নিজস্ব প্রতিবেদক : একজন মন্ত্রীর যুক্তরাজ্যে আটটি রিয়েল এস্টেট কোম্পানির মালিকানা ও ২ হাজার ৩০০ কোটি টাকা বিনিয়োগের তথ্য হলফনামায় প্রকাশ না করার বিষয়টি সারা দেশে আলোচনা হচ্ছে। শুধু এই মন্ত্রী নন, তার মতো অন্য মন্ত্রী-এমপিদের বড় অংশই হলফনামায় সম্পদের তথ্য গোপন করেছেন, যা ধীরে ধীরে প্রকাশ হতে শুরু করেছে।
আরো পড়ুন : বিদেশে বিনিয়োগ ২ হাজার ৩১২ কোটি টাকা শুধু এক মন্ত্রীর
আরো পড়ুন : রূপগঞ্জে মূর্তিমান আতঙ্কের নাম এপিএস এমদাদ, ভয়ংকর অপরাধজগৎ তার দখলে
এ ছাড়া ফেনী সদরের এমপি নিজাম উদ্দিন হাজারী ৫ একর জমির ওপর রাজপ্রাসাদের মতো বাগানবাড়ির তথ্য হলফনামায় গোপন করেছেন। এটির বাজারমূল্য ৫০০ কোটি টাকা বলে গণমাধ্যমে খবর প্রকাশ হয়েছে। এভাবেই অনেক মন্ত্রী, এমপি সম্পদের তথ্য গোপন করেছেন।
আরো পড়ুন : যেন আলাদিনের চেরাগ পেয়ে সম্পদের পাহাড় গড়ল মন্ত্রীর এপিএস এমদাদ
আরো পড়ুন : অনেক প্রার্থীর বিরুদ্ধে হলফনামায় সম্পদের তথ্যে গরমিল
রাজনীতি-বিশ্লেষকরা বলছেন, যারা অস্বাভাবিক সম্পদের মালিক হয়েছেন তারা বেপরোয়াভাবে তা অর্জন করেছেন। নির্বাচন কমিশন যদি এসব যাচাইবাছাই করে দেখত যে প্রার্থী ভুল তথ্য দিয়েছেন, অথবা তথ্য গোপন করেছেন, এ কারণে যদি মনোনয়ন বাতিল করা হতো তাহলে তারা এ কাজ কখনো করতেন না। সংশ্লিষ্টরা মনে করেন, হলফনামায় দামের যে হিসাব দেখানো হয়েছে তাতে মনে হচ্ছে গত কয়েক বছরে কেউ জমি, ফ্ল্যাট, সোনার গহনা কেনেননি। আবার নতুন করে কেউ বহুতল ভবনও নির্মাণ করছেন না। হলফনামার তথ্যের ভিত্তিতে গণমাধ্যমে প্রকাশিত খবরের ভিত্তিতে জনগণের মধ্যে প্রশ্ন উঠেছে- আসলেই কি এ দামে জমি, ফ্ল্যাট, প্লট ও সোনা বাজারে পাওয়া যায়?
আরো পড়ুন : হলফনামায় তথ্যমতে প্রার্থীদের কারও সম্পদ অস্বাভাবিক হারে বেড়েছে
আরো পড়ুন : হলফনামায় তথ্যমতে স্বপনের ৫ আর ছেলের সম্পদ বেড়েছে ২৮ গুণ
হলফনামা থেকে জানা গেছে, দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে অংশগ্রহণের সময় ফেনী-২ আসনের এমপি নিজাম উদ্দিন হাজারী ও তাঁর স্ত্রী নুরজাহান বেগমের ৪ কোটি ১৩ লাখ ৬০ হাজার ৪৬৮ টাকার সম্পদ ছিল। হাজারী এমপি হওয়ার পর ২০১৮ সালের নভেম্বরে তাঁদের সম্পদের পরিমাণ বেড়ে দাঁড়ায় ৩১ কোটি ৯৫ লাখ ৫৭ হাজার ২০২ টাকায়। আর গত পাঁচ বছরে তাঁদের সম্পদের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ১২৪ কোটি ৬২ লাখ ৭৬ হাজার ২৪৩ টাকায়। গত ১০ বছরে তাঁদের সম্পদ বেড়েছে ১২০ কোটি ৪৯ লাখ ১৫ হাজার ৭৭৫ টাকার। অর্থাৎ তাঁদের সম্পদ বেড়েছে প্রায় ৩০ গুণ। বিপুল পরিমাণ সম্পদ বৃদ্ধির পরও ৫০০ কোটি টাকা মূল্যের একটি বাগানবাড়ির তথ্য গোপন করেছেন নিজাম উদ্দিন হাজারী। ফেনী শহরের দক্ষিণ সহদেবপুরে ৫ একর জমির ওপর বিলাসবহুল এ বাগানবাড়ি তৈরি করেন তিনি। সেখানে সম্পূর্ণ বিদেশি প্রযুক্তিতে অত্যাধুনিক একটি তিন তলা বাড়ি, দুটি হেলিপ্যাড (একটি ছাদে, অন্যটি বাগানে), বিশুদ্ধ পানির লেক, পানির ফোয়ারা, পশু, পাখি ও বন্য প্রাণীর খামার করা হয়েছে। এ ছাড়া বাড়িটির সৌন্দর্যবর্ধনে ১১ কোটি টাকা ব্যয়ে বিভিন্ন প্রজাতির দেশি-বিদেশি ফলদ গাছ ও ঘাস লাগানো হয়েছে।
আরো পড়ুন : হলফনামায় তথ্যমতে ধনসম্পদ বেড়েছে এমপিদের, স্ত্রী উপহার পায় ২৫০ ভরি স্বর্ণ
অঅরো পড়ুন : হলফনামার তথ্যমতে শত টাকা থেকে কোটিপতি হয়েছেন অনেক প্রার্থী
হলফনামা বিশ্লেষণে দেখা গেছে, কুমিল্লা-১০ আসনের প্রার্থী বর্তমান অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল তাঁর নির্বাচনি হলফনামায় গুলশানের মতো অভিজাত এলাকায় একটি বাড়ির মূল্য মাত্র ৩৫ লাখ টাকা বলে উল্লেখ করেছেন। যেখানে ৬ কোটি টাকার কমে গুলশানে কোনো ফ্ল্যাটও পাওয়া যায় না। একইভাবে পাবনা-৩ আসনের প্রার্থী ও বর্তমান সংসদ সদস্য মকবুল হোসেন সেখানকার ২০ বিঘা জমির দাম উল্লেখ করেছেন মাত্র ২ হাজার টাকা! সে হিসেবে তার প্রতি বিঘা জমির দাম ১০০ টাকা, যা বর্তমান বাজারে ১ কেজি পিঁয়াজের দামের চেয়েও কম। একইভাবে বরিশাল-৬ আসনে আওয়ামী লীগের প্রার্থী আবদুল হাফিজ মল্লিকের সরকারের কাছ থেকে পাওয়া ঢাকার ৫ কাঠার একটি প্লটের দাম উল্লেখ করেছেন মাত্র ৪০০ টাকা।
আরো পড়ুন : হলফনামার তথ্যমতে অর্থ ও সম্পদের যেন শেষ নেই বর্তমান ও সাবেক এমপি-মন্ত্রীদের
আরো পড়ুন : হলফনামার তথ্যমতে সম্পদ ও অর্থ কয়েকশগুন বেড়েছে এমপি-মন্ত্রীদের
কুষ্টিয়ার সংসদ সদস্য হাসানুল হক ইনু তাঁর হলফনামায় উল্লেখ করেছেন তাঁর স্ত্রীর নামে ১২ হাজার টাকা মূল্যের ৪০ ভরি সোনা আছে। হিসাব করে দেখা গেছে, প্রতি ভরি সোনার দাম পড়েছে মাত্র ৩০০ টাকা। বর্তমান বাজারে লাখ টাকা ছাড়িয়েছে সোনার ভরি, রুপার ভরিও হাজার টাকার বেশি। হাসানুল হক ইনু নিজের নামে ২৫ ভরি সোনার দাম দেখিয়েছেন ২৫ হাজার ৫০০ টাকা। নারায়ণগঞ্জের সেলিম ওসমান ধানমন্ডিতে ৪ হাজার ২৮৬ স্কয়ার ফুট ফ্ল্যাটের দাম উল্লেখ করেছেন ৩৯ লাখ টাকার কিছু বেশি। ধানমন্ডির কয়েকজন বাসিন্দা জানিয়েছেন, এত বড় ফ্ল্যাটের দাম ৮ থেকে ১০ কোটি টাকার মধ্যে হবে। ৩০ লাখ টাকায় কোনো ফ্ল্যাট দূরে থাক, এ ধরনের বিলাসবহুল ফ্ল্যাটের নিবন্ধন খরচই গুনতে হয় এক থেকে দেড় কোটি টাকা।হবিগঞ্জ-২ আসনে জাতীয় পার্টির প্রার্থী শংকর পাল তাঁর এক পাজেরো জিপের মূল্য দেখিয়েছেন ২ লাখ ৮০ হাজার টাকা এবং ১৫ ভরি সোনার মূল্য উল্লেখ করেছেন মাত্র ৩০ হাজার টাকা। চাঁপাইনবাবগঞ্জ-২ আসনে স্বতন্ত্র প্রার্থী গোমস্তাপুর উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি মু. গোলাম মোস্তফা পূর্বাচলে ৩ কাঠা জমির ক্রয়মূল্য দেখিয়েছেন ৬ লাখ টাকা। মাদারীপুর-২ আসনে আওয়ামী লীগের প্রার্থী ও সাবেক নৌপরিবহনমন্ত্রী শাজাহান খান ও তাঁর স্ত্রীর অবিশ্বাস্য কম মূল্যে রাজউক পূর্বাচলে ১০ কাঠার একটি প্লটের মূল্য দেখিয়েছেন ২৩ লাখ ৫ হাজার ৬০০ টাকা। যদিও এখানে ১ কাঠা জমির দামই বর্তমানে ৭০ লাখ থেকে ১ কোটি টাকা।
আরো পড়ুন : হলফনামার তথ্যমতে সম্পদ ও অর্থ কয়েকশগুন বেড়েছে অনেক সংসদ সদস্য প্রার্থীদের
আরো পড়ুন : হলফনামার তথ্যমতে মন্ত্রী-এমপির গৃহিণী স্ত্রীদেরও আয় ও সম্পদ বেড়েছে বহুগুন
নির্বাচনে অংশগ্রহণের জন্য প্রার্থীকে হলফনামার মাধ্যমে আট ধরনের তথ্য ও কাগজপত্র জমা দিতে হয়। গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশ অনুসারে হলফনামার মাধ্যমে প্রার্থী তথ্য না দিলে বা দাখিলকৃত হলফনামায় কোনো অসত্য তথ্য দিলে বা হলফনামায় কোনো তথ্যের সমর্থনে সার্টিফিকেট, দলিল দাখিল না করলে রিটার্নিং অফিসার নিজ উদ্যোগ অথবা কোনো ব্যক্তির উত্থাপিত আপত্তির পরিপ্রেক্ষিতে সংক্ষিপ্ত তদন্ত পরিচালনা করতে এবং কোনো মনোনয়নপত্র বাতিল করতে পারবেন। এ ছাড়া হলফনামা দাখিল না করলে বা আদেশের বিধানাবলি যথাযথভাবে প্রতিপালন না করলে ইসি বাছাই পর্যায়ে [আরপিও ১৪(৩)(সি)] সংশ্লিষ্ট ব্যক্তির প্রার্থিতা বাতিল করতে পারবেন। তা ছাড়া হলফনামায় প্রদত্ত কোনো তথ্য মিথ্যা বা ভুল প্রমাণিত হলে তা ১৮৬০ সালের দন্ডবিধি অনুযায়ী শাস্তিযোগ্য অপরাধ বলে বিবেচিত হবে।
অঅরো পড়ুন : শামীম ওসমান ঋণগ্রস্ত হলেও হলফনামার তথ্যমতে ইনুর নগদ অর্থ বেড়েছে ৫২ গুণ
আরো পড়ুন : জনপ্রতিনিধিদের সম্পদ বেড়েছে শত গুণেরও বেশি
এ বিষয়ে সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন) সম্পাদক ড. বদিউল আলম মজুমদার বলেন, হলফনামায় তথ্য দেওয়ার উদ্দেশ্য হচ্ছে, সংসদ নির্বাচনে যারা প্রার্থী হবেন, তাদের সম্পর্কে জেনে বুঝে ভোটাররা যেন সিদ্ধান্ত নিতে পারেন, যাতে সঠিক প্রার্থী নির্বাচিত হন। তথ্য দেওয়ার উদ্দেশ্যই হলো জনগণকে ক্ষমতায়িত করা। তথ্যগুলো যদি সঠিক না হয়, যদি বিভ্রান্তমূলক হয় তাহলে মানুষ ক্ষমতায়িত হওয়ার পরিবর্তে বিভ্রান্ত হয়। বাস্তবে তা-ই হচ্ছে।
আরো পড়ুন : হলফনামায় তথ্যানুযায়ী প্রার্থীদের কার কত সম্পদ
আরো পড়ুন : মন্ত্রীদের বেলায় স্বর্ণ এক হাজার টাকা ভরি, আর ফ্ল্যাট দুই লাখ টাকা, ধনী থাকে স্ত্রী
বদিউল আলম মজুমদার আরো বলেন, ভোটারদের বিভ্রান্ত করা কোনোভাবেই কাম্য নয়। নির্বাচন কমিশন যদি যাচাইবাছাই করে দেখত যে, প্রার্থী ভুল তথ্য দিয়েছেন অথবা তথ্য গোপন করেছেন, তখন তাদের মনোনয়নপত্র যদি বাতিল করা হতো, তাহলে এ কাজ প্রার্থীরা কখনই করতে পারতেন না। সার্বিক বিষয়ে দুর্নীতিবিরোধী সংস্থা ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান গতকাল বলেন, একজন মন্ত্রী বিদেশে ২ হাজার ৩০০ কোটি টাকার সম্পদের তথ্য প্রকাশ হওয়ার পর অন্যান্য মন্ত্রী-এমপির আত্মজিজ্ঞাসার সময় এসেছে। আরও কোনো মন্ত্রী-এমপি হলফনামায় সম্পদের তথ্য গোপন করেছেন কি না সেটা কর্তৃপক্ষের তদন্ত করে বের করা সম্ভব। অবিশ্বাস্য মাত্রায় সম্পদের বৃদ্ধি, আয়ের প্রবৃদ্ধির চিত্র এবং আইন লঙ্ঘন করে বিদেশে সম্পদের মালিক হয়েছেন সেটা সামঞ্জস্যপূর্ণ কি না তা খুঁজে দেখা প্রয়োজন। তিনি বলেন, সম্পদের নেতিবাচক চিত্রের এ দায়টা কার পুরো রাজনৈতিক দলের, না মন্ত্রী-এমপিদের? আমরা মনে করি, নিজেদের মধ্যে আত্মজিজ্ঞাসা দরকার। এ রাজনৈতিক সংস্কৃতি থেকে বেরিয়ে আসার উপায় কী, তারা নিজেরাই খুঁজে বের করুক।
আরো প ড়ুন : শেষ হলো ‘গ্লোবাল বিজনেস কনফারেন্স- ২০২৩