্টেম্বর মিলিটারি কেইনসিয়ানিজমের আরেকটি পর্বের দরজা খুলে দেয়।
প্রথম বিশ্বযুদ্ধের কাল থেকে যুক্তরাষ্ট্রের পুঁজির ব্যক্তিগত মালিকেরা ও রাষ্ট্র সমরাস্ত্রে তাঁদের বিনিয়োগ থেকে যেভাবে লাভবান হয়েছেন, যেভাবে আরও পুঁজির মালিক হয়েছেন, তা তাঁরা ভুলতে পারেন না। এভাবে জাতিগতভাবেই একটি লোভী জনগোষ্ঠীতে পরিণত হয় মার্কিনরা। পুঁজিপতির আরও পুঁজি আহরণের এই আকাঙ্ক্ষার কথাই উল্লেখিত মার্ক্সীয় তত্ত্বে বিবৃত। মার্কিনরা কেন যুদ্ধ বাধায় ও জিইয়ে রাখে, এই তত্ত্ব বিশ্ববাসীকে এটা বুঝতে সাহায্য করে।
একদিকে রাশিয়া ও চীন আর অন্যদিকে যুক্তরাষ্ট্র—এই দুই প্রতিদ্বন্দ্বীর কথা হিসেবে নিই এবং পার্থক্যটা বোঝার চেষ্টা করি। প্রথম দুই দেশে সামরিক খাত রাষ্ট্রায়ত্ত বা বড়জোর ব্যক্তি-রাষ্ট্রের যৌথ প্রকল্প এবং সম্পূর্ণ রাষ্ট্রের নিয়ন্ত্রণে। পক্ষান্তরে, যুক্তরাষ্ট্রে সামরিক খাত মূলত ব্যক্তিমালিকানায়, যার ওপর রাষ্ট্রের কোনো নিয়ন্ত্রণ নেই। বরং ব্যক্তি খাত সরকারকে নিয়ন্ত্রণ করে। প্রমাণ, কোনো সরকারপ্রধান বা সরকার ইচ্ছা করলেও ‘গান কন্ট্রোল’ তথা মারণাস্ত্র নিয়ন্ত্রণ আইন পাস করাতে পারছে না। কারণ, শিল্পমালিকেরা সরকারের চেয়েও বেশি শক্তিশালী।
‘মানবতাবাদী’ প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা নির্বাচিত হওয়ার পর একটা দীর্ঘ ফিরিস্তি দিয়েছিলেন যে এত মিলিয়ন ডলার চাঁদা সংগ্রহ করতে পারলে তিনি নির্বাচনে জয়ী হতে পারবেন। নিজের স্বীকারোক্তি অনুযায়ী, তাঁর কাঙ্ক্ষিত পরিমাণ তহবিল জোগাড় করতে পারার কারণেই তিনি জয়ী হতে পেরেছিলেন। রাজনীতিকদের চাঁদা প্রদান একধরনের বিনিয়োগ। কারণ, এভাবে তাঁরা তাঁদের অনুকূলে আইনকানুন তৈরি করে নিতে পারেন। ঠিক এই কারণেই, বন্দুক তৈরির কারাখানার মালিকদের বিপরীতে সরকার আইন পাস করতে পারে না।
২০২২ সালের ৬ জুনের হিসাব অনুযায়ী, ৮০টি দেশে যুক্তরাষ্ট্রের ৭৫০ সামরিক ঘাঁটি এবং ১৫৯ দেশে মোট ১ লাখ ৭৩ হাজার সেনা মোতায়েন আছে। এতে যে বিপুল পরিমাণ মানববিধ্বংসী অস্ত্রের ব্যবহার হয়, তার জোগানদাতা ব্যক্তি খাতে মারণাস্ত্র প্রস্তুতকারী শিল্পমালিকেরা। এই মারণাস্ত্র প্রস্তুতকারী শিল্পমালিকেরাই পরোক্ষ বা প্রত্যক্ষভাবে মার্কিন পররাষ্ট্রনীতির প্রণেতা। সে জন্য গত ৭ অক্টোবরের পর থেকে গাজায় যে হামলা চলেছে, যেভাবে নারী ও শিশুকে হত্যা করা হচ্ছে, তা বন্ধের জন্য জাতিসংঘের নিরাপত্তা কাউন্সিলে যুদ্ধবিরতির প্রস্তাবের বিপক্ষে একমাত্র যুক্তরাষ্ট্র অবস্থান করেছে। জো বাইডেন নিজেই অস্ত্র ব্যবসার সুবিধাভোগী। এমনকি ইচ্ছা করলেও তিনি অস্ত্রশিল্পমালিকদের ইচ্ছার বিরুদ্ধে যেতে পারবেন না। কারণ, পুঁজিপতিরাই সেখানে সর্বময় ক্ষমতার অধিকারী।
মার্কিন ইতিহাসবিদ, ক্যালিফোর্নিয়া স্টেট ইউনিভার্সিটির সাবেক অধ্যাপক রোক্সান দুনবার-অর্তিজ তাঁর ‘অ্যান ইন্ডিজিনাস পিপলস হিস্ট্রি অব ইউনাইটেড স্টেটস’ বইয়ে মার্কিনদের সর্বগ্রাসী মনোভাব ব্যাখ্যা করেছেন। তিনি নিজেও আইরিশ বংশোদ্ভূত শ্বেতাঙ্গ নারী। তাঁর পূর্বপুরুষও সেটেলার তথা বসতি স্থাপনকারী, যাঁরা উড়ে এসে জুড়ে বসে রেড ইন্ডিয়ানদের জায়গাজমি কেড়ে নিয়ে বসতি গড়েছিলেন। তিনি ব্যাখ্যা করেন, মার্কিনদের এই সর্বগ্রাসী মনোভাব উপনিবেশবাদী মনোভাব থেকে উদ্গত। যাঁরা, বিশেষ করে যুক্তরাজ্য থেকে, উত্তর আমেরিকাসহ বিভিন্ন দেশে গিয়ে বসতি স্থাপন করেছেন, তাঁরা আদিবাসীদের ভূমি কেড়ে নিয়ে তাঁদের নিঃস্ব করে দিয়েছেন এবং এটা করতে গিয়ে তাঁদের ওপর সীমাহীন অত্যাচার চালিয়েছেন।
মার্কিনদের মহামন্দা কাটাতে প্রফেসর কেইন্স যে ব্যবস্থাপত্র দিয়েছিলেন, তাতে অর্থনীতিকে পুরোপুরি বাজারের ওপর ছেড়ে না দিয়ে রাষ্ট্রের হস্তক্ষেপের প্রস্তাব করা হয়েছিল। কেইন্সের ব্যবস্থাপত্রই যুক্তরাষ্ট্রকে মহামন্দা কাটিয়ে উঠতে সাহায্য করে। কিন্তু এরপর তারা কেইন্সের নীতি পরিহার করে নয়া উদারতাবাদের নীতি গ্রহণ করে, যার প্রবক্তা হায়েক, ফ্রিডম্যান, বুকানন প্রমুখ দার্শনিক বা অর্থনীতিবিদ। নয়া উদারতাবাদে দেশ আরও বেশি ধনতান্ত্রিক ও বাজারনির্ভর হলো, আর্থিক প্রতিষ্ঠান থেকে নিয়ন্ত্রণ উঠে গেল, রাষ্ট্রের চেয়ে ব্যক্তি বেশি শক্তিশালী হলো।
পুঁজিপতিরাই সরকারপ্রধান বা সরকারকে প্ররোচিত করেন যুদ্ধ বাধাতে ও জিইয়ে রাখতে, আগ্রাসন চালাতে ও আগ্রাসন চালাতে সহায়তা করতে। কারণ, তাঁরাই নিজের ও অন্য দেশের সরকারের কাছে এবং সন্ত্রাসবাদী সংগঠনের কাছে অস্ত্র বিক্রি করেন। সেই যুদ্ধ বা আগ্রাসন চালাতে গিয়ে যদি গর্ভবতী নারীকে, এমনকি শিশুকেও হত্যা করতে হয়, তাঁরা পিছ পা হবেন না। কারণ, মুনাফার লোভে তাঁরা উন্মত্ত। ৭ অক্টোবর ইসরায়েলের ওপর হামাসের হামলার প্রতিক্রিয়ার গাজায় ইসরায়েলি সেনাদের নির্বিচার আক্রমণ থেকে রক্ষা পেল না কিছুই—বসতবাড়ি, হাসপাতাল, নারী—এমনকি দুধের শিশুও। আর বিশ্ববাসী প্রত্যক্ষ করল পুঁজিবাদের নগ্ন চেহারা।
ড. এন এন তরুণ ইউনিভার্সিটি অব বাথ, ইংল্যান্ড। সাউথ এশিয়া জার্নালের এডিটর অ্যাট লার্জ। nntarun@gmail.com
সুত্র-প্রথম আলো