জনস্রোতপূর্ণ র্যালিতে বিএনপির ঘোষণা – ♦ ষড়যন্ত্র থেমে নেই ♦ স্বৈরাচারের দোসররা দেশে-বিদেশে প্রশাসনে এখনো সক্রিয় ♦ স্বাধীনতা সার্বভৌমত্ব রক্ষার জন্য সবাইকে ঐক্যবদ্ধ ও সতর্ক থাকতে হবে
বিশেষ প্রতিনিধি : রাজধানী ঢাকায় গতকাল জনস্রোতে উত্তাল এক র্যালিপূর্ব সমাবেশে বিএনপি দৃঢ় প্রত্যয় ঘোষণা করে বলেছে, বাংলাদেশে গণতন্ত্র ছাড়া অন্য কিছু করা চলবে না। চলতে দেওয়া হবে না। এ দেশে গণতন্ত্রই হচ্ছে মানুষের শেষ কথা। আর এই গণতন্ত্র ফেরাতে মানুষের ভোটাধিকার নিশ্চিত করতে হবে। দলের মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরের সভাপতিত্বে ও প্রচার সম্পাদক সুলতান সালাউদ্দিন টুকুর পরিচালনায় র্যালিপূর্ব সমাবেশে যুক্তরাজ্য থেকে ভার্চুয়ালি যুক্ত হয়ে র্যালিতে উদ্বোধনী বক্তব্য দেন বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান। এ সময় অস্থায়ী সমাবেশমঞ্চে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য মির্জা আব্বাস, ড. আবদুল মঈন খান, আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী, অধ্যাপক ডা. এজেডএম জাহিদ হোসেন, ভাইস চেয়ারম্যান আব্দুল আউয়াল মিন্টু, চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা ও জিয়াউর রহমান ফাউন্ডেশনের নির্বাহী পরিচালক অধ্যাপক ডা. ফরহাদ হালিম ডোনার, জহিরউদ্দিন স্বপন, যুগ্ম মহাসচিব খায়রুল কবির খোকন, শহীদ উদ্দীন চৌধুরী এ্যানিসহ সিনিয়র নেতারা উপস্থিত ছিলেন। তারেক রহমানের বক্তব্য শেষ হওয়ার পর মির্জা ফখরুলসহ মঞ্চে থাকা নেতারা ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যানের সঙ্গে সালাম বিনিময় করেন। এরপর র্যালি শুরু হয়। র্যালিটি নয়াপল্টন দলের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ের সামনে থেকে শুরু হয়ে জাতীয় সংসদের দক্ষিণ গেটে মানিক মিয়া অ্যাভিনিউ এলাকায় গিয়ে শেষ হয়।
‘জাতীয় বিপ্লব ও সংহতি দিবস’ উপলক্ষে বিএনপির পূর্বঘোষিত এ র?্যালিতে বর্ণাঢ্য মিছিল নিয়ে বিভিন্ন এলাকা থেকে বিপুলসংখ্যক নেতা-কর্মী অংশ নেন। বিকাল সাড়ে তিনটায় রাজধানীর নয়াপল্টনে দলের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ের সামনে থেকে এই র্যালি শুরু হয়।
উদ্বোধনী বক্তৃতায় প্রধান অতিথি বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান বলেন, আজকের রাজপথের এই সমাবেশ ও মিছিল কারও বিরুদ্ধে প্রতিবাদের ঝড় তোলার জন্য নয়। আজকের মিছিল দেশের স্বার্থরক্ষার মিছিল। তিনি বলেন, ১৯৭৫ সালের ৭ নভেম্বর ছিল বাংলাদেশের শত্রুমিত্র চেনার দিন। আর ২০২৪ সালের ৭ নভেম্বর শত্রুকে চিহ্নিত করার দিন। তারেক রহমান বলেন, ‘আগেও বলেছি বাংলাদেশের পক্ষের শক্তি ঐক্যবদ্ধ থাকলে আর কেউ দেশের স্বাধীনতাকে বিপন্ন করতে পারবে না। রাজধানী ঢাকার এই রাজপথে লাখো জনতার এই মিছিল, বাংলাদেশের পক্ষের শক্তিকে সাতই নভেম্বরের অন্তর্নিহিত শিক্ষায় দীক্ষিত করার মিছিল। লাখো জনতার আজকের এই মিছিল ফ্যাসিবাদবিরোধী আন্দোলনে আহত অসংখ্য ছাত্র-জনতা এবং হাজারো শহীদের স্বপ্নে একটি বৈষম্যহীন গণতান্ত্রিক মানবিক বাংলাদেশ গড়ার প্রত্যয়ের মিছিল।’
ভার্চুয়াল বক্তৃতায় তারেক রহমান বলেন, ‘কখনো যেন বাংলাদেশে ফ্যসিবাদ আর ফিরে আসতে না পারে, সে জন্য প্রতিটি নাগরিকের ভোটের মাধ্যমে জনপ্রতিনিধি নির্বাচন অত্যন্ত জরুরি। জনপ্রতিনিধি নির্বাচিত হওয়ার জন্য স্থানীয় সরকার থেকে কেন্দ্রীয় সরকার পর্যন্ত জনপ্রতিনিধি হতে ইচ্ছুক ব্যক্তিদের জনগণের ভোটের প্রতি যতক্ষণ পর্যন্ত মুখাপেক্ষী করা না যাবে, ততক্ষণ পর্যন্ত জনগণ গণতন্ত্রের সুফল পাবে না। এমনকি স্বৈরাচার বা ফ্যাসিবাদমুক্ত পরিবেশেও স্বল্প আয়ের মানুষকে বাজার সিন্ডিকেটের অভিশাপ থেকে মুক্ত করা অসম্ভব হয়ে পড়বে। যদি না মানুষের সরাসরি ভোটের অধিকার আমরা নিশ্চিত করতে পারি।’
‘স্বাধীনতাপ্রিয় জনগণের’ উদ্দেশে বিএনপির এই কান্ডারি বলেন, ‘গণতন্ত্রবিরোধী অপশক্তির ষড়যন্ত্র এখনো কিন্তু থেমে নেই। অন্তর্বর্তী সরকারকে ব্যর্থ করে দিতে পলাতক স্বৈরাচারের দোসররা দেশে-বিদেশে, প্রশাসনে, এখনো সক্রিয়। এই অন্তর্বর্তী সরকারকে কোনোভাবেই ব্যর্থ হতে দেওয়া যাবে না। তবে নিজেদের সতর্ক করতে চাইলে অন্তর্বর্তী সরকার জনগণের প্রত্যাশা পূরণে কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করবে। এটিই আজ জনগণের চাওয়া। তাই আসুন, লক্ষ-জনতার এই মিছিলকে কোনোভাবেই বৃথা যেতে দেওয়া যাবে না।’ এই প্রত্যাশা ও সাফল্য কামনা করে র্যালির উদ্বোধনী ঘোষণা করেন তারেক রহমান।
এর আগে পবিত্র কোরআন তেলাওয়াতের মধ্যে দিয়ে সংক্ষিপ্ত সমাবেশ অনুষ্ঠিত হয়। র্যালিটি নয়াপল্টনের বিএনপি কেন্দ্রীয় কার্যালয়ের সামনে থেকে শুরু হয়ে কাকরাইল মোড়, কাকরাইল মসজিদ, মৎস্য ভবন, ইঞ্জিনিয়ারিং ইনস্টিটিউট, শাহবাগ, বাংলামোটর, কারওয়ান বাজার, ফার্মগেট হয়ে মানিক মিয়া অ্যাভিনিউতে গিয়ে শেষ হয়।
দীর্ঘ এ র্যালিত বিএনপি ও এর অঙ্গসংগঠনের নেতা-কর্মীদের ঢল নামে। এর আগে নয়াপল্টন ও তার আশপাশের এলাকার অলিগলিতে নেতা-কর্মীরা অবস্থান নেন। র্যালিতে অংশ নিতে ঢাকার আশপাশের জেলাগুলো থেকেও আসেন নেতা-কর্মীরা। ঢাকা মহানগরের বিভিন্ন ওয়ার্ড ও থানা থেকে খন্ড খন্ড মিছিল নিয়ে আসেন তারা।
শহীদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান, বিএনপির চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়া ও তারেক রহমানের ছবি-সংবলিত ব্যানার, ফেস্টুন, জাতীয় ও দলীয় পতাকা এবং বিভিন্ন রঙের ক্যাপ পরে র্যালিতে অংশগ্রহণ করেন নেতা-কর্মীরা।
কামান, ধানখেত, কৃষক ও কমান্ডো সাজে নেতা-কর্মীরা র্যালিতে অংশ নেন। এ ছাড়া ঢাকঢোল বাজিয়ে, ট্রাকে করে বিভিন্ন রঙের টি-শার্ট গায়ে দিয়ে তারা র্যালিতে অংশ নেন। র্যালিতে অংশগ্রহণকারী নেতা-কর্মীরা নানা স্লোগানে মুখর করে রাখেন পুরো সময়। জিয়াউর রহমান, খালেদা জিয়া ও তারেক রহমান নিয়ে বিরতিহীন স্লোগানে মেতে ওঠেন নেতা-কর্মীরা। এর মধ্যে ঢাকা মহানগর দক্ষিণ বিএনপির সাবেক সিনিয়র যুগ্ম আহ্বায়ক নবী উল্লাহ নবীর নেতৃত্বে যাত্রাবাড়ী-ডেমরা এলাকা থেকে একটি দৃষ্টিনন্দন মিছিল এবং ঢাকা মহানগর উত্তর বিএনপির আহ্বায়ক ও বিএনপির কেন্দ্রীয় ক্রীড়াবিষয়ক সম্পাদক আমিনুল হকের নেতৃত্বে বিশাল একটি মিছিল এসে র্যালিতে অংশ নেয়।
বিএনপির এই বর্ণাঢ্য র্যালির সমাপনী বক্তব্যে দলের মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর কর্মসূচিতে ব্যাপকভাবে অংশগ্রহণের জন্য নেতা-কর্মী ও আগতদের প্রতি ধন্যবাদ জানান। তিনি বলেন, ‘ঢাকা মহানগর উত্তর, দক্ষিণ, ঢাকার আটটি জেলার নেতা-কর্মী ও আপামর জনসাধারণ, আপনাদের বেগম খালেদা জিয়া, তারেক রহমান ও বিএনপির পক্ষ থেকে আন্তরিক ধন্যবাদ জানাচ্ছি।’
নেতা-কর্মীদের উদ্দেশে বিএনপির মহাসচিব বলেন, ‘আজ জাতির স্বাধীনতা রক্ষার জন্য নতুন করে শপথ নিলেন, আজকে গণতন্ত্রকে ফিরিয়ে আনতে শপথ নিলেন।’
মির্জা ফখরুল আরও বলেন, সব রাজনৈতিক দলকে আহ্বান জানাব, স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্ব রক্ষার জন্য ঐক্যবদ্ধ হতে হবে। তিনি অন্তর্বর্তী সরকারের উদ্দেশে বলেন, ‘অতিদ্রুত সংস্কার করে অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন দিতে হবে। নির্বাচনের মধ্য দিয়ে দেশে আমরা জনগণের সংসদ ও জনগণের সরকার গঠন করতে পারব।’ বক্তব্য শেষে মহাসচিব তার দল ও নেতাদের সঙ্গে নিয়ে স্লোগান দেন। মির্জা ফখরুলের বক্তব্যে যখন শোভাযাত্রার আনুষ্ঠানিক সমাপ্তির ঘোষণা করা হয়, তখনো শোভাযাত্রা চলছিল। এ সময় জাতীয় সংসদের দক্ষিণ গেট এলাকা মানিক মিয়া অ্যাভিনিউ বিপুল জনসমাগমে কানায় কানায় ভরে ওঠে।
শোভাযাত্রার সমাপনী পর্বেও লন্ডন থেকে দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের ভার্চুয়ালি অংশ নেওয়ার কথা থাকলেও স্থানীয় (যুক্তরাজ্য) সময়ে জুমার নামাজে অংশ নেওয়ার কারণে তা সম্ভব হয়নি। এর আগে নয়াপল্টনে র্যালিপূর্ব সমাবেশে সভাপতির বক্তৃতায় মির্জা ফখরুল বলেন, ৭ নভেম্বর বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। এদিন বাংলাদেশের হাল ধরেছিলেন শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান, তারপর হাল ধরেছিলেন বেগম খালেদা জিয়া। আর এখন হাল ধরেছেন তারেক রহমান। তিনি আরও বলেন, ‘২০২৪ সালে আমরা ছাত্র-জনতার আরেকটা অভ্যুত্থান দেখেছি। দীর্ঘ ১৭ বছর আমরা লড়াই-সংগ্রাম করেছি আওয়ামী ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে। গত ১৭ বছরে আওয়ামী লীগ দেশের রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক কাঠামো ধ্বংস করে দিয়েছে।’ তিনি বলেন, তারা বাংলাদেশকে একটা লুটপাটের রাজত্ব এবং মাফিয়া রাষ্ট্রে পরিণত করেছিল। মির্জা ফখরুল বলেন, ‘শেখ হাসিনা পালিয়ে গেলেও তার দোসর অনেকে এখনো দেশে রয়ে গেছে। তারা ঘাপটি মেরে বসে আছে। তারা আবার বাংলাদেশকে আক্রমণ করবে। আমরা যেকোনো অপশক্তিকে উৎখাত করতে প্রস্তুত আছি। এর জন্য সব সময় ঐক্যবদ্ধ আছি এবং ভবিষ্যতেও থাকব।’ এ সময় বাংলাদেশে এখন গণতন্ত্র ছাড়া অন্য কিছু চলবে না বলেও হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করেন বিএনপি মহাসচিব। সমাপনী ঘোষণার আগে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য মির্জা আব্বাস বলেন, ‘আজকের শোভাযাত্রা প্রমাণ করেছে আমরা সব বাধা মোকাবিলা করতে পারব।’
অধ্যাপক ডা. এজেডএম জাহিদ হোসেন বলেন, তারেক রহমানের নেতৃত্বে জাতি ঐক্যবদ্ধ। তিনি বলেন, আজকের এই গণঐক্য, আজকের র্যালি সাধারণ মানুষের র্যালি। সব শ্রেণিপেশার মানুষের র্যালি। যেভাবে ১৯৭৫ সালের ৭ নভেম্বর র্যালি হয়েছিল, যেভাবে জিয়াউর রহমানকে ক্ষমতায় বসাতে জাতি ঐক্যবদ্ধ হয়েছিল, আজকের দিনেও জাতি তারেক রহমানের নেতৃত্বে ঐক্যবদ্ধ।
আরো পড়ুন : গুরুতর অসুস্থ লুৎফুজ্জামান বাবরকে আজ দেখতে যাবেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বোর্ড