যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্ক অঙ্গরাজ্যের বাফেলো শহরের একটি সুপারমার্কেটে এক বন্দুকধারীর এলোপাতাড়ি গুলিতে অন্তত ১০ জন নিহত ও ৩ জন আহত হয়েছেন। স্থানীয় সময় শনিবার বিকেলে এ ঘটনা ঘটে । ঘটনার পরপরই সন্দেহভাজন হিসেবে ওই সুপারমার্কেট থেকে ১৮ বছর বয়সী শ্বেতাঙ্গ তরুণকে আটক করেছে পুলিশ। শুরুতে তাঁর পরিচয় প্রকাশ করা হয়নি। পরে জানা যায়, তিনি নিউইয়র্কেরই এক শ্বেতাঙ্গ তরুণ। বর্ণবাদে উৎসাহী হয়ে তিনি এ হামলা চালিয়েছেন। নিউইয়র্ক পুলিশের পক্ষ থেকে একে ‘বর্ণবাদী সহিংস হামলা’ হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছ। খবর রয়টার্সের
আদালতে দাখিল করা নথিপত্র অনুযায়ী, সন্দেহভাজন ওই তরুণের নাম পেটন গেন্ড্রন। তিনি পেনসিলভানিয়া সীমান্তের কাছাকাছি নিউইয়র্কের সাউদার্ন টায়ারের বাসিন্দা। পুলিশ বলছে, ওই তরুণ অ্যাসল্ট রাইফেল নিয়ে একাই হাজির হন। বাড়ি থেকে কয়েক ঘণ্টা গাড়ি চালিয়ে তিনি কৃষ্ণাঙ্গ–অধ্যুষিত এলাকা বাফেলোয় আসেন। সুপারমার্কেটটির গাড়ির পার্কিং এলাকায় প্রবেশের আগে গুলি চালাতে শুরু করেন। তিনি পুরো ঘটনা আমাজনের টুইচ প্ল্যাটফর্মে সরাসরি সম্প্রচারও (লাইভ) করেন।
কর্মকর্তারা বলেন, ওই গুলির ঘটনায় ১৩ জন হতাহতের মধ্যে ১১ জনই কৃষ্ণাঙ্গ। অন্য দুজন শ্বেতাঙ্গ। এরি কাউন্টি জেলার অ্যাটর্নি জন ফ্লিন বলেন, গুলি চালানোর কয়েক ঘণ্টা পর পেটন গেন্ড্রনের বিরুদ্ধে হত্যার অভিযোগ এনে আদালতে তোলা হয়। এ অপরাধে তাঁর যাবজ্জীবন কারাদণ্ড হতে পারে। নিউইয়র্কের আদালতের বিচারে মৃত্যুদণ্ডের বিধান নেই।
ফ্লিন আরও বলেন, গেন্ড্রনের জামিন নামঞ্জুর করে আদালত তাঁকে পুলিশি হেফাজতে রাখার নির্দেশ দিয়েছেন। একই সঙ্গে ফরেনসিক পরীক্ষারও নির্দেশ দিয়েছেন আদালত। ১৯ মে তাঁকে আবার আদালতে হাজির করার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।
কর্তৃপক্ষ বলছে, স্থানীয় গণমাধ্যমের তথ্য অনুযায়ী, গেন্ড্রন বিংহ্যামন্টনের কাছের স্টেট ইউনিভার্সিটি অব নিউইয়র্কের ব্রুম কমিউনিটি কলেজের শিক্ষার্থী। হামলার পরপরই তিনি আত্মঘাতী হতে চেয়েছিলেন। কিন্তু তার আগেই পুলিশ তাঁকে আটক করেছে। বাফেলোর পুলিশ কমিশনার জোসেফ গ্র্যামাগলিয়া এক সংবাদ বিবৃতিতে বলেন, সুপারমার্কেটে গুলি চালানোর পর পুলিশ ঘিরে ধরলে নিজের গলায় বন্দুক ধরেন গেন্ড্রন। পরে পুলিশ কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথোপকথনের পর তিনি আত্মসমর্পণ করেন।
গ্র্যামাগলিয়া আরও বলেন, গেন্ড্রন টপস ফ্রেন্ডলি মার্কেটস নামে সুপারমার্কেটে ঢোকার আগেই পার্কিংয়ের স্থানে তিনজনকে গুলি করে হত্যা করেন। এর পরপরই ওই সুপারমার্কেটে নিরাপত্তা প্রহরী হিসেবে কাজ করা সাবেক পুলিশ কর্মকর্তার সঙ্গে তাঁর গোলাগুলি শুরু হয়ে যায়। কিন্তু গেন্ড্রনের শরীরে বিশেষ সুরক্ষা বর্ম থাকায় তিনি গুলি থেকে রক্ষা পান। তাঁর গুলিতে ওই নিরাপত্তারক্ষীসহ সুপারমার্কেটে কেনাকাটা করতে আসা ৯ ব্যক্তি নিহত হন। সুপারমার্কেটের তিন কর্মী এ সময় আহত হন।
টপসের ব্যবস্থাপক হিসেবে কাজ করা শোনেল হ্যারিস বলেন, তিনি কমপক্ষে ৭০টি গুলির আওয়াজ শুনেছেন। ওই মার্কেটের পেছনে থাকা দরজা দিয়ে বের হওয়ার আগে তিনি বেশ কয়েকবার হোঁচট খেয়ে পড়ে যান। বন্দুকধারীর সাজসজ্জা দেখে মনে হয়েছিল, তিনি সেনাবাহিনীর সদস্য।
প্রত্যক্ষদর্শী ফায়ার সার্ভিসের অবসরপ্রাপ্ত কর্মী ক্যাথরিন ক্রফটন বলেন, তিনি তাঁর বারান্দা থেকে বন্দুকধারীকে গুলি করতে দেখেন। তিনি প্রথমে এক নারীকে গুলি করেন। ওই নারী সুপারমার্কেটে যাচ্ছিলেন। এরপর তিনি সুপারমার্কেটে কেনাকাটা করতে ব্যস্ত থাকা এক নারীকে গুলি করেন। তখন ভয়ে তিনি লুকিয়ে পড়েন।
যুক্তরাষ্ট্রের কেন্দ্রীয় গোয়েন্দা সংস্থা এফবিআইয়ের কর্মী স্টিফেন বেলনগিয়া বলেন, আইন অনুযায়ী এ হামলার ঘটনাটি ঘৃণ্য অপরাধ ও সহিংস বর্ণবাদী হামলা—উভয় হিসেবে তদন্ত করা হতে পারে।
এরি কাউন্টির শেরিফ জন গার্সিয়া এক সংবাদ সম্মেলনে বলেন, ‘এই ব্যক্তি পুরোই শয়তান। আমাদের সম্প্রদায়ের বাইরে থেকে এসে সরাসরি বর্ণবাদে অনুপ্রাণিত ঘৃণ্য অপরাধ করেছে সে।’
যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন ঘটনাটিকে ‘ঘৃণ্য’ কাজ আখ্যায়িত করে এর নিন্দা জানিয়েছেন। তিনি বলেছেন, ঘৃণার কোনো নিরাপদ আশ্রয় নেই। ঘৃণা থেকে সৃষ্ট সন্ত্রাসবাদের অবসান ঘটাতে সামর্থ্যের সবকিছুই করতে হবে।
নিউইয়র্কের গভর্নর ক্যাথি হচুল বলেন, হামলাকারী তাঁর ঘৃণ্য কর্মকাণ্ড সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে সরাসরি প্রচার করেছেন। যে প্ল্যাটফর্ম থেকে এটি সম্প্রচার করা হয়েছে, তারা কোনো ব্যবস্থা না নেওয়ায় তিনি হতাশ।
নিউইয়র্কের গভর্নর সহিংস চরমপন্থী মতাদর্শের উন্মত্ততা প্রচারের সুবিধা দেওয়ার জন্য ওই প্ল্যাটফর্মের ওপর ক্ষোভ জানিয়েছেন। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে এ ধরনের বিষয় প্রচারের ক্ষেত্রে নজরদারির ঘাটতির কথাও তুলে ধরেছেন তিনি।
এদিকে টুইচের পক্ষ থেকে এক বিবৃতিতে বলা হয়েছে, সরাসরি সম্প্রচার শুরুর দুই মিনিটের মাথায় তারা এটি বন্ধ করতে সক্ষম হয়েছিল। ওই ভিডিও যাতে প্ল্যাটফর্মে ছড়াতে না পারে, সে জন্য ব্যবস্থাও নিয়েছে তারা।
তবে ইতিমধ্যে অনলাইনে একটি নথি ছড়িয়ে পড়েছে, যেখানে দেখা গেছে, ওই তরুণ তাঁর পরিকল্পনার কথা আগেই লিখে রেখেছিলেন। তাতে কর্মতালিকা হিসেবে বন্দুক পরিষ্কার করা ও বন্দুক পরীক্ষা করার কথা লেখা ছিল। এমনকি হামলার ঘটনাটি সরাসরি সম্প্রচারের পরিকল্পনাও উল্লেখ করা হয়েছিল।
এর বাইরে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ‘দ্য গ্রেট রিপ্লেসমেন্ট থিওরি’ নামের ১৮০ পৃষ্ঠার একটি ঘোষণাপত্র ছড়িয়েছে। তাতে বলা হয়েছে, যুক্তরাষ্ট্র ও অন্য দেশে শ্বেতাঙ্গদের জায়গা নিয়েছে সংখ্যালঘুরা। এ ঘোষণাপত্রের লেখক গেন্ড্রন বলে ধারণা করা হচ্ছে। তবে নিউইয়র্কের পুলিশের দপ্তর থেকে এ ঘোষণাপত্র সম্পর্কে মন্তব্য করা হয়নি। নিউইয়র্কের মেয়র হচুল বলেছেন, বন্দুক নিয়ন্ত্রণ করার জন্য আগে থেকে পরিকল্পনা করা প্যাকেজ বাস্তবায়নে তিনি আরও সচেষ্ট হবেন।
নিউইয়র্কের এই গুলির ঘটনা যুক্তরাষ্ট্রে বর্ণবাদী হত্যাকাণ্ডের ধারাবাহিকতায় ঘটেছে বলে মনে করা হচ্ছে। এর আগে ২০১৮ সালের অক্টোবরে পিটসবার্গের সিনাগগে ১১ জনকে গুলি করে হত্যা করা হয়। ২০২১ সালের মার্চে আটলান্টায় স্পাতে এক শ্বেতাঙ্গের গুলিতে আটজন নিহত হন। শনিবারের এ ঘটনা ২০১৯ সালে নিউজিল্যান্ডের ক্রাইস্টচার্চের একটি মসজিদে গুলি চালিয়ে তা সরাসরি সম্প্রচারের ঘটনাটিকেও স্মরণ করিয়ে দেয়।
বাফেলো শহরের মেয়র ব্রায়ন ব্রাউন শহরটির বাসিন্দাদের জন্য শনিবার দিনটিকে বড় যন্ত্রণাদায়ক একটি দিন হিসেবে উল্লেখ করেছেন। তিনি বলেন, ‘ঘৃণা-বিদ্বেষ ছড়ানো এই ব্যক্তিকে আমাদের দেশকে বিভক্ত করতে দিতে পারি না।’
আরো পড়ুন : গোমস্তাপুর বাল্য বিয়ে থেকে রক্ষা পেল এক স্কুল ছাত্রী