বিশেষ সংবাদদাতা: মণিপুর। ভারতের উত্তর-পূর্বের এই রাজ্যটি এখন সংবাদের শিরোনামে। ৩ মে থেকে ভয়ঙ্কর জাতিদাঙ্গায় মণিপুর কার্যত বিধ্বস্ত। ১৫০-এর বেশি মানুষের মৃত্যু হয়েছে। ৪০ হাজার বাস্তুচ্যুত। মণিপুর জাতীয় রাজনীতির কেন্দ্রবিন্দুতে। বিরোধীরা অনাস্থা প্রস্তাব এনেছে ক্ষমতাসীন বিজেপি সরকারের বিরুদ্ধে। ইস্যু সেই মণিপুর। বিজেপি সরকার জবাব দেয়ার জন্য তৈরি হচ্ছে। ইস্যু সেই মণিপুর। রাহুল গান্ধী মণিপুর ঘুরে এসেছেন, বিরোধীদের সম্মিলিত দল মণিপুর পৌঁছেছে সরেজমিনে অবস্থা খতিয়ে দেখার জন্য। কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ তিনদিনের মণিপুর সফরে ৪১টি গণ-সংগঠনের সঙ্গে কথা বলেছেন।
স্বরাষ্ট্র দপ্তরের প্রতিমন্ত্রী নিত্যানন্দ রাই মণিপুরে ক্যাম্প করে পড়ে রয়েছেন। সবমিলিয়ে মণিপুর কার্যত বয়লিং পয়েন্টে। ভারতের জাতীয় সমস্যায় পরিণত হয়েছে মণিপুর।
অনুসন্ধানে উঠে এলো চমকপ্রদ কিছু তথ্য। দশকের পর দশক মণিপুর বিদীর্ণ হয়েছে জাতিদাঙ্গায়। নতুন কোনও ঘটনা নয়। বারবার মণিপুরে জাতিগত দাঙ্গায় মানুষ মরেছে, ঘরবাড়ি জ্বলেছে। মানুষ বাস্তুচ্যুত হয়েছে।
এবারের দাঙ্গার কারণ ভিন্ন। এই দাঙ্গা মণিপুর হাইকোর্টের একটি রায়কে কেন্দ্র করে। মণিপুরে বরাবরই মেইতেই সম্প্রদায়ের প্রাধান্য। আট হাজার ৬২১ বর্গ মাইলের মণিপুরে মেইতেইরা সংখ্যাগুরু। মণিপুরের সরকারি ভাষা-মেইতেই। সরকারের অধিকাংশ মন্ত্রী কিংবা রাজপুরুষ মেইতেই সম্প্রদায়ভুক্ত। মণিপুর হাইকোর্টের রায় ছিল যে, এই মেইতেই সম্প্রদায় এখন থেকে তফসিলি উপজাতির স্বীকৃতি পাবে। অস্তিত্ব বিপন্ন বুঝে মেইতেইদের বিরুদ্ধে প্রথমে অস্ত্র ধরলো কুকিরা। তারপর নাগারা এবং সবশেষে জমো সম্প্রদায়। শুরু হলো হত্যা, অগ্নিসংযোগ এবং লুটতরাজ। এই অবস্থার সুযোগ নেয় দুটি শ্রেণি। এক. দুষ্কৃতীরা, দুই. রাজনীতিবিদরা। এখানেও এর ব্যতিক্রম হলো না। ধর্ষণ, নারী নির্যাতনের ঘটনা ঘটতে লাগলো। যা ছিল জাতিগত বিভেদ রাজনীতির স্পর্শ তা করে দিলো হিন্দু ও খ্রিস্টানদের সংঘাত। জ্বললো ঘরবাড়ি। রক্তে ভিজে গেল মণিপুরের মাটি। যে মণিপুর রাজদুহিতা চিত্রাঙ্গদার কথা লিখেছিলেন রবীন্দ্রনাথ, সেই চিত্রাঙ্গদারা ভুলুন্ঠিত হলো মণিপুরে। মণিপুরের উত্তরে নাগাল্যান্ড, দক্ষিণে মিজোরাম, পশ্চিমে আসাম। প্রতিবেশী রাষ্ট্র হলো মায়ানমার। মায়ানমারের উদ্বাস্তুরা আগে থেকেই ছিল মণিপুরে। দাঙ্গা শুরু হতেই নতুন ঠগীর মতো এলো নতুন জঙ্গির দল। কুকি – নাগাদের সঙ্গে জোট বেঁধে অস্ত্রাগার লুণ্ঠনের ঘটনা পর্যন্ত ঘটেছে। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহর দাবি, ধীরে ধীরে স্বাভাবিক হচ্ছে মণিপুর।
দলিল দস্তাবেজ থেকে বেড়িয়ে অঅসছে পুরনো সংঘাতের কাহিনি। ১৯৯৩ থেকে ’৯৮-এর মধ্যে ৭৫০ জনের মৃত্যু ঘটে। জুন ১৯৯৭ থেকে ’৯৮-এর সেপ্টেম্বর মাস পর্যন্ত মেইতেই এবং কুকি সম্প্রদায়ের লড়াইয়ে প্রাণ হারান ৩৫২ জন। ১৩ হাজার মানুষ বাস্তুচ্যুত হয়। ১৯৯৩ সালে মেইতেই- পঙ্গলদের সংঘর্ষে ১০০ জন প্রাণ হারান। ১৯৯৭ সালে কুকি-তামিল সংঘর্ষ ভয়াবহ হয়। মোড়েতে অবস্থিত ১৬ হাজার তামিলের মধ্যে ৯ হাজারই মণিপুর ছাড়তে বাধ্য হয়। কংগ্রেসের ১৫ বছরের শাসনেও মণিপুরের অবস্থা বদলায়নি, বিজেপির শাসনেও সেই একই অবস্থা।
অনুসন্ধানে উঠে এলো আরও কিছু তথ্য। স্বাধীনতার পর প্রথমে কেন্দ্রশাসিত অঞ্চল, ১৯৭২-এ রাজ্য হয়েছে মণিপুর। কিন্তু, এই ক’বছরে মণিপুরে বড়লোকরা আরও বড়লোক হয়েছে। গরীব আরও গরীব হয়েছে। কুকি, নাগা উপজাতিরা আজও বাঁশের কোঁড়া সিদ্ধ করে খায়। গেরি-গুগলি তাদের প্রধান খাদ্য। যেদিন একটা শিয়াল শিকার করতে পারে সেদিন তো উৎসব নাগা কিংবা কুকি পরিবারে।
মেইতেইদের বাড়িতে কখনও চাল বাড়ন্ত হয় না। হ্যাভ আর হ্যাভ নটদের লড়াইও কী ছিলো না মণিপুরের সংঘর্ষে!
আরো পড়ুন : হামলা–নির্যাতনের প্রতিবাদে সোমবার সারা দেশে ‘জনসমাবেশ’ করবে বিএনপি