বেকারত্বের হার জানতে বেকারত্বের সংজ্ঞা নিরূপণ করা প্রয়োজন

ওকে নিউজ স্পেশাল নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি প্রচ্ছদ মুক্তমত লাইফ স্টাইল হ্যালোআড্ডা

বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) শ্রমশক্তি জরিপে বেকারত্বের চিত্র দেশের শ্রমবাজারের বর্তমান পরিস্থিতির প্রতিফলন নয়। বিবিএসের প্রাথমিক প্রতিবেদনে কিছু অবাস্তব এবং বিপরীতমুখী তথ্য দেখা গেছে। প্রকৃত পরিস্থিতি জানতে বাংলাদেশের বাস্তবতার আলোকে বেকারত্বের সংজ্ঞা নিরূপণ করা প্রয়োজন। কয়েকজন বিশেষজ্ঞ অর্থনীতিবিদ এমন মত প্রকাশ করেছেন।

গত মঙ্গলবার বিবিএসের শ্রমশক্তি জরিপ প্রতিবেদন প্রকাশ করা হয়। এতে দেখা যায়, আগের জরিপের তুলনায় দেশে বেকারত্ব কমেছে। বেকারত্বের হার মোট শ্রমশক্তির ৩ দশমিক ৬ শতাংশ, যা পাঁচ বছর আগে ছিল ৪ দশমিক ২ শতাংশ। দেশে বেকারের সংখ্যা এখন ২৬ লাখ ৩০ হাজার। পাঁচ বছর আগে ছিল ২৭ লাখ। অর্থাৎ গত পাঁচ বছরের ব্যবধানে দেশে বেকার কমেছে ৭০ হাজার। আগের জরিপ ছিল ২০১৬-১৭ সালের।

বিবিএস জানিয়েছে, জরিপ পরিচালনায় আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থার (আইএলও) কর্মসংস্থানের সংজ্ঞা অনুসরণ করা হয়। জরিপকালীন কোনো উত্তরদাতা যদি বলে থাকেন, তিনি গত সপ্তাহে অন্তত এক ঘণ্টা মজুরির বিনিময়ে কাজ করার সুযোগ পেয়েছেন, তাহলে তাঁকে কর্মসংস্থানে নিয়োজিত হিসেবে ধরা হয়েছে। পরিবারের জন্য হাঁস–মুরগি পালন করলেও তাঁকে বেকার বলা যাবে না। এমনকি উৎপাদনশীল কাজে মজুরি না পেলেও তাঁকে বেকার বলা যাবে না। ১৫ বছর এবং তার বেশি বয়সীদের শ্রমশক্তি হিসেবে বিবেচনা করা হয়ে থাকে।

আইএলওর কর্মসংস্থান খাতের সাবেক উপদেষ্টা অর্থনীতিবিদ ড. রিজওয়ানুল ইসলাম বলেন, ২০২২ সালের শ্রমশক্তি জরিপের উপাত্ত থেকে দেখা যায় যে, ২০১৬-১৭ সালের তুলনায় বেকারত্বের হার কমেছে। কিন্তু একে সুসংবাদ বলে মনে করা যায় না। কারণ আইএলও’র সংজ্ঞা অনুযায়ী জরিপে যেভাবে বেকার চিহ্নিত করা হয়, তা থেকে বাংলাদেশের মতো দেশের শ্রমবাজারের প্রকৃত চিত্র পাওয়া যায় না। এ সংজ্ঞায় জরিপের আগের সপ্তাহে এক ঘণ্টাও কাজ করেননি কিন্তু কাজ করতে ইচ্ছুক এবং সক্রিয়ভাবে কাজ খুঁজছিলেন– এই তিন শর্ত পালন করলেই একজনকে বেকার বলে গণ্য করা হয়। যেসব দেশে বেকারদের জন্য কোনো ভাতা বা সহায়তা নেই এবং তাদের একটা বড় সংখ্যা দরিদ্র, সেসব দেশে সপ্তাহে এক ঘণ্টাও কাজ করেননি এরকম মানুষের সংখ্যা কম হওয়ারই কথা। অভিজ্ঞতায় দেখা গেছে যে, আর্থিক অনটনের কারণে অনেকেই কিছু একটা করে সামান্য হলেও উপার্জনের চেষ্টা করেন। এ ধরনের মানুষ হয়তো বেকার হিসেবে চিহ্নিত হন না; কিন্তু তাদের অনেকেই কর্মরত হলেও দরিদ্র। এই শ্রেণির মানুষের সংখ্যা বাড়ল না কমলো, তা একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়।

তিনি বলেন, ২০২২ সালের জরিপ অনুযায়ী মোট কর্মসংস্থানে কৃষির অংশ বেড়েছে এবং শিল্পের অংশ কমেছে। কভিড মহামারির সময় থেকেই দেখা যাচ্ছিল যে, শিল্পখাতে শ্রমিক ছাঁটাই হচ্ছে আর শ্রমজীবী মানুষের মধ্যে গ্রামে ফিরে যাওয়ার প্রবণতা বাড়ছে। বাংলাদেশের মতো দেশে, যেখানে কৃষিতে উদ্বৃত্ত শ্রম রয়েছে এবং অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে কৃষি থেকে শ্রমিক শিল্প খাতে যাবে এমনটিই আশা করা হয়। সেখানে কৃষিতে নিয়োজিতের সংখ্যা বাড়া এবং শিল্পে কমা অবশ্যই উল্টোমুখী প্রবণতা। এটি একদিকে যেমন অর্থনৈতিক দুরবস্থার ইঙ্গিত দেয়, অন্যদিকে নীতিমালার ব্যর্থতারও পরিচায়ক।

বিশ্বব্যাংকের সাবেক লিড ইকোনমিস্ট ড. জাহিদ হোসেন বলেন, আইএলওর মানদণ্ডে বাংলাদেশের বেকারের সংজ্ঞা নির্ধারণ করলে তাতে প্রকৃত বাস্তবতা পাওয়া যাবে না। এ কারণে পরিসংখ্যান ব্যুরোর প্রতিবেদনটি রহস্যজনক মনে হচ্ছে। আইএলওর আরও সংজ্ঞা আছে। যেমন– শ্রম কতটা কার্যকর অর্থাৎ সপ্তাহের ৪০ ঘণ্টার আয় দিয়ে ব্যয় মেটানো সম্ভব কিনা তার ভিত্তিতে। তাঁর মতে, গত পাঁচ বছরে দেশের অর্থনৈতিক কাঠামো এবং বিবিএসের জরিপে কর্মংস্থানের তথ্য পরস্পর বিপরীতমুখী। বাংলাদেশকে পৃথিবীর দ্রুত বর্ধনশীল অর্থনীতির দেশগুলোর অন্যতম বলা হয়। এবং তা শিল্প খাতের সম্প্রসারণ বিবেচনা থেকেই। মোট দেশজ উৎপাদনে (জিডিপি) কৃষির চেয়ে শিল্প খাতের অবদানও বাড়ছে। অথচ বিবিএসের জরিপ প্রতিবেদন বলছে, শিল্পের চেয়ে কৃষিতে কর্মসংস্থান বেশি হয়েছে। আবার প্রতিবেদন অনুযায়ী পুরুষের চেয়ে নারীর কর্মসংস্থান বেড়েছে। তাহলে কি শিল্পের চেয়ে কৃষিতে নারীশ্রমিক হঠাৎ বেড়ে গেল। এছাড়া করোনার সময় কর্মসংস্থান বেড়েছে বলা হচ্ছে। বাস্তবতার সঙ্গে যা মেলানো যায় না।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক এবং বেসরকারি গবেষণা সংস্থা সাউথ এশিয়ান নেটওয়ার্ক ফর ইকোনমিক মডেলিংয়ের (সানেম) নিবাহী পরিচালক ড. সেলিম রায়হান বলেন, গত পাঁচ বছরে দেশে বেকার মানুষের সংখ্যা কমেছে– এই তথ্য বিশ্বাসযোগ্য নয়। বাস্তবতা অনুযায়ী বেকারত্ব আরও বেড়ে যাওয়ার কথা। ছদ্ম বেকারের তথ্য দেওয়া হয়নি বিবিএসের প্রতিবেদনে। অথচ এ শ্রেণির বিশাল একটা অংশ বেকারত্বের যন্ত্রণায় ভুগছে। তিনি বলেন, শ্রমবাজারে স্বল্প দক্ষতা এবং মজুরি ও কম উৎপাদনশীলতার দুষ্টচক্র রয়েছে, যেখানে অনানুষ্ঠানিক খাতের আধিপত্য রয়েছে। এর মধ্যেও নারীর কর্মসংস্থান কীভাবে বাড়ল তা পরিষ্কার নয়। বিবিএসের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, অনানুষ্ঠানিক খাতে নারীর কর্মসংস্থান গত পাঁচ বছরের চেয়ে প্রায় ৭ শতাংশ বেড়েছে। কিন্তু গত কয়েক বছরে দেশে কী এমন ঘটনা ঘটেছে, যার ফলে নারীর কর্মসংস্থান এত বেশি হারে বাড়ল।

আরো পড়ুন : গিনেস বুকে রেকর্ড করলেন চিত্রশিল্পী মাহফুজুর রহমান

Share The News

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *