সেমিফাইনাল তো বটেই, ফাইনালও অসম্ভব নয়, এবারের বিশ্বকাপে বাংলাদেশকে ঘিরে প্রত্যাশা ছিল এমনই। কিন্তু আসর শুরু হতেই প্রত্যাশার বেলুন চুপসে যেতে সময় লাগেনি মোটেও। প্রথম ম্যাচে জয়ের পর টানা ৬ ম্যাচ হারের তেতো স্বাদ পায় টাইগাররা। নেদারল্যান্ডসের বিপক্ষেও পারেনি টাইগাররা। একসঙ্গে একটি দলের ব্যাটারদের রান খরায় ভোগার ঘটনা এর আগে খুব একটা দেখা যায়নি। যে পেসারদের নিয়ে প্রত্যাশা বেশি ছিল তারাও সেটা মেটাতে ব্যর্থ। এমনকি ২০২৫ চ্যাম্পিয়নস ট্রফিতে বাংলাদেশের অংশ নেওয়া অনিশ্চয়তার মধ্যে পড়ে যায়। এরপর শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে দাপুটে জয়ে ঘুরে দাঁড়ায় টাইগাররা। আসরে ৯ ম্যাচে বাংলাদেশের জয় দুটি। অবশ্য আসর চলাকালীনই অধিনায়ক সাকিব আল হাসান স্বীকার করে নেন, বিশ্বকাপে এটাই বাংলাদেশের সবচেয়ে বাজে আসর।
ব্যক্তিগত পারফর্মেন্সে ব্যাটারদের মধ্যে সবচেয়ে এগিয়ে মাহমুদউল্লাহ রিয়াদ আর বোলিংয়ে মেহেদী হাসান মিরাজ। দেখে নেওয়া যাক স্কোয়াডে থাকা বাংলাদেশের খেলোয়াড়দের ব্যক্তিগত পারফর্মেন্স-
লিটন কুমার দাস: বিশ্বকাপে যাওয়ার আগে অধিনায়ক সাকিব আল হাসান বলেছিলেন, লিটন কুমার দাস বিশ্বকাপে সেরাদের একজন হবে। আসর শেষে এটা পরিষ্কার যে, লিটন তার অধিনায়ককে পুরোপুরি হতাশ করেছেন। ৯ ম্যাচে তার ব্যাট থেকে এসেছে ৩১.৫৫ গড়ে ২৮৪ রান। শূন্য রানে আউট হন একবার। ফিফটি মাত্র ২টি, একটি ইংল্যান্ড ও আরেকটি ভারতের বিপক্ষে। ফিফটি করেছেন যে দুই ম্যাচে, প্রত্যেকটিতে সেঞ্চুরির দারুণ সুযোগ ছিল তার সামনে। কিন্তু উইকেট ছুড়ে দেওয়ার পুরোনো রোগের কারণে সেটি করতে পারেননি। যদিও বিশ্বকাপের কোনো নির্দিষ্ট আসরে ওপেনার হিসেবে বাংলাদেশের জার্সিতে এটাই সর্বোচ্চ সংগ্রহ।
তানজীদ হাসান তামিম: ইনজুরির কারণে তামিম ইকবাল না থাকায় প্রথমবার বিশ্বকাপ খেলার সুযোগ পান তানজীদ হাসান তামিম। দুটি প্রস্তুতি ম্যাচে দারুণ ব্যাটিং করে বেশ আশাও জাগান এই বাঁহাতি ওপেনার। কিন্তু মূল পর্বে একদমই ব্যর্থ। কয়েকটি ম্যাচে দুর্দান্ত শুরু করলেও ইনিংস বড় করতে পারেননি। চলতি আসরের তার ব্যাট থেকে একমাত্র ফিফটি এসেছে ভারতের বিপক্ষে ম্যাচে। আসরে ৯ ম্যাচে ১৬.৪৫ গড়ে জুনিয়র তামিমের সংগ্রহ ১৪৫। এর মধ্যে ৪ ম্যাচেই ফেরেন সিঙ্গেল ডিজিটে, যেখানে ছিল একটি শূন্যও।
নাজমুল হোসেন শান্ত: বিশ্বকাপে যাদের ওপর সবচেয়ে বেশি প্রত্যাশা ছিল তাদের একজন নাজমুল হোসেন শান্ত। আসর শুরুর আগে তার ফর্ম স্বপ্ন দেখাচ্ছিল দলকে। কিন্তু সেই ফর্ম বিশ্বকাপে টেনে নিয়ে যেতে পারেননি শান্ত। প্রথম ম্যাচে আফগানিস্তানের বিপক্ষে ফিফটি করলেও এরপর টানা ৬ ম্যাচ ব্যর্থ হন তিনি। এরপর শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে ৯০ রানের ইনিংস খেললেও আবার অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে ব্যর্থ হন শান্ত। আসরে ৯ ম্যাচে এই বাঁহাতির সংগ্রহ ২৭.৭৫ গড়ে ২২২ রান। যেখানে ৬ ম্যাচে দুই অঙ্কের ঘরেই পৌঁছাতে পারেননি শান্ত। ‘গোল্ডেন ডাক’ দুটি।
সাকিব আল হাসান: এই বিশ্বকাপে সাকিব আল হাসানের অফফর্ম সবচেয়ে বেশি ভুগিয়েছে বাংলাদেশকে। আগের বিশ্বকাপে ৬০৬ রান করা সাকিব যেন এই আসরে ব্যাটিং করাই ভুলে গিয়েছিলেন। প্রথম ম্যাচে ৩ উইকেট পাওয়ার পর বল হাতে খুব একটা প্রভাব ফেলতে পারেননি। এর মধ্যে দেশে ফিরে ব্যক্তিগত কোচের সঙ্গে অনুশীলন করে বিতর্কের মুখেও পড়েন তিনি। এর সঙ্গে দুই দফা চোট সাকিবের বিশ্বকাপকে দুঃস্বপ্নে পরিণত করে। তবে শেষ ম্যাচটা ভালো খেলেন সাকিব, ব্যাট হাতে ৮২ রান আর বল হাতে দুই উইকেট নিয়ে শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে বাংলাদেশের জয়ের নায়ক তিনিই। সবমিলিয়ে নিজের শেষ বিশ্বকাপে ৭ ম্যাচ খেলে সাকিব করেন ২৬.৫৭ গড়ে ১৮৬ রান। আর বল হাতে তার শিকার ৯ উইকেট।
তাওহীদ হৃদয়: বিশ্বকাপের আগের সিরিজগুলোতে দুর্দান্ত ব্যাটিং করা তাওহীদ হৃদয় গতকালকের আগ পর্যন্ত চূড়ান্ত ব্যর্থ। গতকাল ৭৪ রানের ইনিংস না খেললে বিশ্বকাপে তার পারফর্মেন্স আরও বিশ্রী দেখাতো। রান খরায় একাদশ থেকেও বাদ পড়তে হয় তাকে। সবমিলিয়ে ৭ ম্যাচে ৩২.৮০ গড়ে তার সংগ্রহ ১৬৪ রান।
মুশফিকুর রহীম: নিজের সম্ভাব্য শেষ বিশ্বকাপে ব্যাট হাতে ব্যর্থ মুশফিকুর রহীম। আসর জুড়ে রান করতে ভুগেছেন তিনি। সবমিলিয়ে ৯ ম্যাচে ২৫.২৫ গড়ে তার ব্যাট থেকে আসে ২০২ রান। ফিফটি দুটি, সর্বোচ্চ স্কোর ৬৬। শেষ ৬ ম্যাচে করেছেন মাত্র ৮৩ রান। উইকেটের পেছনে গ্লাভস হাতে ৯ ম্যাচে ডিসমিসাল ৫টি।
মাহমুদউল্লাহ রিয়াদ: বিশ্বকাপে তার দলে থাকা নিয়েই ছিল অনিশ্চয়তা। কিছুটা চমক হিসেবেই স্কোয়াডে আসেন তিনি। এর আগে টানা কয়েক সিরিজ দলের বাইরে থাকায় তাকে ঘিরে সবার আগ্রহ ছিল। তবে সেই রিয়াদই এবারের বিশ্বকাপে বাংলাদেশের সবচেয়ে সফল ব্যাটার। ৮ ম্যাচে ৭ ইনিংসে ৫৪.৬৬ গড়ে তার সংগ্রহ ৩২৮, যেটা বাংলাদেশের জার্সিতে সর্বোচ্চ। এবারের আসরে টাইগারদের হয়ে তিনিই একমাত্র ব্যাটার হিসেবে সেঞ্চুরি করেন। প্রত্যেক ম্যাচে দুই অঙ্কের ঘরে গিয়েছেন এই ডানহাতি ব্যাটার। আগেই ঘোষণা দিয়েছেন এটা তার শেষ বিশ্বকাপ, সে অর্থে শেষটা বেশ দারুণভাবে করলেন। বিশ্বকাপ ইতিহাসে বাংলাদেশের জার্সিতে তিনি সর্বোচ্চ (৩) সেঞ্চুরির মালিক। আসরে দলে সর্বাধিক ১৪টি ছক্কা হাঁকান রিয়াদ। দ্বিতীয় সর্বাধিক ৫টি করে ছক্কা লিটনও হৃদয়ের। লিটনের সঙ্গে সর্বাধিক ৫টি ক্যাচও তার।
মেহেদী হাসান মিরাজ: এবারের বিশ্বকাপে মেহেদী হাসান মিরাজের ব্যাটিং পজিশনে বদল আনা হয়েছে অনেকবার। এটা নিয়ে টিম ম্যানেজমেন্ট সমালোচনার মুখেও পড়েছে। ব্যাট হাতে প্রথম ম্যাচে ফিফটি পেলেও এরপর আহামরি কিছু করতে পারেননি। বল হাতে খুব প্রভাব রাখতে না পারলেও আসরে বাংলাদেশি খেলোযাড়দের মদ্যে সবেচেয়ে বেশিউইকেট শিকার তারই। ৯ ম্যাচে ২২.৩৩ গড়ে মিরাজের সংগ্রহ ২০১ রান। আর বল হাতে শিকার ১০ উইকেট।
তাসকিন আহমেদ: বাংলাদেশের পেস বোলিংয়ে সবচেয়ে বড় ভরসা ছিলেন তাসকিন আহমেদ। কিন্তু বিশ্বকাপের পুরো আসরেই ব্যর্থ তিনি। দুই ম্যাচে চোটের কারণে একাদশের বাইরেও ছিলেন। সবমিলিয়ে ৭ ম্যাচ খেলে এই ডানহাতি পেসারের শিকার মাত্র ৫ উইকেট।
মোস্তাফিজুর রহমান: আগের আসরে ২০ উইকেট নেওয়া মোস্তাফিজ এবার যেন নিজেকে হারিয়ে আর খুঁজেই পেলেন না। ৮ ম্যাচ খেলে তিনি নেন মাত্র ৫ উইকেট।
নাসুম আহমেদ: এবারের বিশ্বকাপে ৩ ম্যাচ খেলার সুযোগ পান নাসুম আহমেদ। কিন্তু কোনো ম্যাচেই উইকেটের দেখা পাননি এই বাঁহাতি স্পিনার।
তানজিম হাসান সাকিব: পুরো আসরে মাত্র ১ ম্যাচ খেলার সুযোগ পান তানজিম হাসান সাকিব। শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে সেই ম্যাচে তার শিকার ৩ উইকেট।
শেখ মেহেদী: শেখ মেহেদী এবারের আসরে খেলেছেন ৩ ম্যাচ। যেখানে তিনি নেন ৬ উইকেট। এর মধ্যে ইংল্যান্ডের বিপক্ষে রয়েছে ৪ উইকেট।
শরিফুল ইসলাম: পেস আক্রমণের আরেক গুরুত্বপূর্ণ সদস্য শরিফুল ইসলাম এবার ম্যাচ খেলেছেন ৮টি। যেখানে তার শিকার মিরাজের সমান ১০ উইকেট।
হাসান মাহমুদ: ২ ম্যাচ খেলার সুযোগ পাওয়া হাসান মাহমুদ পেয়েছেন ৩ উইকেট। তবে অতিরিক্ত খরুচে হওয়ায় আর একাদশে সুযোগ পাননি। সাকিব চোট নিয়ে ছিটকে যাওয়ার পর শেষ ম্যাচের জন্য এনামুল হক বিজয়কে উড়িয়ে নিয়ে যাওয়া হয় ভারতে। তবে একাদশে সুযোগ পাননি তিনি। বদলি ফিল্ডার হিসেবে ফিল্ডিং করেন।
অোরো পড়ুন : তারকাদের মতে-আত্মহত্যা কেন!