বরিশাল সিটি করপোরেশন নির্বাচনে গাজীপুরের পুনরাবৃত্তির শঙ্কায় ভুগছে আওয়ামী লীগ। দলটির কেন্দ্রীয় নেতারা গত এক মাস ধরে কাজ করছেন এ সিটিতে ঢাকা ও বরিশাল মিলিয়ে প্রায় অর্ধ শতাধিক বৈঠক করা হয়েছে। অতীতে রাজধানীর বাইরের কোনো সিটি করপোরেশন নির্বাচনে দলের কেন্দ্রীয় কমিটির পক্ষ থেকে এত তৎপরতা চালানো হয়নি। আওয়ামী লীগ নেতারা জানান, তাদের চোখ এখন বরিশালের দিকে। বরিশালকে তারা বেশি গুরুত্ব দিচ্ছেন। ভোটের মাঠে এখন জটিল সমীকরণ। বিএনপি কোনো প্রার্থী না দিলেও দলীয় প্রার্থীর জয় নিয়ে নানা শঙ্কা রয়েছে। দলের অভ্যন্তরীণ কোন্দল কেন্দ্রীয় নেতাদের বেশি ভাবাচ্ছে। বিশেষ করে সাবেক মেয়র সেরনিয়াবাত সাদিক আব্দুল্লাহর অনুসারীদের অবস্থান কী হবে তা খুব একটা পরিষ্কার নয়।
সিটি করপোরেশন নির্বাচনে জয়-পরাজয় দলের প্রভাবের জন্য বড় ফ্যাক্টর হয়ে উঠবে বলে নেতারা মনে করছেন। সামনেই জাতীয় সংসদ নির্বাচন হওয়ায় এখানকার ভোটের হিসাব দলের জন্য গুরুত্বপূর্র্ণ।
এ কারণে দলীয় হাইকমান্ডের নির্দেশে কেন্দ্রীয় কমিটির প্রায় অর্ধ শতাধিক নেতা বরিশালে অবস্থান করে সাংগঠনিক তৎপরতা চালিয়েছেন। গতকালও সেখানে প্রায় ২০ জন কেন্দ্রীয় কমিটির নেতা বরিশালে অবস্থান করছিলেন। নির্বাচন পর্যন্ত তারা সেখানে থাকবেন। ভোটের দিন নির্বাচন কমিশনের বিধিনিষেধ মেনে নির্বাচন মনিটরিং করবেন তারা। একই তৎপরতা চালানো হয়েছিল গাজীপুর সিটি করপোরেশন নির্বাচনেও। তারা গাজীপুরের বিভিন্ন এলাকায় অবস্থান করে মনিটরিংয়ের দায়িত্ব পালন করেন। তবে তারা কোনো ভোটকেন্দ্রে সশরীরে যাননি। মোবাইল ফোনের মাধ্যমে স্থানীয় নেতাকর্মীদের সঙ্গে সার্বক্ষণিক যোগাযোগ রাখতে দেখা যায়। আওয়ামী লীগ নেতারা জানান, একই তৎপরতা চালানো হবে বরিশাল সিটি করপোরেশন নির্বাচনেও। এর আগে বরিশাল সিটি করপোরেশন (বিসিসি) নির্বাচনে আওয়ামী লীগের মনোনীত প্রার্থীর পক্ষে প্রচারণার জন্য ৯ সদস্যের একটি টিম গঠন করে কেন্দ্রীয় কমিটি।
গত ১৭ই মে সন্ধ্যায় ওই টিমের তালিকা প্রকাশ করা হয়। এতে টিম প্রধান করা হয় আওয়ামী লীগের মনোনীত প্রার্থী আবুল খায়ের আব্দুল্লাহ খোকন সেরনিয়াবাতের বড় ভাই আবুল হাসানাত আব্দুল্লাহ এমপিকে। টিমের সমন্বয়ক হিসেবে রয়েছেন কেন্দ্রীয় কমিটির যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক আ ফ ম বাহাউদ্দিন নাছিম ও সাংগঠনিক সমন্বয়ক এডভোকেট আফজাল হোসেন। সদস্য হিসেবে রয়েছেন আওয়ামী লীগের সভাপতিমন্ডলীর সদস্য এডভোকেট জাহাঙ্গীর কবির নানক, আব্দুর রহমান, কেন্দ্রীয় কমিটির আন্তর্জাতিক বিষয়ক সম্পাদক ড. শাম্মী আহমেদ, শিল্প ও বাণিজ্য বিষয়ক সম্পাদক মো. সিদ্দিকুর রহমান, সদস্য আনিসুর রহমান এবং গোলাম কবির রাব্বানী। অন্যদিকে নির্বাচনী প্রচার-প্রচারণার লক্ষ্যে পরিচালনা ও সমন্বয়ক টিম গঠন করে আওয়ামী যুবলীগ। সংগঠনের চেয়ারম্যান শেখ ফজলে শাম্স পরশের নির্দেশে এবং সাধারণ সম্পাদক মাইনুল হোসেন খান নিখিলের স্বাক্ষরে ওই টিম গঠন করা হয়। নির্বাচন পরিচালনা টিমের আহ্বায়ক করা হয় যুবলীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য আবু আহমেদ নাসিম পাভেলকে। যুগ্ম-আহ্বায়ক করা হয়েছে বরিশাল বিভাগের দায়িত্বপ্রাপ্ত ও যুবলীগের যুগ্ম-সাধারণ সম্পাদক মুহাম্মদ বদিউল আলম, প্রেসিডিয়াম সদস্য সুভাষ চন্দ্র হাওলাদার, তাজ উদ্দিন আহমেদ ও জসিম মাতুব্বরকে।
টিমের সদস্য সচিব করা হয়েছে বরিশাল বিভাগের দায়িত্বপ্রাপ্ত সাংগঠনিক সম্পাদক কাজী মো. মাজহারুল ইসলামকে। আওয়ামী লীগের নেতারা জানান, ওই দুই টিম বরিশালের নির্বাচন পর্যবেক্ষণ করবেন। পাশাপাশি নৌকা প্রতীকের জন্য কাজ করছে। তারা জানান, মূলত মেয়র সাদিক আবদুল্লাহকে দলীয় মনোনয়ন না দেয়ায় বরিশালে দলীয় কোন্দল তৈরি হয়েছে। এখন সেখানে আওয়ামী লীগের প্রতিপক্ষ আওয়ামী লীগ। পরিস্থিতি সামাল দিতে নির্বাচন পর্যন্ত সাদিক আব্দুল্লাহকে বরিশালে না যাওয়ার নির্দেশনা দেয়া হয়। বরিশালের সার্বিক পরিস্থিতি নিয়ে গতকাল কথা হয় আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক সুজিত রায় নন্দীর সঙ্গে। টিমের সদস্য না হলেও গত এক সপ্তাহ ধরে তিনি অবস্থান করছেন বরিশালে। সেখানকার দলীয় অবস্থান প্রসঙ্গে তিনি বলেন, নৌকা প্রতীকের অবস্থা খুবই ভালো। ভোটারদের ব্যাপক উপস্থিতিতে উৎসবমুখর পরিবেশে ভোট অনুষ্ঠিত হবে বলে আমাদের বিশ্বাস। আমাদের দলের নেতাকর্মীরা ঐক্যবদ্ধভাবে নৌকা প্রতীকের জন্য কাজ করছেন।
তিনি বলেন, একটি মহল বরিশালে দলীয় কোন্দলের কথা বলে মূলত গুজব ছড়াচ্ছে। এখানে সবাই নৌকার পক্ষে ঐক্যবদ্ধ রয়েছে। সংশ্লিষ্টরা জানান, বরিশাল সিটি করপোরেশন নির্বাচন অনুষ্ঠিত হচ্ছে আওয়ামী লীগের অনেক নাটকীয়তার মধ্য দিয়ে। বর্তমান মেয়র সাদিক আব্দুল্লাহকে এবার মনোনয়ন দেয়া হয়নি। মনোনয়নে আওয়ামী লীগ চমক দেখিয়েছে। সাদিক আব্দুল্লাহর চাচা খোকন সেরনিয়াবাতকে মনোনয়ন দেয়া হয়েছে। কিন্তু মনোনয়ন পাওয়ার পর থেকেই সেখানে আওয়ামী লীগকে ঐক্যবদ্ধ করতে পারেনি খোকন সেরনিয়াবাত। যদিও আওয়ামী লীগের হেভিওয়েট নেতারা বরিশালে পড়ে আছেন। জাহাঙ্গীর কবির নানক, বাহাউদ্দিন নাছিমের মতো নেতারা বরিশাল নির্বাচনী প্রচারণায় সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করছেন। তারা জানান, জাতীয় নির্বাচনের আগে সিটি করপোরেশনের নির্বাচনগুলো নানা কারণে গুরুত্বপূর্ণ।
আওয়ামী লীগ এই নির্বাচনে জয়ী হওয়ার চেয়ে অবাধ-সুষ্ঠু-নিরপেক্ষ নির্বাচন করে একটি দৃষ্টান্ত স্থাপন করতে চায়। আওয়ামী লীগ প্রমাণ করতে চায় যে, দলীয় সরকারের অধীনে অবাধ সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন সম্ভব। আর এ কারণেই নির্বাচনের আগে প্রশাসন ও আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীসহ সংশ্লিষ্ট সবাইকে কঠোর নির্দেশনা দেয়া হয়েছে। তাদেরকে বলা হয়েছে, যে কোনো মূল্যে নির্বাচন অবাধ, সুষ্ঠু এবং নিরপেক্ষ হতে হবে। এই কারণেই এই নির্বাচনগুলো অন্যরকম একটি আবহ সৃষ্টি করেছে। জনগণের মধ্যে আগের চেয়ে বেশি উৎসাহ লক্ষ্য করা যাচ্ছে। আওয়ামী লীগের নেতারা বলছেন, এই সিটি করপোরেশন নির্বাচনে যেই জয়ী হোক না কেন আসলে জয়ী হবে গণতন্ত্র। এদিকে প্রশাসনের পক্ষে গতকাল এক সংবাদ সম্মেলন করে বরিশাল সিটি করপোরেশন নির্বাচনের ১২৬টি কেন্দ্রের মধ্যে ১০৬টি কেন্দ্রই ঝুঁকিপূর্ণ বলে জানিয়েছেন বরিশাল মেট্রোপলিটন পুলিশের (বিএমপি) কমিশনার সাইফুল ইসলাম। তিনি বলেন, পুলিশের হিসাবে ৭০টি কেন্দ্র গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু প্রার্থীরা যেসব কেন্দ্র নিয়ে শঙ্কা প্রকাশ করেছেন, সেগুলো যুক্ত করে মোট ১০৬টিকে গুরুত্বপূর্ণ ধরা হয়েছে। পুলিশ কমিশনার জানান, নির্বাচনের দিন আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে পুলিশ, র্যাব, এবিপিএন ও আনসার মিলিয়ে মোট ৪ হাজার ৪০০ সদস্য মোতায়েন থাকবেন। তিনি বলেন, ‘আমরা কোনো প্রার্থী চিনি না, প্রতীক চিনি না, দল চিনি না। আমরা চিনি মানুষ ও ভোটার। ভোটাররা নির্বিঘ্নে ভোট দিতে পারবেন। ভোটাররা যেন উৎসবমুখর পরিবেশে ভোট দিতে পারেন, তা নিশ্চিত করা হবে।