রাঙ্গামাটির নানিয়ানচর উপজেলায় ৫০০ মিটার (আধাকিলোমিটার) দীর্ঘ একটি সেতু বিশাল একটি জনপদের জীবনমান পালটে দিয়েছে। অর্থনৈতিক উন্নতির পাশাপাশি স্বাস্থ্য, শিক্ষাসহ নানাভাবে জীবনমান উন্নয়নের সুযোগ সৃষ্টি করেছে রাঙ্গামাটির দুর্গম নানিয়ারচর উপজেলার অর্ধলাখ মানুষের। উঠছে পাকা ঘর, পাকা ঢালাই, হচ্ছে সড়ক। ভরা বর্ষা কিংবা শুষ্ক মৌসুমে যেখানে নদী পার হওয়া দুরূহ ব্যাপার ছিল, সেতু হয়ে যাওয়ায় এখন সেই নদী পার হওয়া মিনিটের ব্যাপারমাত্র।
আগে একমাত্র চেঙ্গী নদীর কারণে কৃষকেরা ফসলের দাম পেতেন না। আর এখন অর্ধকিলোমিটার দীর্ঘ এই সেতুকে ঘিরে রাঙ্গামাটির দুর্গম তিন উপজেলার মানুষ যাতায়াত, ব্যবসাবাণিজ্য আর পর্যটন ঘিরে নতুন করে স্বপ্ন দেখতে শুরু করেছেন। তবে চেঙ্গী নদীর ওপর নির্মিত এই সেতুর নামকরণ নিয়ে চরম আপত্তি উঠেছে। গত বছর জানুয়ারিতে উদ্বোধন হওয়া এই সেতুর নামকরণ করা হয়েছে চিত্রশিল্পী ‘বাবু চুনীলাল দেওয়ান সেতু’। বাবু চুনীলাল দেওয়ানের স্ত্রী স্থানীয় রাজাকার বাহিনীর প্রধান ছিলেন। এ নিয়ে পাহাড়ি-বাঙালিদের মধ্যে চরম ক্ষোভ ও উত্তেজনা বিরাজ করছে। সেতুটির অদূরে চির নিদ্রায় শায়িত বীরশ্রেষ্ঠ মুন্সী আব্দুর রউফের নামে সেতুটির নামকরণ করার দাবি পাহাড়ি-বাঙালিদের। এই দাবি বাস্তবায়ন না হলে আন্দোলনে নামার ঘোষণাও দেওয়া হয়েছে। এই প্রতিনিধি স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতৃবৃন্দ, বিএনপি নেতা ও ব্যবসায়ীসহ বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষের সঙ্গে বিষয়টি নিয়ে কথা বলেছেন। তারা সবাই একবাক্যে বলেছেন, বাবু চুনীলাল দেওয়ানের মতো শিল্পী বাংলাদেশে বহু আছেন। কিন্তু তাদের নামে সেতু করতে হবে কেন? ৪২ বছরে কখনোই বাবু চুনীলাল দেওয়ানের নাম শুনিনি। স্থানীয় একজন নেতা সরকারকে ভুল বুঝিয়ে তার নামে নামকরণ করিয়েছেন। পাহাড়ি-বাঙালিদের মধ্যে ক্ষোভ সৃষ্টির জন্যই সুপরিকল্পিতভাবে এটা করা হয়েছে। এটা আত্মঘাতী সিদ্ধান্ত। আমাদের কলিজার মধ্যে আঘাত করা হয়েছে।
বীরশ্রেষ্ঠ মুন্সী আব্দুর রউফের নামে সেতুটির নামককরণ করার দাবি জোরালো হচ্ছে। পার্বত্য চট্টগ্রাম ছাত্র সংসদ (পিসিসিপি) এবং পার্বত্য চট্টগ্রাম নাগরিক পরিষদ (পিসিএনপি)-এর পক্ষ থেকেও দাবি জানানো হয়েছে। সম্প্রতি পার্বত্য চট্টগ্রাম নাগরিক পরিষদের উদ্যোগে রাঙ্গামাটি জেলা প্রশাসক কার্যালয়ের সামনে মানববন্ধন করেছে পার্বত্য চট্টগ্রাম নাগরিক পরিষদ (পিসিএনপি) রাঙ্গামাটি জেলা শাখা। মানববন্ধন থেকে নানিয়ারচর সেতুটি ‘বীরশ্রেষ্ঠ মুন্সী আব্দুর রউফ-এর নামকরণের দাবি জানানো হয়েছে। মানববন্ধনে নাগরিক পরিষদ রাঙ্গামাটি জেলা সহসভাপতি কাজী জালোয়ার সভাপতিত্বে বক্তব্য রাখেন পার্বত্য চট্টগ্রাম নাগরিক পরিষদ কেন্দ্রীয় কমিটির চেয়ারম্যান কাজী মজিবর রহমান, কেন্দ্রীয় সহসভাপতি ও বান্দরবান জেলা সভাপতি, আলীকদম উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান মো. আবুল কালাম, মহাসচিব আলমগীর কবির, রাঙ্গামাটি জেলা সাধারণ সম্পাদক মোহাম্মদ সোলায়মান, পার্বত্য চট্টগ্রাম ছাত্র পরিষদ রাঙ্গামাটি জেলা শাখার সভাপতি মো. হাবীব আজম প্রমুখ। এর পাশাপাশি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমেও এ নামকরণ নিয়ে পাহাড়ি-বাঙালি সাধারণ মানুষের মধ্যে ব্যাপক ক্ষোভ দেখা দিয়েছে। অনেকে ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেছেন। বিভিন্ন কর্মসূচি পালন করা হচ্ছে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে একাধিক স্মারকলিপিও দেওয়া হয়েছে। সেসব কিছু আমলে না নিয়ে হুট করে সেতুর নাম বাবু চুনীলাল দেওয়ানের নামে নামকরণকে মেনে নিতে পারছেন না তারা। স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন উঠছে, সাধারণ মানুষের দাবিকে গুরুত্ব না দিয়ে হটাৎ এমন কী ঘটে গেল, যার কারণে সেতুটির নাম এমন একজনের নামে করা হলো, যাকে এ প্রজন্মের কেউ চেনেই না।
বিষয়টি নিয়ে অনুসন্ধান করতে গিয়ে দেখা যায়, বাংলাদেশ এশিয়াটিক সোসাইটি থেকে ২০২০ সালে প্রকাশিত ‘বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ জ্ঞানকোষ’ এর তথ্য মতে, মুক্তিযুদ্ধের সময় বাবু চুনীলাল দেওয়ানের স্ত্রী বসুন্ধরা দেওয়ান নানিয়ারচরের শান্তি কমিটি ও রাজাকার বাহিনীর প্রধান ছিলেন। এ খবর জানাজানি হওয়ার পর মানুষের মনে সেতুর নামকরণের পেছনের উদ্দেশ্য নিয়েও সন্দেহ তৈরি হয়েছে। কেউ কেউ মনে করছেন, সরকারের ভাবমর্যাদা নষ্ট করতেই কৌশলে এমন কাজ করা হয়েছে সুচতুর কোনো মহলের পক্ষ থেকে।
সেতুটির নির্মাণকালেই এর নামকরণের দাবি উঠতে থাকে নানিয়ারচরে মুক্তিযুদ্ধে অসাধারণ বীরত্ব প্রদর্শন করে শহিদ হওয়া বীরশ্রেষ্ঠ মুন্সী আব্দুর রউফের নামে। সেতুটির অদূরে এখনো যার সমাধি বিদ্যমান রয়েছে। সে সময় বীরশ্রেষ্ঠ মুন্সী আব্দুর রউফের নামে সেতুর নামকরণের দাবির প্রতি বিভিন্ন সামাজিক এবং রাজনৈতিক সংগঠনের পক্ষ থেকেও সংহতি জানানো হয়। ২০২০ সালের ২৬ জুলাই মুক্তিযোদ্ধা সংসদ সন্তান কমান্ড নানিয়ারচর শাখার ব্যানারে বীরশ্রেষ্ঠ মুন্সী আব্দুর রউফের নামে সেতুর নামকরণের দাবিতে মানববন্ধন করা হয়। তাদের দাবির প্রতি সংহতি জানিয়ে এতে নানিয়ারচর উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি আব্দুল ওয়াব হাওলাদারসহ গণ্যমান্য আরও অনেকেই অংশগ্রহণ করেন। মানববন্ধন শেষে নানিয়ারচর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা শিউলি রহমান তন্নীর কাছে প্রধানমন্ত্রী বরাবরে একটি স্মারকলিপি দেওয়া হয়। একই সংগঠনের উদ্যোগে পরের দিন ২৭ জুলাই সেতুটির নাম বীরশ্রেষ্ঠ মুন্সী আব্দুর রউফের নামে নামকরণের দাবিতে রাঙ্গামাটি জেলা প্রশাসক এ কে এম মামুনুর রশিদের মাধ্যমে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বরাবর আরও একটি স্মারকলিপি প্রদান করা হয়। অবশেষে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সেতুটি উদ্বোধনের এক বছর পর সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রণালয় থেকে ৩ জানুয়ারি ২০২৩ সালে জারি করা এক প্রজ্ঞাপনের মাধ্যমে সেতুটির ‘বাবু চুনীলাল দেওয়ান সেতু’ নামকরণ করা হয়। ১৫ জানুয়ারি ২০২৩ সালে রাঙ্গামাটির সংসদ সদস্য দীপঙ্কর তালুকদার সেতুর এই নামকরণের ফলক উন্মোচন করেন।
বাবু চুনীলাল দেওয়ানের নামে সেতুর নামকরণ প্রসঙ্গে নানিয়ারচর উপজেলা আওয়ামী লীগের একজন শীর্ষ নেতা জানান, এই নামকরণের ব্যাপারে আমাদের মতামত কেউ জানতে চায়নি। তাই এ ব্যাপারে কিছু জানি না। তবে আগে আমরা বীরশ্রেষ্ঠ মুন্সী আব্দুর রউফের নামে সেতুর নামকরণের দাবিতে প্রধানমন্ত্রী বরাবর স্মারকলিপি দিয়েছিলাম।
আরো পড়ুন : চট্টগ্রামের পাহাড়ে র্যাবের অভিযানে আট অপহরণকারী গ্রেফতার