মস্কো আগের যেকোনো সময়ের চেয়ে বেশি বিচ্ছিন্ন তা কতটা ঠিক

আন্তর্জাতিক প্রচ্ছদ মুক্তমত

ইউক্রেনে রাশিয়ার আগ্রাসনের দুই মাস পূর্ণ হয়েছে। মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন দাবি করছেন, এ আগ্রাসনের জেরে মস্কো আগের যেকোনো সময়ের চেয়ে এখন আরও বেশি বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে।

কিন্তু ইউক্রেনের মিত্রদের প্রত্যাশা অনুযায়ী রাশিয়া কি বিচ্ছিন্ন হয়েছে-এ প্রশ্নের উত্তর তলিয়ে দেখেছে বার্তা সংস্থা এএফপি।

রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের নির্দেশে গত ২৪ ফেব্রুয়ারি ইউক্রেনে সামরিক অভিযান শুরু করে রাশিয়ার বাহিনী। ইউক্রেনে রুশ সামরিক অভিযান আজ ২৪ এপ্রিল ৬০তম দিনে গড়িয়েছে। এই সময়ের মধ্যে রাশিয়াকে বিশ্ব থেকে বিচ্ছিন্ন করতে একের পর এক নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছে ইউক্রেনের মিত্ররা।

দুই মাস ধরে চলা এই যুদ্ধকালে মস্কোকে একঘরে করতে ওয়াশিংটনসহ কিয়েভের মিত্রদের প্রচেষ্টার কমতি ছিল না। কিন্তু আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের একটি অংশকে এ প্রচেষ্টায় অনাগ্রহী দেখা গেছে।

ফ্রেঞ্চ ইনস্টিটিউট ফর ইন্টারন্যাশনাল রিলেশনস অ্যান্ড স্ট্র্যাটেজিক অ্যাফেয়ার্সের ডেপুটি ডিরেক্টর সিলভি ম্যাটেলি বলেন, পশ্চিমা ব্লক থেকে রাশিয়া যে বিচ্ছিন্ন হয়েছে, তা খুবই স্পষ্ট। বিশেষ করে পশ্চিমাদের ধারাবাহিক নিষেধাজ্ঞার কারণে মস্কো বিচ্ছিন্ন হয়েছে। এ নিষেধাজ্ঞা মস্কোর বাণিজ্যিক ও আর্থিক বিনিময়কে জটিল করে তুলেছে।

তবে পশ্চিমা অঙ্গনের বাইরে রাশিয়াকে বিচ্ছিন্ন করার পরিস্থিতি বেশ ভিন্ন বলে মনে করেন এই ফরাসি গবেষক। এ প্রসঙ্গে ম্যাটেলি বলেন, রাশিয়ার বিরুদ্ধে যাওয়ার ব্যাপারে বেশ কিছু দেশ অত্যন্ত সতর্ক। রাশিয়ার বিরুদ্ধে অবস্থান নিতে পশ্চিমা চাপের কাছে নতিস্বীকার করতে এই দেশগুলো অস্বীকৃতি জানিয়ে আসছে।

ইউক্রেনে রুশ আগ্রাসনের আগে থেকেই মস্কোকে হুমকি দিয়ে আসছিল পশ্চিমারা। আগ্রাসন শুরুর পর ইউরোপ ও উত্তর আমেরিকা তীব্র প্রতিক্রিয়া দেখায়। তারা মস্কোকে বিশ্ব থেকে বিচ্ছিন্ন করার ঘোষণা দেয়। মস্কোর ওপর অভূতপূর্ব নিষেধাজ্ঞা আরোপের অঙ্গীকার করে।

পরবর্তী সপ্তাহগুলোয় রাশিয়ার ওপর একের পর এক পশ্চিমা নিষেধাজ্ঞা আসে। ইউরোপের অনেক দেশ তাদের আকাশসীমা রাশিয়ার উড়োজাহাজের জন্য বন্ধ করে দেয়। রাশিয়ার তেল-গ্যাসসহ বিভিন্ন পণ্য আমদানিতে নিষেধাজ্ঞা দেয় যুক্তরাষ্ট্র।

নিষেধাজ্ঞার অংশ হিসেবে কিছু রাশিয়ান ব্যাংককে সুইফট আন্তর্জাতিক পেমেন্ট সিস্টেম থেকে বাদ দেওয়া হয়। পুতিনসহ রাশিয়ার অনেক ব্যক্তিও নিষেধাজ্ঞায় পড়েন। তবে রাশিয়ার ব্যাপারে পশ্চিমের বাইরে সতর্ক প্রতিক্রিয়া লক্ষ করা যায়।

যেমন গত ২ মার্চ জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদে ইউক্রেন থেকে রাশিয়ার সেনা প্রত্যাহারসংক্রান্ত প্রস্তাবের ওপর ভোটাভুটিতে ভোটদানে বিরত ছিল ভারত ও দক্ষিণ আফ্রিকা। আবার রাশিয়ার ওপর নিষেধাজ্ঞা দিতে অস্বীকৃতি জানায় ব্রাজিল ও মেক্সিকো।

ইউনিভার্সিটি অব জোহানেসবার্গের আন্তর্জাতিক সম্পর্কের অধ্যাপক ক্রিস ল্যান্ডসবার্গের উদ্ধৃতির বরাত দিয়ে ওয়াশিংটন পোস্ট জানায়, বিশ্বে এমন দেশের সংখ্যা বাড়ছে, যাদের পশ্চিমাদের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সহযোগিতার আকাঙ্ক্ষা রয়েছে, কিন্তু তা সত্ত্বেও তারা রাশিয়া প্রশ্নে তাদের স্বাধীনতার বিষয়টি সামনে আনছে।

ভারত ও দক্ষিণ আফ্রিকায় নিযুক্ত চিলির সাবেক রাষ্ট্রদূত জর্জ হেইন বলেন, ইউক্রেন আক্রমণের নিন্দা করা এক জিনিস, আর রাশিয়ার বিরুদ্ধে অর্থনৈতিক যুদ্ধ শুরু করা অন্য জিনিস। দক্ষিণ আমেরিকা, আফ্রিকা ও এশিয়ার অনেক দেশ এই সীমা অতিক্রম করতে প্রস্তুত নয়।

জর্জ হেইন আরও বলেন, এই দেশগুলো এমন একটি অবস্থানে নিজেদের নিতে চায় না, যা তাদের স্বার্থের বিরুদ্ধে যায়।

এই প্রবণতা সৌদি আরব ও সংযুক্ত আরব আমিরাতের ক্ষেত্রে দেখা যাচ্ছে। এই দেশ দুটি এখন পর্যন্ত রাশিয়ার বিরুদ্ধে অবস্থান নেওয়া এড়িয়ে গেছে।

একই কথা ভারতের ক্ষেত্রেও বলা যায়। দেশটি গত ফেব্রুয়ারিতে জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদে রাশিয়ার আগ্রাসনের নিন্দায় ভোটদানে বিরত ছিল।

ভারতের সাবেক প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিংয়ের জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা শিবশঙ্কর মেনন বলেন, ভারতের জন্য এই যুদ্ধ একটি কঠিন ও অনাকাঙ্ক্ষিত পরিস্থিতি তৈরি করেছে। পশ্চিমা ব্লক ও রাশিয়ার মধ্যে কোনো একটি পক্ষকে বেছে নেওয়া এড়াতে ভারত সম্ভাব্য সবকিছুই করছে।

সম্প্রতি মেনন ‘দ্য ফ্যান্টাসি অব দ্য ফ্রি ওয়ার্ল্ড: আর ডেমোক্রেসিস রিয়ালি ইউনাইটেড অ্যাগেনেস্ট রাশিয়া?’ শিরোনামের একটি প্রবন্ধ লেখেন। এই প্রবন্ধে তিনি উল্লেখ করেন, ভারতের আধুনিকীকরণে যুক্তরাষ্ট্র একটি অপরিহার্য অংশীদার। কিন্তু রাশিয়া ভূরাজনৈতিক ও সামরিক কারণে ভারতের একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশীদার রয়ে গেছে।

এ প্রসঙ্গে সাবেক ফরাসি রাষ্ট্রদূত মিশেল ডুকলোস বলেন, এ প্রবণতা নতুন কিছু নয়। ২০১৫ সালের সিরিয়া সংকট ও প্রথম ইউক্রেনীয় সংকটের সময় পশ্চিমাদের সঙ্গে ভারত বা ব্রাজিল ছিল না।

মিশেল বলেন, ‘আমাদের নিজেদের জিজ্ঞাসা করতে হবে, কেন এমন হলো? এই দেশগুলোর সঙ্গে আরও শক্তিশালী সেতুবন্ধ তৈরি করতে আমরা কী করতে পারি? আর এ প্রশ্ন আগের চেয়ে এখন বেশি প্রাসঙ্গিক।’

রাশিয়াকে পুরোপুরি একঘরে করতে পশ্চিমা শক্তিগুলো জোর প্রচেষ্টা চালাচ্ছে। কিন্তু এই প্রচেষ্টার ফলাফল সীমিত।

উদাহরণ হিসেবে জি-২০ জোটের কথা বলা যায়। এই জোট থেকে মস্কোকে বাদ দেওয়ার জন্য আহ্বান জানানো হয়েছিল। কিন্তু শেষ পর্যন্ত তা সফল হয়নি।

রাশিয়ার বিপক্ষে যেতে যে দেশগুলো দ্বিধায় রয়েছে, তাদের বোঝাতে, আস্থায় নিতে পশ্চিমারা ব্যর্থ হচ্ছে।

কার্নেগি ইউরোপ থিঙ্কট্যাংকের বিশ্লেষক জুডি ডেম্পসি বলেন, রাশিয়ার বিরুদ্ধে পশ্চিমাদের নিষেধাজ্ঞাগুলো কঠিন। কিন্তু তা পুতিনকে থামাতে পারছে না।

রাশিয়ার ওপর পশ্চিমাদের নিষেধাজ্ঞার পূর্ণ প্রভাব দেখতে আরও সময় লাগতে পারে। এ প্রসঙ্গে রাশিয়ান আর্থিক বিশ্লেষক আলেক্সি ভেদেভ বলেন, রুশ অর্থনীতির অবস্থা জুন বা জুলাই মাসে আরও স্পষ্ট হবে। কারণ, এখন রুশ অর্থনীতি তার রিজার্ভের ওপর ভর করে চলছে। রিজার্ভ কমছে। কিন্তু যতক্ষণ না পর্যন্ত রিজার্ভ আছে, ততক্ষণ নিষেধাজ্ঞাগুলো সম্পূর্ণরূপে অনুভূত হবে না।

আরো পড়ু ন : ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীরা কি বিএনপি নেতার হুকুমে সন্ত্রাসী কাজ করেছেন?

Share The News

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *