বাংলাদেশ ব্যাংকের অধীনে রাষ্ট্রায়ত্ত পাঁচ ব্যাংকের নিয়োগ পরীক্ষার প্রশ্নপত্র ফাঁসে জড়িত আছেন বুয়েট শিক্ষক নিখিল রঞ্জন ধর। বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে অল্প টাকায় পরীক্ষার টেন্ডারগুলো নিয়ে আসতেন নিখিল রঞ্জন। পরীক্ষার প্রশ্নপত্র তিনি নিজেই ব্যাগে ঢুকিয়ে নিতেন। তবে আহ্ছানউল্লা বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের পিয়ন দেলোয়ার ২০২১ সালের ৬ নভেম্বর পাঁচ ব্যাংকের ১ হাজার ৫১১টি ‘অফিসার ক্যাশ’ পদের পরীক্ষার প্রশ্নপত্র ছাপানোর সময় নিখিল রঞ্জনের ব্যাগে ঢুকিয়ে দেন। সেই প্রশ্নপত্রই ফাঁস হয়েছিল।
ঢাকার চিফ মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট (সিএমএম) আদালতে বুয়েট শিক্ষক নিখিল রঞ্জন ধরের বিরুদ্ধে দেওয়া অভিযোগপত্রে এসব তথ্য উল্লেখ করা হয়েছে। গত ২৯ জানুয়ারি অভিযোগপত্রভুক্ত পলাতক আসামি নিখিল রঞ্জন ধরের বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারির আবেদন করেছে পুলিশ।
প্রশ্নপত্র ফাঁসের অভিযোগের বিষয়ে জানতে চেয়ে বুয়েট শিক্ষক নিখিল রঞ্জন ধরকে ফোন করে তাঁর মুঠোফোন বন্ধ পাওয়া গেছে। তবে এর আগে প্রশ্নপত্র ব্যাগে ঢোকানোর বিষয়টি স্বীকার করলেও নিখিল রঞ্জন ধর সাংবাদিকদের কাছে দাবি করেছিলেন, ‘চেক’ করার পর সেই প্রশ্নপত্রগুলো তিনি ময়লার স্তূপে ফেলে আসতেন। ওই ময়লার স্তূপ ব্যবস্থাপনার দায়িত্বে ছিলেন আহছানউল্লাহ বিশ্ববিদ্যালয়ের কর্মচারীরা।
অভিযোগপত্রে অধ্যাপক নিখিলের সোনালী ব্যাংকের হিসাবে অনেক টাকার লেনদেন হওয়ার তথ্য উল্লেখ করা হয়েছে। এ বিষয়ে নিখিল রঞ্জন ধর ২০২১ সালের ২৩ নভেম্বর প্রথম আলোকে বলেছিলেন, ‘আমি ১৯৮৬ সাল থেকে বুয়েটের শিক্ষক হিসেবে কর্মরত। প্রতিষ্ঠান থেকে পাওয়া অর্থ আমার ব্যাংক অ্যাকাউন্টে জমা হয়। সেখানে ১০ কোটি টাকা জমেছে। এটা আমার উপার্জনের টাকা। আমার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র হচ্ছে। আমি কোনো প্রশ্নপত্র ফাঁসে জড়িত নই। বলা হচ্ছে, আমি ছাপাখানা থেকে প্রশ্নপত্র ব্যাগে ঢুকিয়ে নিয়ে আসতাম। ষড়যন্ত্র করে আমাকে ফাঁসানো হচ্ছে।’
পাঁচ ব্যাংকের নিয়োগ পরীক্ষার প্রশ্নপত্র ফাঁসের তদন্তে নাম আসার পর বুয়েটের ইন্ডাস্ট্রিয়াল অ্যান্ড প্রোডাকশন ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের প্রধানের পদ থেকে নিখিল রঞ্জন ধরকে অব্যাহতি দেয় বুয়েট কর্তৃপক্ষ। একই সঙ্গে তাঁকে কোনো পরীক্ষায় দায়িত্ব পালন না করারও নির্দেশ দেওয়া হয়।
বাংলাদেশ ব্যাংকের ব্যাংকার্স সিলেকশন কমিটির আওতায় ২০২১ সালের ৬ নভেম্বর রাষ্ট্রায়ত্ত পাঁচ ব্যাংকে অফিসার (ক্যাশ) নিয়োগের প্রাথমিক পরীক্ষা হয়। ১ হাজার ৫১১টি পদের বিপরীতে এই পরীক্ষায় ১ লাখ ১৬ হাজার ৪২৭ চাকরিপ্রত্যাশী অংশ নেন। পরীক্ষার প্রশ্নপত্র ফাঁসের পর গোয়েন্দা পুলিশ (ডিবি) তদন্তে নামে। পরে ডিবির উপপরিদর্শক (এসআই) সুকান্ত বিশ্বাস বাদী হয়ে রাজধানীর বাড্ডা থানায় মামলা করেন। মামলা তদন্ত করে গত বছরের নভেম্বর মাসে ১৫ জনের বিরুদ্ধে আদালতে অভিযোগপত্র জমা দেয় ডিবি পুলিশ। তবে মামলার অভিযোগপত্র থেকে শিক্ষক নিখিল রঞ্জনকে কেন বাদ দেওয়া হলো, তা জানতে চেয়ে গত ২৫ জানুয়ারি আদেশ দেন আদালত। এরপর গত ২৯ জানুয়ারি সম্পূরক অভিযোগপত্র জমা দেয় ডিবি পুলিশ।
অধ্যাপক নিখিলের সম্পৃক্ততা
সম্পূরক অভিযোগপত্রে বলা হয়েছে, পাঁচ ব্যাংকের নিয়োগ পরীক্ষার প্রশ্নপত্র ফাঁসে বুয়েট শিক্ষক নিখিল রঞ্জন ধরসহ ৩৪ জনের নাম জানতে পেরেছে ডিবি। তবে ১৮ জনের পূর্ণাঙ্গ ঠিকানা না পাওয়ায় তাঁদের মামলা থেকে অব্যাহতি দেওয়ার আবেদন করা হয়েছে। প্রশ্নপত্র ফাঁসের দায় স্বীকার করে আদালতে জবানবন্দি দিয়েছেন ছয়জন আসামি। এদের মধ্যে দুজনের জবানবন্দিতে নিখিল রঞ্জন ধরের নাম উঠে এসেছে।
অভিযোগপত্রে বলা হয়, আহ্ছানউল্লা বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের পিয়ন দেলোয়ার তাঁর স্বীকারোক্তিতে নিখিল রঞ্জনের নাম উল্লেখ করেছেন। তিনি যাতে দেশ ত্যাগ করতে না পারেন, সে ব্যাপারে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের কাছে আবেদন করা হয়। পাশাপাশি আদালতের অনুমতি নিয়ে তাঁর ব্যাংক হিসাবের তথ্য পর্যালোচনা করা হয়।
মামলার তদন্ত কর্মকর্তা ডিবির উপপরিদর্শক (এসআই) শামীম আহমদ প্রথম আলোকে বলেন, আসামিদের স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দির তথ্য পর্যালোচনায় প্রশ্নপত্র ফাঁসে বুয়েট শিক্ষক নিখিল রঞ্জন ধরের জড়িত থাকার প্রমাণ পাওয়ায় ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তার অনুমোদন নিয়ে তাঁর বিরুদ্ধে আদালতে অভিযোগপত্র জমা দেওয়া হয়েছে।
অভিযোগপত্রে আরও বলা হয়, প্রশ্নপত্র ফাঁস চক্রের অন্যতম সদস্য হলেন জনতা ব্যাংকের গুলশান শাখার কর্মকর্তা শামসুল হক শ্যামল, আহ্ছানউল্লা বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের পিয়ন দেলোয়ার, কর্মী মুক্তারুজ্জামান রয়েল, রবিউল আউয়াল, পারভেজ মিয়া ও মিজানুর রহমান। এই ছয়জন আদালতে ১৬৪ ধারায় জবানবন্দি দেন। তাঁদের জবানবন্দিতে এই প্রশ্নপত্র ফাঁসের পরিকল্পনা, অর্থ গ্রহণসহ পুরো বিষয়ের বিস্তারিত উঠে আসে। দেলোয়ার, পারভেজ ও মোক্তার আগে থেকেই সিদ্ধান্ত নেন, তাঁরা পাঁচ ব্যাংকের নিয়োগ পরীক্ষার প্রশ্নপত্র পরীক্ষার আগের রাতে ফাঁস করবেন। সে অনুযায়ী তাঁরা প্রশ্নপত্র ফাঁস করেন। রূপালী ব্যাংকের জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা জানে আলম পরীক্ষার্থী জোগাড় করেন। দেলোয়ারদের ফাঁস করা প্রশ্নে পরীক্ষা হয়। দেলোয়ার স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দিতে বলেন, প্রশ্নপত্র ছাপার বিভিন্ন কাজে তিনি আহ্ছানউল্লা বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাপাখানায় যেতেন। বুয়েট শিক্ষক নিখিল রঞ্জন ধর নিজেই তাঁর ব্যাগে প্রশ্নপত্র ঢুকিয়ে নিতেন। তিনি নিজেও নিখিল রঞ্জনের ব্যাগে প্রশ্ন ঢুকিয়ে দিতেন।
বুয়েটের নিখিলসহ অভিযোগপত্রভুক্ত ১৬
পাঁচ ব্যাংকের প্রশ্নপত্র ফাঁসে জড়িত ব্যক্তিরা হলেন, বুয়েটের ইন্ডাস্ট্রিয়াল অ্যান্ড প্রোডাকশন ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের সাবেক প্রধান নিখিল রঞ্জন ধর (৬০), পরীক্ষার্থী রাইসুল ইসলাম ওরফে স্বপন (৩৬), জনতা ব্যাংকের কর্মকর্তা শামসুল হক ওরফে শ্যামল (৩৪) ও আবদুল্লাহ আল জাবের (৩৪), আহ্ছানউল্লা বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের টেকনিশিয়ান মুক্তারুজ্জামান ওরফে রয়েল (২৬), পিয়ন দেলোয়ার হোসেন (৩১), কর্মী রবিউল আউয়াল (৪১), পারভেজ মিয়া (২৬), মিজানুর রহমান মিজান (৩৭), মোবিন উদ্দিন (৩২), মোস্তাফিজুর রহমান (৩৭) ও সোহেল রানা (৩৫), পরীক্ষার্থী রাশেদ আহমেদ ওরফে বাবলু (৩৭), জাহাঙ্গীর আলম জাহিদ (৩৮), রবিউল ইসলাম ওরফে রবি (৪১) এবং রূপালী ব্যাংকের জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা জানে আলম ওরফে মিলন (৩২)।
প্রশ্নপত্র ফাঁসে জড়িত আরও ১৮
ব্যাংকের নিয়োগ পরীক্ষার প্রশ্নপত্র ফাঁসে জড়িত অপর ১৮ জন হলেন সম্রাট, রব্বানি, রুবেল, আপন, উজ্জল, রাকিব, কাফি, নাদিম, রাজিব, লিটু, সবুজ, আলমাস আলী, মাইনুল, আতিক, মুকুল, জাকির, হেলাল ও মিঠু। অভিযোগপত্রে বলা হয়, ভবিষ্যতে এই ১৮ জনের পূর্ণাঙ্গ নাম ঠিকানা জানা সাপেক্ষে আদালতে সম্পূরক অভিযোগপত্র জমা দেবে পুলিশ।
আরো পড়ুন : নতুন প্রজন্মের স্থপতিদের চোখে সূচনা হলো ‘লার্নিং ফ্রম পুরান ঢাকা’