বাংলাদেশের নব নাট্যচর্চার বয়স যখন ৫০ বছর, তখন আমরা উদযাপন করছি বাংলা সাধারণ রঙ্গালয়ের সার্ধশতবর্ষপূর্তি। নাটক আমাদের সংস্কৃতিতে নতুন কোনো বিষয় নয়। নানা ধরনের লোকনাট্য হাজার বছরের বাংলা সংস্কৃতিতে ছড়িয়ে আছে। তবে ইউরোপীয় ধাঁচে প্রসেনিয়াম মঞ্চে নাটক করা শুরু আমাদের এ অঞ্চলে ঊনবিংশ শতাব্দীর মাঝামাঝি থেকে। ধনাঢ্য বা জমিদার শ্রেণির লোকরা নিজেদের গৃহে থিয়েটারের আয়োজন করতেন। তবে তা আমন্ত্রিতদের মাঝে সীমাবদ্ধ থাকত। সাধারণ দর্শকের সেখানে প্রবেশাধিকার থাকত না। ১৮৭২ সালের ৩০ মার্চ ঢাকায় কিছুসংখ্যক উদ্যমী যুবক ‘পূর্ববঙ্গ রঙ্গভূমি’ নামে একটি থিয়েটার প্রস্তুত করে সেখানে ‘রামাভিষেক’ নাটক মঞ্চায়ন করেছিলেন টিকিটের বিনিময়ে। পরবর্তীকালে ১৯৭২ সালের ৭ ডিসেম্বর কলকাতায় একটি সাধারণ রঙ্গালয় স্থাপন করে তার নাম দেওয়া হলো ন্যাশনাল থিয়েটার এবং তখন থেকেই টিকিটের বিনিময়ে নিয়মিত নাট্যাভিনয় দেখার সুযোগ সৃষ্টি হলো। তাই ১৮৭২ সালের ৭ ডিসেম্বরকে আমরা প্রসেনিয়াম থিয়েটার চর্চার একটা সূচনাবিন্দু হিসেবে গণ্য করি।
স্বাধীনতা যে একটা সংস্কৃতিতে কী বিপুল পরিবর্তন এনে দিতে পারে, তার উজ্জ্বল উদাহরণ বাংলাদেশ। পাকিস্তান আমলে বাঙালি সংস্কৃতির বিকাশের সব পথ ছিল রুদ্ধ। কিন্তু বাংলাদেশের স্বাধীনতা আমাদের সব বন্ধ দুয়ার খুলে দিল। এখন কোনো বাধা নেই। সংস্কৃতিকর্মীরা নব উদ্যমে নিজ নিজ ক্ষেত্রে সৃষ্টিশীলতা দিয়ে শতফুল ফোটানোর চেষ্টায় নেমে পড়লেন। সংগীত, নৃত্য, নাটক, চিত্রকলা, আবৃত্তি, চলচ্চিত্র—সব ক্ষেত্রে নতুন জোয়ার এলো। প্রাণের আবেগের ফলে শুরুর দিকে মানের কথা তেমন বিবেচনা করিনি আমরা। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে আবেগ সংহত হলো, শিল্পমানের প্রতি সবাই মনোযোগী হলেন।
নাটকের কথা বলার আগে দুটি ঘটনার কথা উল্লেখ না করে পারছি না।
১১ ফেব্রুয়ারি ২০১৮ তারিখে পাকিস্তানের মানবাধিকার, নারীর অধিকার এবং গণতন্ত্রের বিশ্বনন্দিত প্রবক্তা আসমা জাহাঙ্গীর পৃথিবী ছেড়ে চলে যান। তাঁর নির্ভীক কর্মকাণ্ডের কারণে তিনি সারা বিশ্বে মানবাধিকারের ক্ষেত্রে একটি প্রতীকে পরিণত হয়েছিলেন। লাহোরে তাঁর জানাজায় হাজার হাজার মানুষ তাঁর প্রতি শ্রদ্ধা জানাতে এবং তাঁর আত্মার সদ্গতি কামনা করতে সমবেত হয়েছিল। সেই জানাজায় সামাজিক সংস্কারকে উপেক্ষা করে অনেক মুসলিম নারী পুরুষের পাশাপাশি দাঁড়িয়ে তাঁর রুহের মাগফিরাত কামনা করেছেন। সেখানে যে শুধু শিয়া ও সুন্নি মুসলমানরা ছিলেন তা নয়, ছিলেন খ্রিস্টান, শিখ, আহম্মদিয়া ও তৃতীয় লিঙ্গের মানুষ। এমন সমাজেরই তো স্বপ্ন দেখি আমরা।
ঠিক তারই এক বছর আগে ২০১৭ সালের ২ ফেব্রুয়ারি পাকিস্তানেরই লাল শাহবাজ কালান্দারের সুফি দরগায় কৃত্যনৃত্য পরিবেশনকালে ৯০ জনেরও বেশি মানুষকে আত্মঘাতী বোমা হামলায় হত্যা করা হয়। এই জঘন্য হত্যাকাণ্ডের ১২ ঘণ্টা না পেরোতেই শত শত মানুষ পুলিশের বাধা অতিক্রম করে দরগার অভ্যন্তরে প্রবেশ করে এবং সেই একই ধামালনৃত্য পরিবেশন শুরু করে। পরের দিন পাকিস্তানের প্রখ্যাত নৃত্যশিল্পী ও নির্দেশক সীমা কিরমানী তাঁর বন্ধু-বান্ধব নিয়ে ঘটনাস্থলে ছুটে যান এবং সেই সুফি দরগার পাশের বাজারে ধামালনৃত্য পরিবেশন করেন। মৌলবাদের বিরুদ্ধে শিল্পীদের প্রতিবাদের এর চেয়ে উন্নততর ভাষা আর কী হতে পারে! পাকিস্তানের মতো চরমপন্থী একটি দেশের এমন দুটি ঘটনা এই আশার সঞ্চার করে যে একদিন বিবেকী কণ্ঠস্বরগুলো আরো জোরদার হবে এবং সমাজকে প্রভাবিত করবে।
বাংলাদেশের মঞ্চনাটক জনপ্রিয় হওয়ার পেছনে বড় কারণ হচ্ছে সমসাময়িক রাজনৈতিক ও সামাজিক বাস্তবতা নাটকে প্রতিফলিত হয়েছে এবং মঞ্চ থেকে সব সময় সত্য কথা উচ্চারিত হয়েছে। মুক্তিযুদ্ধ ও তার চেতনা বিষয় হিসেবে অনেক নাটকে উঠে এসেছে। তরুণরা তাঁদের উদ্যম ও মেধা দিয়ে মঞ্চনাটককে পল্লবিত করেছেন। নাটকের বিশ্বমানচিত্রে বাংলাদেশ নিজের অবস্থান তুলে ধরতে সক্ষম হয়েছে।
৫০ বছরের প্রান্তে দাঁড়িয়ে পেছন ফিরে তাকালে সাফল্য-ব্যর্থতার অনেক ছবি মনের আয়নায় ভেসে ওঠে। সবচেয়ে বড় সাফল্য বোধ হয় নাটকের জন্য দর্শক সৃষ্টি করা। নিয়মিত নাট্যচর্চার অনুপস্থিতিতে আমাদের দেশে নাটকের দর্শক তৈরি হয়নি দীর্ঘদিন। কিন্তু সত্তরের দশকে নাট্যকর্মীদের অক্লান্ত শ্রমে ধীরে ধীরে মঞ্চনাটকের দর্শক তৈরি হলো, যারা টিকিট করে নাটক দেখতে অভ্যস্ত হলো। এটা একটা বড় অর্জন নিঃসন্দেহে। আমরা নতুন নতুন নাট্যকার পেলাম; নির্দেশক, অভিনেতা-অভিনেত্রী, নেপথ্য কুশলীরও অভাব হলো না। সবার একটাই লক্ষ্য—আমরা মঞ্চে নিয়মিত ভালো নাটক করব, যে নাটক জীবনের কথা বলে, সমাজের কথা বলে। সমকালীন বাস্তবতানির্ভর অনেক মৌলিক নাটক রচিত হলো।
মঞ্চসফল নাট্যকার হিসেবে আমরা পেলাম সৈয়দ শামসুল হক, মমতাজউদদীন আহমদ, আবদুল্লাহ আল মামুন, মামুনুর রশীদ, সেলিম আল দীন, এস এম সোলায়মান, মান্নান হীরা প্রমুখকে। আমাদের দুর্ভাগ্য, মামুনুর রশীদ ছাড়া আমাদের প্রথম সারির নাট্যকাররা কেউ আজ আর আমাদের মধ্যে নেই। এঁদের চলে যাওয়ার মাধ্যমে যে শূন্যতার সৃষ্টি হলো, তা পূরণ করার মতো নতুন নাট্যকার তেমন উঠে এলেন না। এ সময় আশার আলো দেখালেন মাসুম রেজা, মলয় ভৌমিক, রুমা মোদক, অলক বসু, আবদুল্লাহেল মাহমুদ, প্রদীপ দেওয়ানজী, রতন সিদ্দিকী, সাইমন জাকারিয়া, সাধনা আহমেদ প্রমুখ।
মৌলিক নাটকের অভাবে অনেক দলকেই বিদেশি নাটকের রূপান্তর বা অনুবাদের আশ্রয় নিতে হয়েছে। এতে আমাদের নাট্যসাহিত্য সমৃদ্ধ হয়েছে সন্দেহ নেই। অনেক চিরায়ত নাটকের বাংলা ভাষ্য আমরা পেয়েছি। তবে একটা কথা আমাদের সব সময় মনে রাখা দরকার যে সেই সব বিদেশি নাটকই আমরা মঞ্চে আনব, যেগুলো আমাদের সমাজের সঙ্গে সংগতিপূর্ণ বা যার সাহিত্যমূল্য রয়েছে।
গত ৫০ বছরে যেসব নাটক মঞ্চস্থ হয়েছে তার মধ্যে অনেক নাটকই প্রয়োগ নৈপুণ্যের কারণে দর্শকের স্মৃতিতে উজ্জ্বল হয়ে আছে। উদাহরণ হিসেবে ‘পায়ের আওয়াজ পাওয়া যায়’, ‘দেওয়ান গাজীর কিস্সা’, ‘কিত্তনখোলা’, ‘নূরলদীনের সারাজীবন’, ‘এখনও ক্রীতদাস’, ‘ম্যাকবেথ’, ‘টেম্পেস্ট’, ‘গ্যালিলিও’, ‘কোকিলারা’, ‘বিষাদ সিন্ধু’, ‘কোর্ট মার্শাল’, ‘সার্কাস সার্কাস’, ‘নিত্যপুরাণ’, ‘রাঢ়াঙ’, ‘বিনোদিনী’, ‘খনা’, ‘সে রাতে পূর্ণিমা ছিল’, ‘রিজওয়ান’, ‘মহাজনের নাও’, ‘লোক সমান লোক’, ‘কহে বীরাঙ্গনা’, ‘জয়জয়ন্তী’, ‘শাইলক অ্যান্ড সিকোফ্যান্টস’, ‘জ্যোতিসংহিতা’, ‘ইডিপাস’, ‘একশ বস্তা চাল’, ‘মাতব্রিং’, ‘আরজ চরিতামৃত’—এসব নাটকের নাম করা যায়। শুধু প্রযোজনা নৈপুণ্য নয়, বিষয়বস্তু, অভিনয়, দৃশ্যসজ্জা, নির্দেশনা—অনেক উপাদানের সমাহারে এই নাটকগুলো স্মরণীয় হয়ে থাকবে। তবে আমাদের ব্যর্থতা, আমরা ভিডিওতে এই নাটকগুলোর মঞ্চরূপ ধারণ করে রাখতে পারিনি। দর্শকের স্মৃতি যখন ম্লান হয়ে যাবে, এই নাটকগুলোও কালের গর্ভে হারিয়ে যাবে। মঞ্চনাটকের এটাই বিধিলিপি।
৫০ বছরের প্রান্তে দাঁড়িয়ে আমার কেবলই মনে হয়, গ্রুপ থিয়েটারের বর্তমান কাঠামো আর বেশিদিন চলবে না। পরিবর্তন আসবে। স্থায়ীভাবে দল গঠনের প্রয়োজনীয়তা হয়তো ফুরিয়ে যাবে। প্রত্যেকে বিভিন্ন প্রযোজনায় ভিন্ন ভিন্ন নির্দেশকের সঙ্গে কাজ করার সুযোগ পাবে।
করোনা অতিমারির কারণে ২০২০ ও ২০২১ সালে নাট্যচর্চা স্থবির হয়ে যায়। ২০২২-এ নতুন ও পুরনো দল মিলে প্রায় ৩৫টি নতুন নাটক মঞ্চে এনেছে। সবাই নতুন উদ্যমে কাজ শুরু করেছে। আমরা আশা করব, নতুন বছরে নাট্যচর্চা আরো গতিশীল হবে, মানসম্পন্ন অনেক নাটক আমরা মঞ্চে দেখতে পাব।
নাট্য প্রযোজনায় পৃষ্ঠপোষকতার বড় সংকট রয়েছে। একটি নতুন প্রযোজনায় গড়ে তিন লাখ টাকা ব্যয় হয়। এই টাকাটা জোগাড় করা নাট্যদলগুলোর জন্য কষ্টকর। আমরা অনেকবারই সংস্কৃতিবিষয়ক মন্ত্রণালয়কে বলেছি, বিভিন্ন দলকে ২০ থেকে ৬০ হাজার টাকা করে না দিয়ে বছরে নতুন প্রযোজনার জন্য ৫০টি দলকে দুই লাখ টাকা করে দেওয়া হোক। পরের বছর অন্য ৫০টি দলকে দেওয়া যেতে পারে। তাহলেই সরকারি অনুদানটা অর্থবহ হবে।
ঢাকায় অভিনয় উপযোগী মঞ্চের সংকট রয়েছে। এখন শুধু শিল্পকলা একাডেমি ও মহিলা সমিতিতে নিয়মিত নাটক মঞ্চস্থ হয়। ফলে দলগুলো বেশি অভিনয়ের সুযোগ পায় না। উত্তরা, গুলশান, বনানী, মিরপুর, ধানমণ্ডিতে নাটক মঞ্চায়নের কোনো মঞ্চ নেই। এসব এলাকায় মঞ্চ স্থাপিত হলে নাটকের দর্শক বাড়বে, দলগুলো বিভিন্ন এলাকায় গিয়ে নাটক মঞ্চায়ন করতে পারবে। মহড়ার জায়গার একটা বড় সংকট আছে। সে ক্ষেত্রে যদি বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ক্লাস শেষ হওয়ার পর মহড়া করা যায়, তাহলে এই সংকটের একটা সুরাহা হতে পারে। বাংলাদেশ গ্রুপ থিয়েটার ফেডারেশন কি এ ব্যাপারে উদ্যোগ নিতে পারে না?
গত ৫০ বছরে বাংলাদেশের নাটক যে জায়গায় এসে দাঁড়িয়েছে, প্রয়োজনীয় অবকাঠামোগত সুযোগ-সুবিধা পেলে আমাদের নাটক আরো অনেক দূর এগিয়ে যাবে—এ কথা নিশ্চিত করে বলা যায়।
সংস্কৃতিচর্চায় বিনিয়োগ হচ্ছে ভবিষ্যতের মননশীল জাতি গঠনে বিনিয়োগ। এ কথা কি নতুন করে কাউকে বুঝিয়ে বলার দরকার আছে?
সুত্র-কালের কন্ঠ অনলাইন
আরো পড়ুন : ৩৬ পয়সা বিদ্যুতের মূল্য বৃদ্ধিতেবছরে জনগণের বাড়তি খরচ ৩ হাজার কোটি টাকা