কামরাঙ্গীরচরে ময়না বেগমের ছোট্ট কারখানা। বঙ্গবাজারের অনেক ব্যবসায়ীর কাছে তিনি সরবরাহ করতেন পোশাক। সেই সূত্রে নিঃস্ব অনেক দোকান মালিকের কাছে লাখ লাখ টাকা পাওনা। ময়নার সেই পাওনা টাকা ফেরত চাওয়ার পথটাও বন্ধ করে দিয়ে গেছে সর্বগ্রাসী আগুন। তাই বৃহস্পতিবার দুপুরে বঙ্গবাজারের ধ্বংসস্তূপে ময়নার আর্তনাদ
একাধিক কারণ খতিয়ে দেখছে তদন্ত কমিটি
আর্থিক অনুদানের জন্য যৌথ ব্যাংক হিসাব খোলার চিন্তা
ফায়ার সার্ভিস দপ্তরে হামলায় মামলা, গ্রেপ্তার ৩
ধ্বংসস্তূপে পোড়া টিন উল্টিয়ে লোহার রড দিয়ে খুঁচিয়ে ছাই সরাচ্ছিলেন ব্যবসায়ী রুহুল আমিন। বেশ কিছুক্ষণ খোঁজাখুঁজির পর কয়েকটি আধপোড়া শাড়ি মেলে সেখানে। সেগুলো একটি বস্তায় ভরে নিয়ে যান রুহুল আমিনের কর্মচারীরা। গতকাল বৃহস্পতিবার মধ্যদুপুরে বঙ্গবাজার মার্কেটের ধ্বংসস্তূপের ওপর দাঁড়িয়ে তিনি জানান, শাড়িগুলো ভারত থেকে আমদানি করেছিলেন। তাঁর দোকান ও গুদামে দুই কোটি টাকার বেশি শাড়ি ছিল। সর্বগ্রাসী আগুনে সবই এখন ছাই। ছাই উড়িয়ে কিছু আধপোড়া শাড়ি বের করে নিয়ে যাচ্ছেন গরিব মানুষকে বিলিয়ে দেবেন বলে। রুহুল আমিনের মতো ক্ষতিগ্রস্ত অনেক ব্যবসায়ী গতকালও ধ্বংসস্তূপ সরিয়ে অগ্নিকাণ্ডের আগের রাতে দোকানে রেখে যাওয়া নগদ টাকা ও মালপত্র তালাশ করছিলেন। প্রায় সব ব্যবসায়ী দিনের বেচাকেনার টাকা রাতে দোকানেই রেখে গিয়েছিলেন। মালপত্রের পাশাপাশি টাকাও পুড়েছে।
এদিকে আগামীকাল শনিবার থেকে বঙ্গবাজার অস্থায়ীভাবে চালুর চিন্তাভাবনা চলছে। এ ঘটনায় ফায়ার সার্ভিস গঠিত তদন্ত কমিটি আগুনসূত্র সম্পর্কে এখনও নিশ্চিত করে কিছু জানায়নি। তদন্ত-সংশ্লিষ্টরা বলছেন, বৈদ্যুতিক শর্টশার্কিট, সিগারেট, নাকি অন্য কিছু থেকে আগুনের সূত্রপাত– জানতে বেগ পেতে হচ্ছে। কারণ, ঘটনাস্থলে সবকিছু পুড়ে ছাই। তদন্ত শেষ হওয়ার আগে আগুন লাগার কারণ সম্পর্কে নিশ্চিত কিছু বলা যাচ্ছে না।
ফায়ার সার্ভিসের তদন্ত কমিটিপ্রধান সংস্থাটির পরিচালক (অপারেশনস) লে. কর্নেল মোহাম্মদ তাজুল ইসলাম চৌধুরী বলেন, ঘটনাস্থলের আশপাশের সিসি ক্যামেরার ফুটেজসহ তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহ ও যাচাই-বাছাই চলছে। মার্কেটের সব দোকান পুড়ে যাওয়ায় তেমন কোনো আলামত মিলছে না।
ক্ষতিগ্রস্ত ব্যবসায়ী কারও কারও অভিযোগ, বঙ্গবাজার কমপ্লেক্সের অগ্নিকাণ্ড দুর্ঘটনা নয়; নাশকতা। দুষ্টচক্র ভোরে আগুন লাগিয়ে দিয়েছে। টুটুল শেখ নামে এক ব্যবসায়ী বলেন, এই মার্কেট নিয়ে দীর্ঘদিন ঝামেলা চলছে। মার্কেটটি দখল করতে আগুন লাগিয়ে দেওয়া হয়েছে। আরেক ব্যবসায়ীর দাবি, বাইরে থেকে কেউ আগুন লাগাল কিনা, তাও তদন্ত করে দেখা দরকার।
তবে মার্কেটের নিরাপত্তাকর্মীদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, কমপ্লেক্সের পূর্ব পাশে আদর্শ মার্কেটের ১০ ফুট গলির দোকানে আগুন লাগে। সে সময় মার্কেটে প্রবেশের সব গলির মুখের ফটক তালাবদ্ধ ছিল।
সাময়িক ব্যবসার ব্যবস্থা: বঙ্গবাজারের ব্যবসায়ীদের দ্রুত অস্থায়ীভাবে ব্যবসার ব্যবস্থা করে দেওয়া হবে বলে জানিয়েছেন প্রধানমন্ত্রীর বেসরকারি শিল্প ও বিনিয়োগবিষয়ক উপদেষ্টা সালমান এফ রহমান। গতকাল বঙ্গবাজারে ঘটনাস্থল পরিদর্শন শেষে তিনি সাংবাদিকদের বলেন, তিন-চার দিনের মধ্যে ক্ষতিগ্রস্ত ব্যবসায়ীদের তালিকা করে যথাসাধ্য সহযোগিতা করা হবে। ব্যবসায়ীদের পুনর্বাসন ও ক্ষতিপূরণ দিতে আমরা কাজ করছি। এরই মধ্যে অনেকে ক্ষতিগ্রস্ত ব্যবসায়ীদের আর্থিক সহযোগিতা করতে এগিয়ে এসেছেন। আর্থিক অনুদানের জন্য একটি যৌথ ব্যাংক হিসাব, বিকাশ, নগদ, রকেট অ্যাকাউন্ট খোলার জন্য ব্যবসায়ীদের পরামর্শ দিয়েছি। অ্যাকাউন্টগুলো খোলার পর সবাইকে জানিয়ে দেওয়া হবে। অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় প্রধানমন্ত্রী ব্যথিত। প্রধানমন্ত্রী তাঁর তহবিল থেকে সহায়তা দেওয়ার কথা জানিয়েছেন।
সালমান এফ রহমান বলেন, বঙ্গবাজার নির্মাণের জন্য আগে একটি নকশা করা হয়েছিল। তবে নির্মাণকাজ বন্ধ করতে ব্যবসায়ীদের পক্ষ থেকে হাইকোর্টে একটি রিট করা হয়। এ কারণেই নির্মাণকাজ শুরু করা যায়নি। যাঁরা রিট আবেদনটি করেছিলেন, তাঁরা এখন ভুল বুঝতে পেরে রিটের বিষয়টি সমাধানে একমত হয়েছেন।
ব্যবসায়ী কেউ কেউ বলছেন, ঈদের আগে ধ্বংসস্তূপ সরিয়ে সরকারের পক্ষ থেকে অস্থায়ীভাবে দোকান তৈরি করে দিলে তাঁরা ব্যবসা করতে পারবেন। কোনো কোনো ব্যবসায়ীর বঙ্গবাজার ছাড়াও বাইরের গুদামে কিছু মালপত্র আছে। ঈদের আগে ক’টা দিন অন্তত ওই মালপত্র বেচতে পারবেন। আবার কেউ বলছেন, দোকান তৈরি করে দিলেও তাঁদের দোকানে মাল তোলার মতো টাকা নেই। আগুনে একেবারে নিঃস্ব হয়েছেন। আর্থিক অনুদানও দাবি করেন তাঁরা।
ক্ষতিগ্রস্ত ব্যবসায়ী মো. জসিম বলেন, ‘আমার দোকানের সব মাল পুড়ে ছাই হয়ে গেছে। খাওয়ার টাকাও নেই। এখন অস্থায়ীভাবে দোকান করে দিলেও দোকানে মালপত্র তোলার সামর্থ্য নেই। কেউ ধারদেনাও দেবে না যে, মালপত্র তুলব। সরকারের পক্ষ থেকে কিছু টাকা পেলে ঈদের আগে মাল তুলতে পারতাম।’
এদিকে গতকাল ঘটনাস্থল পরিদর্শনে যান বাম গণতান্ত্রিক জোট কেন্দ্রীয় পরিচালনা পরিষদের নেতারা। এ ছাড়া আগুনের ঘটনায় গঠিত তদন্ত কমিটির সদস্যরাও ঘটনাস্থল ঘুরে দেখেন।
হামলার ঘটনায় মামলা, তিনজন রিমান্ডে : ফায়ার সার্ভিস সদরদপ্তরে হামলার ঘটনায় গতকাল পুলিশ বাদী হয়ে বংশাল থানায় মামলা করেছে। এতে অচেনা ২৫০ থেকে ৩০০ জনকে আসামি করা হয়েছে। পাশাপাশি এ ঘটনায় পুলিশ তদন্তও শুরু করেছে। এ পর্যন্ত বংশাল থানা পুলিশ তিনজনকে গ্রেপ্তার করেছে। তারা হলো রাজু, শাওন ও শাহাদাৎ। তারা পুলিশের কাছে হামলায় জড়িত থাকার কথা স্বীকার করেছে। এ ছাড়া ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা (ডিবি) পুলিশ আরও তিনজনকে আটক করেছে বলে জানা গেছে। তাদের নাম-পরিচয় জানা যায়নি। মামলার এজাহারে বলা হয়েছে, অচেনা দুষ্কৃতকারীরা ফায়ার সার্ভিসের সদরদপ্তরে হামলা, ভাঙচুরের পাশাপশি পুলিশের কাজে বাধা দিয়েছে। আগুনের ঘটনায় শাহবাগ থানায় সাধারণ ডায়েরি (জিডি) করা হয়েছে।
পুলিশের লালবাগ বিভাগের উপকমিশনার জাফর হোসেন বলেন, হামলার ঘটনায় সিসি ক্যামেরার ফুটেজ পর্যালোচনা করে বেশ কয়েকজনকে শনাক্ত করা হয়েছে। গ্রেপ্তার তিনজনকে গতকাল এক দিনের রিমান্ডে নেওয়া হয়েছে। অভিযুক্ত অন্যদেরও আইনের আওতায় আনা হবে।
গতকাল বেলা ১১টায় বঙ্গবাজার মার্কেটের ধ্বংসস্তূপে গিয়ে কোথাও কোথাও আগুনের ফুলকি দেখা যায়। অনেক স্থান থেকে বের হচ্ছিল ধোঁয়া। সেখানে ফায়ার সার্ভিসের কর্মীরা পানি দিয়ে নেভানোর চেষ্টা করেন। এনেক্সকো টাওয়ারের পঞ্চম ও ষষ্ঠতলায় গতকালও ধোঁয়া দেখা যায়।
নিরাপত্তাকর্মীরা যা বলছেন : বঙ্গবাজার, আদর্শ মার্কেট, মহানগর ও গুলিস্তান মার্কেটের সমন্বয়ে বঙ্গবাজার কমপ্লেক্স। এই কমপ্লেক্সের সব দোকান ও মালপত্র ছাই হয়েছে। চারটি মার্কেটের আলাদা নিরাপত্তাকর্মী দায়িত্ব পালন করেন দিনরাত। বেশিরভাগ প্রত্যক্ষদর্শী বলেছেন, পুলিশ সদরদপ্তরের প্রাচীরসংলগ্ন আদর্শ মার্কেটের ১০ ফুট গলি থেকে আগুনের সূত্রপাত। ঘটনার সময় আদর্শ মার্কেটে পাঁচজন নিরাপত্তাকর্মী দায়িত্বে ছিলেন। তাঁদের একজন মো. ইদ্রিস গতকাল দুপুরে জানান, ঘটনার সময় তিনি ১০ ফুট গলির মুখে দাঁড়িয়ে ছিলেন। এ সময় ভেতর থেকে বিল্লাল নামে আরেক নিরাপত্তাকর্মী দৌড়ে এসে তাঁকে জানান, ভেতর থেকে পোড়া গন্ধ বের হচ্ছে। এর পরই তিনি ফায়ার সার্ভিসের সদরদপ্তরে ছুটে যান। পোড়া গন্ধের কথা জানানোর পর তিনজন ফায়ার ফাইটার বহনযোগ্য তিনটি অগ্নিনির্বাপণ যন্ত্র নিয়ে ছুটে আসেন।
ইদ্রিস জানান, তিনি আদর্শ মার্কেটের ১ নম্বর গলির ফটকের তালা এবং পাশের সিঁড়িতে ওঠার দরজার তালা খুলে দেন। এর পর তিনজন ফায়ার ফাইটার সেগুলো নিয়ে দোতলার দিকে উঠে যান। কিছুক্ষণের মধ্যেই ফায়ার সার্ভিসের গাড়ি আসে। পানি দেওয়া শুরু করে। এরই মধ্যে আগুন দাউদাউ করে জ্বলতে থাকে এবং দ্রুত তা ছড়িয়ে পড়ে। ইদ্রিস আরও জানান, অগ্নিকাণ্ডের সময় মার্কেটে প্রবেশের সব পথ তালাবদ্ধ ছিল।
বঙ্গবাজার মার্কেটে দায়িত্ব পালন করেন নিরাপত্তাকর্মী আব্দুর রহমান। তিনি জানান, মার্কেটের একাংশে টিনের চারতলার একটি কক্ষে নিরাপত্তাকর্মীরা থাকেন। ওই কক্ষে থাকা তাঁর গচ্ছিত ১৭ হাজার টাকাসহ ১৪ নিরাপত্তাকর্মীর সবকিছু ছাই হয়েছে। কেউই পরনের কাপড় ছাড়া কিছু আনতে পারেননি। আগুনের সময় তিনি মার্কেটের সামনে ছিলেন। আগুন দেখতে পেয়ে তিনি ছুটে যান ফায়ার সার্ভিসের গেটে।
গতকাল দুপুর ১২টার পর থেকে বঙ্গবাজার মার্কেটের পোড়া স্থান পুলিশ লোহার ব্যারিকেড দিয়ে রাখে। সাধারণ মানুষকে সেখানে ঢুকতে দেওয়া হচ্ছিল না। শাহবাগ থানার ওসি নূর মোহাম্মদ বলেন, উৎসুক মানুষ অযথা ঘটনাস্থলে ভিড় করছে।
মানববন্ধন : ঢাকা রেডিমেড গার্মেন্টস ব্যবসায়ী সমবায় সমিতির নেতারা গতকাল বঙ্গবাজারে মানববন্ধন করেন। মানববন্ধনে সংগঠনটির সভাপতি আব্দুল মান্নান বলেন, বঙ্গবাজারের ব্যবসায়ীরা নিঃস্ব হয়েছেন। ক্ষতিগ্রস্ত ব্যবসায়ীদের প্রতি সুদৃষ্টি দেওয়ার জন্য সরকারের কাছে অনুরোধ করব। আর্থিক সহায়তা পেলে তাঁরা আবার ঘুরে দাঁড়াতে পারবে।
গত মঙ্গলবার ভোরে বঙ্গবাজার কমপ্লেক্সে আগুন লাগে। এতে বঙ্গবাজার মার্কেটসহ কমপ্লেক্সের চারটি মার্কেটের সব দোকান ও মালপত্র ভস্মীভূত হয়। পাশের এনেক্সকো টাওয়ার, মহানগর শপিং কমপ্লেক্স, বঙ্গ ইসলামিয়া সুপার মার্কেট ও বরিশাল প্লাজার আংশিক পুড়ে যায়। অগ্নিকাণ্ডের পরপরই ওই এলাকার মসজিদের মাইক থেকে আগুনের খবর জানানোর পাশাপাশি আগুন নেভাতে মানুষের সহায়তা চাওয়া হয়।
আরো পড়ুন : নববর্ষ উদযাপন উপলক্ষে ঢাবিতে মুখোশ পরা, ভুভুজেলা বাঁশি নিষিদ্ধ