একটি দেশের অগ্রগতির মূলে দক্ষ জনশক্তি। যার জন্য প্রয়োজন যুগোপযোগী শিক্ষা। এর জন্য সরকারের ব্যয়ও থাকে যথেষ্ট। কিন্তু বাংলাদেশে গত কয়েক বছর ধরে এ খাতটির গুরুত্ব কমছে। বৃহস্পতিবার জাতীয় সংসদে ২০২৩-২৪ অর্থবছরের জন্য ঘোষিত প্রস্তাবিত বাজেটেও এ চিত্র দেখা যায়। প্রস্তাবিত বাজেটে চলতি অর্থবছরের তুলনায় কমেছে শিক্ষাখাতের বরাদ্দ। ২০২২-২৩ অর্থবছরেও দেশের মোট জিডিপি’র অনুপাতে শিক্ষায় বরাদ্দ কমেছিল। ধারাবাহিকভাবে শিক্ষায় বরাদ্দ কমাকে দুঃখজনক বলছেন শিক্ষাবিদরা। তাদের পরামর্শ শিক্ষাখাতের ব্যয়কে বিনিয়োগ হিসেবে বিবেচনা করতে হবে। আর স্মার্ট বাংলাদেশ গড়ে তুলতে স্মার্ট জনশক্তি প্রয়োজন।
যার মূলে রয়েছে শিক্ষা। শিক্ষাখাতকে অবহেলা করে স্মার্ট বাংলাদেশ গড়া যাবে না।
সংসদে অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল উপস্থাপিত প্রস্তাবিত বাজেটে শিক্ষা ও প্রযুক্তি খাতে বরাদ্দ রাখা হয়েছে ১ লাখ ৪ হাজার ১৩৭ কোটি টাকা, যা মোট বাজেটের ১৩ দশমিক ৭ শতাংশ। চলতি ২০২২-২৩ অর্থবছরের মূল বাজেটে শিক্ষায় বরাদ্দ ছিল ৯৯ হাজার ৯৭৮ কোটি টাকা, যা মোট বাজেটের ১৪ দশমিক ৭ শতাংশ ছিল। সে হিসাবে নতুন অর্থবছরে শিক্ষা ও প্রযুক্তি খাতে বরাদ্দ মোট বাজেটের অনুপাতে ১ শতাংশ কমেছে। আবার জিডিপি’র (মোট দেশজ উৎপাদন) অনুপাতেও বরাদ্দ কমার ধারাবাহিকতা অব্যাহত রয়েছে। গত কয়েক বছরে জিডিপি’র অনুপাতে শিক্ষায় বরাদ্দ ঈর্ষণীয়ভাবে কমছে। প্রস্তাবিত বাজেটে শিক্ষাখাতে মোট বরাদ্দ জিডিপি’র তুলনায় ১ দশমিক ৭৬ শতাংশ। চলতি অর্থবছরে যেটি ছিল জিডিপি’র ১ দশমিক ৮৩ শতাংশ। এর আগে ২০২১-২২ অর্থবছরে ছিল ২ দশমিক ০৮ শতাংশ। অথচ জাতিসংঘের শিক্ষা, বিজ্ঞান ও সংস্কৃতি সংস্থার (ইউনেস্কো) মতে একটি দেশের মোট জিডিপি’র ৬ শতাংশ শিক্ষাখাতে বরাদ্দ দিতে হবে। এ ছাড়াও জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সময়ে ড. কুদরত-ই-খুদা শিক্ষা কমিশন দেশের মোট জিডিপি’র ৫ থেকে ৭ শতাংশ শিক্ষাখাতে বরাদ্দের পরামর্শ দিয়ে প্রতিবেদন দিয়েছিল। কিন্তু সর্বশেষ বাজেটগুলোয় তার উল্টো চিত্র দেখা যাচ্ছে।
শিক্ষাখাতে বরাদ্দ কমাকে দুঃখজনক মন্তব্য করে শিক্ষাবিদ ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগের ইমেরিটাস প্রফেসর ড. সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী বলেন, শিক্ষায় বরাদ্দ গত কয়েক বছর ধরে ধারাবাহিকভাবে যথেষ্ট পরিমাণে কমছে। আবার যে বরাদ্দ দেয়া হচ্ছে তারও সঠিক ব্যবহার হচ্ছে না। এখানে বিরাট ঘাটতি রয়েছে। সঠিক ব্যবহার না হওয়ার পেছনে সরকারি ও রাজনৈতিক কারণ জড়িত। তিনি বলেন, জনশক্তিকে দক্ষ করে গড়ে তুলতে শিক্ষায় বিনিয়োগ বাড়াতে হবে। কিন্তু আমরা সে পথে হাঁটছি না। শিক্ষাকে বাণিজ্যিকীকরণ করা হচ্ছে। সরকারও এ ক্ষেত্রে উদাসীন। তাই শিক্ষায় বরাদ্দ বড়ানোর সঙ্গে সঙ্গে এর ব্যবহারের ওপর গুরুত্ব দিতে হবে। শিক্ষকদের যথাযথ প্রশিক্ষণের আওতায় আনতে হবে। তাহলে শিক্ষার মান বৃদ্ধি পাবে। একই সঙ্গে শিক্ষকদের বেতন, ভাতা ও সামাজিক মর্যাদা বাড়ানোর উদ্যোগ নিতে হবে। আমরা চাই শিক্ষাখাতে বরাদ্দকে বিনিয়োগ হিসেবে বিবেচনা করা হোক।
শিক্ষায় বিনিয়োগের ফল ধনী থেকে গরিব সবাই ভোগ করে জানিয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক প্রক্টর এবং ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি বিভাগের প্রফেসর ড. একেএম গোলাম রব্বানী বলেন, মানসম্মত, দক্ষ ও স্মার্ট নাগরিক গড়ে তুলতে আমাদের শিক্ষায় বিনিয়োগ বাড়াতে হবে। অন্য খাতে ব্যয়ের সঙ্গে শিক্ষায় বিনিয়োগের সমন্বয় করা উচিত। এটাকে ব্যয় হিসেবে বিবেচনা না করে বিনিয়োগ হিসেবে দেখতে হবে। কারণ এর মাধ্যমে আমাদের এক একজন শিক্ষার্থী এক একটি প্রতিষ্ঠান হিসেবে গড়ে উঠবে। তাই যতটুকু সম্ভব শিক্ষাখাতে বরাদ্দ সময়োপযোগী করা উচিত। তিনি বলেন, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা স্মার্ট বাংলাদেশের যে দর্শন ঘোষণা করেছেন তার ভিত্তি চারটি বিষয়ের ওপর দাঁড়িয়ে। সেগুলো হলো- স্মার্ট সিটিজেন, স্মার্ট ইকোনমি, স্মার্ট সোসাইটি, স্মার্ট গভর্নেন্স। সে ক্ষেত্রে স্মার্ট জনগোষ্ঠীর রূপায়ন দিতে শিক্ষায় গুরুত্ব দিতে হবে। শিক্ষাখাতে ব্যয়কে ব্যয় নয় বরং বিনিয়োগ হিসেবে দেখতে হবে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের পরিচালক প্রফেসর ড. মো. আব্দুল হালিম বলেন, মুখে আমরা শিক্ষায় বাজেট বাড়ানোর কথা বললেও বাস্তবে উল্টোটা দেখছি। বাজেটের আকারের সঙ্গে সঙ্গে বরাদ্দ বাড়ছে ঠিক কিন্তু তুলনামূলক হারে কমছে। যেটি অন্য খাতের তুলনায় অনেক কম। আমরা যদি আমাদের গুণগত ও দক্ষ মানবসম্পদ তৈরি করতে চাই তাহলে শিক্ষাখাতে বরাদ্দ বাড়াতে হবে। বিশ্বের অন্য দেশের সঙ্গে তাল মিলিয়ে আমাদের শিক্ষায় বরাদ্দের বিষয়টি বিবেচনায় নিতে হবে। তিনি বলেন, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানও তার রাষ্ট্র কাঠামোর দর্শনে শিক্ষাকে গুরুত্ব দিয়েছেন। এর থেকেই বোঝা যায় তিনি আসলেই একজন ভিশনারি লিডার ছিলেন। তাই তার কন্যা মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাও সেটি অনুসরণ করবেন বলে মনে করি। তিনি যে স্মার্ট বাংলাদেশের স্বপ্ন আমাদের সামনে নিয়ে এসেছেন এর জন্য স্মার্ট নাগরিক প্রয়োজন। স্মার্ট নাগরিক তৈরি করতে শিক্ষায় বরাদ্দের ক্ষেত্রে আরও গুরুত্ব দেয়া উচিত।
এদিকে প্রস্তাবিত বাজেটকে শিক্ষা ধ্বংসের বাজেট উল্লেখ করে এ খাতে পর্যাপ্ত বরাদ্দের দাবি জানিয়েছে সমাজতান্ত্রিক ছাত্রফ্রন্ট। গতকাল সংগঠনটির সভাপতি সালমান সিদ্দিকী ও সাধারণ সম্পাদক রাফিকুজ্জামান ফরিদ এক যৌথ বিবৃতিতে বলেন, বাজেটে কম বরাদ্দ শিক্ষার প্রতিটি স্তরেই মারাত্মক ক্ষতিকর প্রভাব ফেলবে। শিক্ষার অধিকার মৌলিক এবং মানবিক। একটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র এ অধিকার তার নাগরিকদের জন্য নিশ্চিত করে। কিন্তু আমরা এর উল্টোটা দেখতে পাচ্ছি। শিক্ষাখাতে বরাদ্দ কমানোর মধ্যদিয়ে রাষ্ট্র-সরকার একদিকে যেমন শিক্ষা সংকোচনের পথে হাঁটছে, অন্যদিকে বরাদ্দ কমানোর মধ্যদিয়ে পুরো শিক্ষাখাতকে বেসরকারিকরণ-বাণিজ্যিকীকরণের পথে নিয়ে যাচ্ছে। যার ভবিষ্যৎ ফলাফল হবে অন্ধকারময়।
আরো পড়ুন : বিসিসি’র মেয়র প্রার্থীসহ বিএনপি’র ১৯ নেতাকর্মীকে শোকজ